তিন বছর থেকেই তিন ভাষা
Education Policy

‘বহুভাষিকতাই ভারতের শক্তি’, তবু হিন্দি শেখার বন্দোবস্ত পাকা

বহুভাষিকতাই ভারতের শক্তি। দেশের ভূমিজ ভাষাগুলিই দেশের মানুষের ভাব প্রকাশের জন্য বিকশিত। তা সত্ত্বেও মাটি থেকে উঠে আসা এই সব ভাষাকে অগ্রাহ্য করে আজও ইংরেজিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়।

Advertisement

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০২০ ০০:০৪
Share:

এই কেন্দ্রীয় সরকারের একটি ব্যাপারে সাফল্য অসাধারণ। তা হল, যে কোনও নীতি, সে যতই খারাপ হোক, তাতে জনতার যতই অসুবিধে হোক, সে সব নিয়ে কেয়ার না করে এন্তার শোরগোল ফেলে দেওয়া। ঢাক পিটিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া। নোটবন্দির সময় জানা গিয়েছিল, এ বার কালো টাকার দিন শেষ। এমনকি মূলধারার মিডিয়াতেও শোনা গিয়েছিল, যে কোনও দিন সন্ত্রাসবাদও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চলেছে, কারণ নতুন নোটে লাগানো হবে জিপিএস চিপ। সে সবের ঢক্কানিনাদের কী গতি হয়েছে, এখন জানতে কারও বাকি নেই, কিন্তু তত দিনে নতুন চমক এসে গিয়েছে। ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর সময় জানা গিয়েছিল, ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে পাকিস্তানের সামরিক চক্রের উপর, কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়ার গুজগুজ ফুসফুস জানায় যে, কয়েকটি পাইনগাছ আর একটি দুর্ভাগা কাক ছাড়া সীমানার ও-পারে কোনও হতাহতের খবর নেই। তাতেও কোনও সমস্যা হয়নি, কারণ তত দিনে নতুন হেডলাইন চলে এসেছে। এ বার নতুন শিক্ষানীতি নিয়েও একই রকম হট্টগোল। যে দিন শিক্ষানীতির ঘোষণা হল, সে দিনই দিগ্বিদিকে শিরোনাম হয়ে গেল: ‘এ বার প্রাথমিক স্তরে শিক্ষাদানের মাধ্যম হতে চলেছে স্থানীয় ভাষা’। যেন প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের শিক্ষানীতি আবার কল্কি অবতারে নেমে এসেছে ভারতের বুকে। এ বার শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, গোটা দেশেই দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হবে ‘মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ’। সাঁওতাল এ বার তার মাতৃভাষায় কথা বলতে বলতে সিধে চলে যাবে রাষ্ট্রপুঞ্জে।

Advertisement

এই ঢাকঢোলের শুরু অবশ্য শিক্ষানীতির মূল খসড়া থেকেই। যে কোনও ‘প্রগতিশীল’ মানুষের চোখে জল এসে যেতে পারে, কেননা তাতে পরিষ্কার বলা আছে, বহুভাষিকতাই ভারতের শক্তি। দেশের ভূমিজ ভাষাগুলিই দেশের মানুষের ভাব প্রকাশের জন্য বিকশিত। তা সত্ত্বেও মাটি থেকে উঠে আসা এই সব ভাষাকে অগ্রাহ্য করে আজও ইংরেজিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। কারণ, ভারতীয় শিক্ষা ও চাকরির ব্যবস্থা এলিটদের কব্জায়। যদিও ইংরেজি বলতে পারেন মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ, কিন্তু তাঁরাই ভারতের চাকরির এবং কাজের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখেন। এমনকি ইংরেজি জানাকে অনেক সময়ই ‘শিক্ষা’র প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যেন ইংরেজি শিক্ষাই হল শিক্ষার পরাকাষ্ঠা।

নতুন শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য কী? কোনও সন্দেহ নেই, এলিটদের এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে সমস্ত ভুখা জনতাকে ন্যায়বিচার দেওয়া। এলিটীয় ক্ষমতাচক্রকে প্রতিহত করা। ভূমিজ ভাষাকে তার নিজস্ব সম্মান ও পরিসর ফিরিয়ে দেওয়া। এক কথায়, বঞ্চনার দিন শেষ, এই শিক্ষানীতির জাদুকাঠিতে চণ্ডাল ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, নেটিভ ভারতবাসী এ বার পায়ের তলায় ফিরে পাবেন তাঁদের নিজস্ব মাটি। আমরা করব জয়, নিশ্চয়। (এই অর্ধেক বিবেকানন্দীয়, বাকি আধা পিট সিগার-সুলভ ঘোষণায় কারও বিশ্বাস না হলে, তিনি খসড়ার ৮১ ও ৮২ পাতা দেখে নিতে পারেন; ভাষার কারিকুরি ছাড়াই সহজ সরল ভাবে এ সব কথা লেখা আছে)।

Advertisement

এই সব ভাল ভাল কথায় কারও সমস্যা থাকার কথা নয়, কিন্তু এই সরকারের ঢাকঢোলের শব্দ এক রকম, আর তার ভিতরে ঢুকলে সম্পূর্ণ অন্য বস্তু। এ ক্ষেত্রেও তা-ই। এই শিক্ষানীতির শয়তান লুকিয়ে আছে তার বিশদ ব্যাখ্যায়। বৈপ্লবিক বুলির মুখবন্ধ ভেদ করে সেখানে গেলেই দেখা যাবে, সরকারের ট্র‌্যাক-রেকর্ড অক্ষত। এই শিক্ষানীতি পুরনো বাম সরকারের ‘মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ’ নীতির ফটোকপি তো নয়ই, কার্যত তার একদম উল্টো। এ কথা ঠিক যে নতুন শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরে নির্দেশ দেওয়ার ঘোষিত মাধ্যম মাতৃভাষাই, কিন্তু একমাত্র ওইটুকুই তো ‘মাতৃভাষায় শিক্ষা’র মূল কথা নয়। পিছিয়ে পড়া জনসমষ্টিকে শিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে আনার জন্য যে ‘মাতৃভাষায় শিক্ষা’র নীতি, তার আসল কথাটা হল কচি বয়সে একাধিক ভাষার বোঝা শিশুর ঘাড়ে চাপানো হবে না, শিশু ছোট বয়সে কেবল একটিই ভাষা শিখবে, যা তার মাতৃভাষা। এই শিক্ষানীতি এই পদ্ধতির ঠিক উল্টো দিকে হাঁটে। তার যুক্তি-পরম্পরাও খুবই সহজ। এখানে ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছে, বহুভাষিকতাই ভারতের শক্তি। একদম তিন বছর বয়স থেকেই প্রতিটি শিশুর একাধিক ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক। কেন? কারণ শিক্ষানীতি বলছে, কচি বেলায় নানা ভাষা শেখানো খুব সহজ। শুধু তা-ই নয়, সঙ্গে এ-ও ঠিক যে দুনিয়াজোড়া অধ্যয়নে দেখা গিয়েছে, যে বাচ্চারা একটিমাত্র ভাষা শেখে, তাদের চেয়ে যারা একাধিক ভাষা শেখে তারা অনেক তাড়াতাড়ি শেখে, জীবনে বেশি উন্নতি করে। সংস্কৃতি, অভিব্যক্তি, ভাবপ্রকাশ সব কিছুতেই এগিয়ে থাকে। এতে জাতীয় সংহতিরও উন্নতি হয়। কোন অধ্যয়ন বা স্টাডিতে এমন জানা গিয়েছে, সে বিষয়ে অবশ্য কোনও সূত্র দেওয়া নেই।

কচি বয়স থেকেই বাচ্চা ঠিক কী কী ভাষা শিখবে, তা-ও নীতিতে খুব স্পষ্ট করেই বলা আছে। প্রাক্প্রাথমিক স্তর থেকেই ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হবে ত্রি-ভাষা সূত্র। কোন কোন তিনটি ভাষা? শিক্ষানীতিতে বলা আছে, ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে ১৯৬৮ এবং ১৯৮৬/’৯২ সালের ত্রি-ভাষা সূত্রই অনুসরণ করা হবে। ১৯৬৮ সালের কেন্দ্রীয় সরকারি শিক্ষানীতিতে খুব স্পষ্ট করে বলা আছে, অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় তিনটি ভাষা হল, আঞ্চলিক ভাষা, হিন্দি ও ইংরেজি। ১৯৮৬/’৯২-এর শিক্ষানীতিতেও অবিকল এই বস্তুটিই অনুসরণ করা হয়। ২০২০ সালের নতুন শিক্ষানীতিও তা-ই। একটিই নতুন জিনিস এখানে যোগ হয়েছে। এই ত্রি-ভাষা সূত্রকে প্রাক্প্রাথমিক স্তরে নামিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ মাধ্যমিক স্তর নয়, এ বার তিন বছর বয়স থেকে বাধ্যত অ-হিন্দিভাষী শিশুকে তিনটি ভাষা শিখতে হবে, যার মধ্যে মাতৃভাষা ছাড়া অন্য দু’টি হল হিন্দি এবং ইংরেজি।

এ যদি মাতৃভাষার উপর জোর দেওয়ার নমুনা হয়, তা হলে ‘মাতৃভাষায় শিক্ষা’র সংজ্ঞা নতুন করে লিখতে হবে। কিন্তু তার পরেও একটি প্রশ্ন আসতেই পারে— এই নীতি যদি সেই ১৯৬৮ সাল থেকেই চলে থাকে, নতুন করে সমস্যার কী হল! হঠাৎ করে শুধু এই সরকারকে দোষ দেওয়া হচ্ছে কেন? তার উত্তরও সহজ। ১৯৬৮ সালে ভারতে শিক্ষা ছিল রাজ্য তালিকাভুক্ত। শিক্ষার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা ছিল খুব সীমিত। ১৯৬৮ সালের শিক্ষানীতি একটি ঘোষণামাত্র ছিল, রাজ্য সরকারগুলির সে সব মেনে চলার কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। যেমন পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই ত্রি-ভাষা সূত্র কখনও অনুসরণ করেনি। তৃতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দি শেখার বিশেষ সুযোগই পশ্চিমবঙ্গে কখনও ছিল না, বাধ্যবাধকতার তো প্রশ্নই নেই।

ব্যাপারটি বদলাতে শুরু করে জরুরি অবস্থার সময় থেকে। ১৯৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বস্তুত অগ্রাহ্য করে শিক্ষাকে নিয়ে আসা হয় যৌথ তালিকায়। তার হাত ধরে ক্রমশ শিক্ষাক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার এবং কেন্দ্রীয় বোর্ডগুলির আধিপত্যের জমি তৈরি হয়। তার পরে ১৯৮৬ সালের শিক্ষানীতি ঘোষণা কালেও এই প্রভাব খুব বেশি ছিল না। কিন্তু তারও পর ৩০ বছরের বেশি সময় কেটেছে। অবস্থা এখন অন্য রকম। এর মধ্যে সরকার এসেছে, এবং গিয়েছে। কিন্তু শিক্ষা কখনওই আর রাজ্য তালিকায় ফিরে যায়নি, বরং শিক্ষাক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাব ক্রমশ বেড়েছে। রাজ্য সরকারগুলি এখনও কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতি অগ্রাহ্য করে চলতেই পারে, কিন্তু কার্যত সেটি অসম্ভব। কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতি এবং বোর্ডগুলির প্রভাব এখন অনেক বেশি। সামগ্রিক ভাবে গোটা ভারতেই চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দি এবং ইংরেজিকে যে ভাবে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, তাতে সেই চাপ একেবারে অগ্রাহ্য করে চলা রাজ্য সরকারগুলির পক্ষে আর সম্ভব নয়।

ফলত, যদিও এই শিক্ষানীতি আকাশ থেকে পড়েনি, এটি একটি ধারাবাহিকতারই ফসল, কিন্তু আজকের অবস্থা ১৯৬৮-র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ২০২০ সালে ভাষাগত ভাবে এই শিক্ষানীতির সম্ভাব্য ফল একটিই, যা মুখবন্ধের ঢক্কানিনাদের ঠিক উল্টো। এত দিন শিক্ষার এবং কাজের ক্ষেত্রে এলিটীয় বৈষম্য রক্ষা করা হচ্ছিল কেবল ইংরেজি দিয়ে। ইংরেজির একাধিপত্যের একটা বড় অসুবিধে হল এই যে, ইংরেজি ভাষায় যোগ্যতার পরীক্ষা হলে, সেখানে কেবলমাত্র এলিটরাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পান, পিছিয়ে পড়া বা প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়ারা অনেক পিছিয়ে থেকে শুরু করায়, কার্যত দৌড়ের ময়দানে তাঁদের কোনও সুযোগই থাকে না। এমনকি তিন বছর বয়স থেকে ইংরেজি পড়ালেও না। এই অসমতা এত দিন ছিল, এখনও আছে, তার সঙ্গে যুক্ত হতে চলেছে হিন্দির আধিপত্য। হিন্দির একাধিপত্যের বড় অসুবিধে হল, এক জন বাঙালি বা এক জন তামিল এক জন হিন্দিভাষীর থেকে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সব সময়ই পিছিয়ে থাকবেন। এই দৌড়ে অ-হিন্দিভাষীদের বিশেষ জায়গা নেই। এমনকি তিন বছর বয়স থেকে পড়লেও নেই।

এরও উপরে অবশ্যই থাকে ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার প্রশ্ন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রতিটি ভাষাকে সমান গুরুত্ব দেওয়ার অঙ্গীকারের প্রশ্ন। কোনওটিই নতুন শিক্ষানীতিতে রক্ষিত হয়নি। তাতে অবশ্য সমস্যা নেই, কারণ ‘মাতৃভাষায় শিক্ষা’ নামক ঢক্কানিনাদের পর সংবাদের শিরোনামে এসে গিয়েছে রামমন্দির। শিক্ষায় ‘আঞ্চলিকতা’কে কোণঠাসা করে অন্য ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কি না, এ সব ছোটখাটো বিষয় এখন অর্থহীন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন