Unemployment

কাজ কম, মেয়েদের আরও কম 

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে, বিশ্বজোড়া নানা সমীক্ষার ফলও উদ্বেগজনক।

Advertisement

নরেন্দ্রনাথ আইচ

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২২ ০৮:১৯
Share:

ভারতের ৩৮ কোটি অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য ‘ই-শ্রম পোর্টাল’ চালু হয়েছে। এই প্রথম এমন একটি ব্যবস্থা চালু হল যা নির্মাণ শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিক, পরিচারক, হকার প্রভৃতি অসংগঠিত শ্রমিকদের সরাসরি সরকারের সঙ্গে যুক্ত করবে। তৈরি হবে জাতীয় পর্যায়ে শ্রমিকের তথ্যভান্ডার। শ্রমিকেরা পাবেন জীবন বিমা, দুর্ঘটনা বিমা-সহ নানা ধরনের সুবিধা। এখনও অবধি চব্বিশ কোটি ভারতীয় ই-শ্রম পোর্টালে নাম লিখিয়েছেন। তাঁরা নিজেদের সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছেন, তা থেকে ভারতের শ্রম বাজারের একটি চিত্র উঠে আসছে।

Advertisement

প্রথম যে বিষয়টি অনেকেরই নজরে এসেছে, তা হল উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার। ২ কোটি ৮৮ হাজার ব্যক্তির শিক্ষার স্তর স্নাতক বা তদূর্ধ্ব। অর্থাৎ বিপুল সংখ্যক কর্মরত মানুষ তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতার অনুরূপ কাজ না পেয়ে স্বল্প মজুরির অসংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত। এ তথ্য যতই দুঃখের হোক, আশ্চর্য নয়। গ্রুপ ডি কর্মচারী কিংবা হাসপাতালের ডোম পদের জন্য পিএইচ ডি-প্রাপ্ত প্রার্থীদের কথা প্রায়ই প্রকাশিত হয় সংবাদে।

তুলনায় কম আলোচিত হল শ্রম বাজারে মেয়েদের ছবি। পোর্টালে মোট নথিভুক্ত শ্রমিকদের প্রায় তিপ্পান্ন শতাংশই হল মহিলা, অর্থাৎ প্রায় ১৩ কোটি। কাজ যেখানে কম, সেখানে মেয়েদের ভাগ্যে যে আরও কম কাজ জুটবে, বলা বাহুল্য। পড়াশোনা করেও মেয়েরা কাজ পাচ্ছে না। স্নাতক ডিগ্রি থাকা মেয়েদের মাত্র ৩২-৩৩ শতাংশ রোজগার করছে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ মেয়েদের বাড়িতে থাকার হার বেড়ে গিয়েছে। এনএসএসও-র তথ্য: শ্রমের বাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণের হার ২০০৪-০৫’এ ৩৭ শতাংশ থেকে ২০১৬ সালে নেমেছে ২৬ শতাংশে। শহরের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় এই প্রবণতা বেশি। কৃষিকাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে তাদের ফিরতে হচ্ছে গার্হস্থশ্রমে।

Advertisement

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে, বিশ্বজোড়া নানা সমীক্ষার ফলও উদ্বেগজনক। যেমন, পুরুষ-মহিলার বেতনে পার্থক্য ভারতে বাড়ছে। ২০১৬-১৭ সালে একই কাজ করেও পুরুষের তুলনায় মহিলারা ৩০ শতাংশ কম মজুরি পান। সবচেয়ে নিম্ন আয়ের পেশাগুলিতে মেয়েরাই বেশি (৬০%) আর সর্বোচ্চ আয়ের পেশাগুলিতে কম (১৫%)। দেশে সমকাজে সমবেতন দিতে হবে, এমন আইন আছে, তবু লিঙ্গই নির্ধারণ করছে মজুরি, এমনকি সংগঠিত ক্ষেত্রেও। নারী ও পুরুষের দৈনিক মজুরি যথাক্রমে ৪৮২ টাকা এবং ৬৩২ টাকা। তথ্যপ্রযুক্তিতে নারী-পুরুষের বেতনের ফারাক ২৫ শতাংশ, ব্যাঙ্ক-সহ আর্থিক ক্ষেত্রে ২১ শতাংশ, শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষিত, কর্মদক্ষ মেয়েদেরও বঞ্চনা করছে তার কর্মক্ষেত্র। মেয়েরা তা প্রত্যাশাও করে না। একটি বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষাতে দেখা যাচ্ছে, দশ জনে প্রায় সাত জন মহিলা মনে করেন, কর্তৃপক্ষ বেতনে হেরফের দূর করতে কোনও পদক্ষেপ নেবে বলে তাঁরা মনে করেন না।

বরং ছাঁটাইয়ের খাঁড়া ঝোলে মেয়েদের মাথার উপর। কয়েক বছর আগে চেন্নাইতে এক মহিলা তথ্য প্রযুক্তি কর্মী মাতৃত্বকালীন ছুটি নিতে গেলে তাঁকে ছাঁটাই করা হয়, আদালতে দৌড়ে তাঁকে তার চাকরিটা উদ্ধার করতে হয়েছিল। মাতৃত্বকালীন সুবিধা, কর্মক্ষেত্রে ক্রেশ থাকা, সবই আছে আইনে। অথচ, কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট (২০১২-১৩) বলছে, সারা দেশে নথিবদ্ধ কারখানাগুলোতে মোট ক্রেশের সংখ্যা মাত্র ৩২৮৯। কিছু রাজ্যে সংখ্যাটা ছিল শূন্য। ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ক্রেশ বিষয়ে একটি মডেল নির্দেশিকা তৈরি করে রাজ্যগুলোকে পাঠায় এবং দরকার মতো রাজ্যস্তরে বিধি তৈরি করতে বলে। একমাত্র কর্নাটক ২০১৯ সালে ক্রেশ বিষয়ে বিধি বানিয়েছে।

কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধের কাহিনিটাও লক্ষ করার মতো। শীর্ষ আদালতের নির্দেশে প্রথম যখন এটি ‘বিশাখা গাইডলাইন’ হিসেবে বলবৎ হল, তখন শ্রম দফতরকেই এটি কার্যকর করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ২০১৩ সালে যখন তা আইন হিসেবে এল, তখন দেখা গেল আইনটিকে ‘সার্ভিস রুল’-এর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ অভিযোগ গ্রহণ কমিটি গঠনের কথা বলা আছে, কিন্তু কর্তৃপক্ষ না বানালে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা নেই শ্রম দফতরের। আইনটি রূপায়ণের ‘নৈতিক দায়িত্ব’ দেওয়া হয়েছে নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রককে, কারখানা বা ওই জাতীয় প্রতিষ্ঠানে যাদের ভূমিকা সীমিত। ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, ৩৬ শতাংশ ভারতীয় সংস্থা ও ২৫ শতাংশ বহুজাতিক সংস্থা এখনও অভিযোগ গ্রহণ কমিটি গঠন করেনি। তার পরেও রয়েছে ‘জেলা অভিযোগ গ্রহণ কমিটি’ গঠন করার নির্দেশ, যা জেলাশাসক গঠন করবেন। অনেক প্রশাসক বিষয়টি সম্পর্কে এখনও অবহিতই নন।

শিক্ষিত হয়েও, পেশাগত যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েও কাজের জগতে মহিলাদের পিছিয়ে থাকাই যেন দস্তুর। বরং সম্মানজনক জীবিকা ও পেশাগত সুরক্ষার প্রশ্নে সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের মধ্যেকার ব্যবধান ক্রমশই লুপ্ত হচ্ছে, পিছু হটছে অধিকার ও ন্যায্যতার রাজনীতি, দর্শন। যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ নেই, কর্মস্থলে প্রাপ্য সুরক্ষা নেই, মজুরি ক্রমশ কমছে। ই-শ্রম পোর্টালে নাম লেখানো ছাড়া আপাতত হাতে থাকছে কী! আর তাই বাড়ির কাজের মাসি থেকে শুরু করে তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রের সফটওয়্যার ডেভলপার, সবার গন্তব্য একটাই— ই-শ্রম পোর্টাল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন