রাস্তা আটকে বিক্ষোভ। মেদিনীপুরে।
ধোঁয়াশায় ঢেকে গিয়েছে গোটা দৃশ্যপট। ঝাপসা, আবছা দৃষ্টিপথ। অস্বচ্ছ পর্দাটার ও পারে কী ঘটে গেল, ঠিকঠাক বোঝাই গেল না। এ পারে লহমায় চুরমার হাজার হাজার স্বপ্ন। অতএব অবধারিত ভাবেই অবিশ্বাস আর সংশয়ের বাতাবরণ, স্বাভাবিক ভাবেই অস্বচ্ছতার এক রাশ অভিযোগ। এমন সময় মগডাল থেকে এক জন তর্জন করে উঠলেন— যা খুশি অভিযোগ করলেই হবে না, প্রমাণ দিতে হবে।
কীসের প্রমাণ চাইছেন রাজ্যের শিক্ষা দফতরের শীর্ষ পদে বসে থাকা ব্যক্তি? প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির জন্য শিক্ষক নিয়োগ হল, কিন্তু নিয়োগের কোনও তালিকা প্রকাশ করা হল না। চাকুরিপ্রার্থীদের মধ্যে কারা সফল আর কারা নন, তা জানার জন্য কোনও তালিকাই নেই— এমন দৃষ্টান্ত বিরল তো বটেই, নজিরবিহীন বললেও খুব ভুল হয় না সম্ভবত। এর পরও শিক্ষামন্ত্রী অস্বচ্ছতার প্রমাণ চাইছেন?
কার কাছ থেকেই বা প্রমাণ চাইছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়? যে হাজার হাজার যুবক-যুবতী আজ প্রতারিত বোধ করছেন, অস্বচ্ছতার অভিযোগ তুলছেন, করজোড়ে স্বচ্ছ নিয়োগের আকুতি জানাচ্ছেন বা রাস্তায় শুয়ে প্রতিবাদ করছেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায় তো তাঁদেরও শিক্ষামন্ত্রী। যাঁরা নিয়োগ পেলেন, শুধু তাঁদের মন্ত্রী নন, পার্থ চট্টোপাধ্যায় গোটা রাজ্যের মন্ত্রী। অভিযোগ যখন এত বড় করে উঠল, এমন উত্তপ্ত প্রতিবাদ যখন রাজপথে আছড়ে পড়ল, তখন অভিযোগের সত্যতা খুঁজে দেখার দায় তো পার্থ চট্টোপাধ্যায়েরই। অস্বচ্ছতা নেই অথবা অস্বচ্ছতা রয়েছে— এ প্রমাণের দায় তো তাঁরই। কারণ অস্বচ্ছতা যদি থেকে থাকে এবং তার প্রমাণ যদি থেকে থাকে, তা হলে তা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অধীনস্থ দফতরেই রয়েছে, অন্যত্র নয়। কিন্তু নিজের সে প্রশাসনিক অস্তিত্বের কথা সম্ভবত বিস্মৃত হয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। তাই অভিযোগ যাঁরা করছেন, সুবিচার যাঁরা চাইছেন, তাঁদের প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর সুর প্রতিপক্ষ-সুলভ।
রোজ পথে নামছেন টেট উত্তীর্ণরা, রোজ বিক্ষোভ হচ্ছে, রোজ অবরোধ চলছে। নিয়োগে দুর্নীতি বা অস্বচ্ছতার অভিযোগকে কেন্দ্র করে এ রাজ্যে এমন বিক্ষোভের দৃষ্টান্ত স্মরণাতীত কালে নেই। হতেই পারে অভিযোগ ঠিক নয়, হতেই পারে এই ক্ষোভ যুক্তিযুক্ত নয়, হতেই পারে নিয়োগ যোগ্যতার ভিত্তিতেই হয়েছে। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে সংশয়ের একটা ঘোলাটে বাতাবরণ নিয়োগ প্রক্রিয়াকে ঘিরে ধরেছিল বলেই আজ অস্বচ্ছতার অভিযোগের এই সুবৃহৎ অবকাশ তৈরি হয়েছে। যে বেনজির প্রক্রিয়ায় নিয়োগ হল প্রাথমিকে, যাবতীয় সংশয়ের আঁতুড়ঘর সেই প্রক্রিয়াই। তাই এই সংশয়ের দায় সরকার তথা শিক্ষা দফতর কিছুতেই এড়াতে পারে না।
সংশয়ের দায় যখন সরকারের, সংশয় নিরসনের দায়ও তখন সরকারেরই। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী এখন যেন মেহের আলির ভূমিকায়। সবাইকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছেন আর বলছেন, ‘তফাৎ যাও, তফাৎ যাও, সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়।’ কেন ‘ঝুট হ্যায়’? ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়টা মেহের আলির ছিল না। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কিন্তু সে দায়টা রয়েছে।