Corona

করোনাসঙ্কটে বিধ্বস্ত ব্রিটেন

অতীতের অন্যান্য মহামারি, বিশ্বযুদ্ধকালের মৃত্যুসংখ্যাকেও করোনা অনেকটা অতিক্রম করে গিয়েছে।

Advertisement

নবকুমার বসু

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:০৬
Share:

পৃথিবীর মধ্যে করোনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু যে আমেরিকায় নয়, ব্রিটেনেই— তা এখন প্রমাণিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) সম্প্রতি জানিয়েছে, ব্রিটেনের প্রায় ৬.৫ কোটি জনসংখ্যায় ১,০৪,০০০ মৃত্যুই (জানুয়ারির শেষে) একটি দেশে করোনার রেকর্ড। আমেরিকা-ভারত-রাশিয়া এবং ব্রাজিলে করোনাক্রান্তের মৃত্যুসংখ্যা আরও বেশি হলেও, এই সব দেশের জনসংখ্যা ব্রিটেনের চেয়ে অনেক বেশি। এই বিপুল সংখ্যক মৃত্যু এবং তার আগে দিনে হাজার হাজার মানুষের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় ব্রিটেনের স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে। অন্যান্য বিষয় নাহয় বাদই থাক। এই দেশটির স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিন্যাস এবং পরিষেবাও কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় উন্নত, সুপরিকল্পিত এবং আধুনিক।

Advertisement

ব্রিটেনের স্বাস্থ্য দফতর তথা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) দশ দিন আগের হিসেব অনুযায়ী, প্রতি ৩০ সেকেন্ডে দেশের কোনও না কোনও হাসপাতালে এক জন কোভিড-আক্রান্ত ভর্তি হচ্ছিলেন। দিনে আক্রান্তই হচ্ছিলেন পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার। দ্রুত টিকাকরণের মাধ্যমে বর্তমানে সেই সংখ্যা নিম্নমুখী, তবু এখনও দৈনিক মৃত্যু ১২০০-১৫০০-র কাছে। ব্রিটেনের মতো ছোট্ট দেশে এই পরিসংখ্যান অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি! অতীতের অন্যান্য মহামারি, বিশ্বযুদ্ধকালের মৃত্যুসংখ্যাকেও করোনা অনেকটা অতিক্রম করে গিয়েছে।

রানির দেশে করোনায় মৃত্যুসংখ্যার এই ঊর্ধ্বগতির কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ দর্শানো হয়েছে। গোড়ার দিকে প্রশাসনিক দুর্বলতা আর ঢিলেঢালা সামাজিক নীতিকে দুষেছেন কেউ কেউ। লকডাউন, দূরত্ব রক্ষা, বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি পালন, স্কুল-কলেজ এবং দোকানপাট, বার-রেস্তরাঁ ইত্যাদি খোলা এবং বন্ধ রাখা নিয়ে প্রশাসন কঠোর হলেও, ঠান্ডা পড়ার আগে কিছু ছাড়ে গাফিলতির পরিচয় মিলেছিল। তখন মনে রাখা উচিত ছিল, এ দেশের শীতের স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া ও বৃষ্টিতে, রোদবিহীন সংক্ষিপ্ত দিনে মানুষ শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত অসুখে বেশি ভোগেন। তায় তখনও ভ্যাকসিন ছিল না। ফলে করোনার প্রকোপে ‘গোদের উপর বিষফোড়া’র মতো ধাক্কা আসতে পারে। সম্ভবত তাকেই ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ বলা হয়েছিল।

Advertisement

অনেকের মত, নিয়মনিষ্ঠ, পরিচ্ছন্ন এবং অপেক্ষাকৃত দূষণহীন ব্রিটেনে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বা ইমিউনিটি কম বলেই করোনা শক্তিশালী। মানুষের সাদা, কালো বা মিশ্র বর্ণ নিয়েও কথা উঠেছে। কিন্তু আবহাওয়া, অর্থনৈতিক অবস্থা, প্রতিরোধ ক্ষমতা, না কি বর্ণ— করোনার প্রাদুর্ভাবের মূলে যে কী, কেউই ঠিক জানে না। ভাইরাসের নতুন স্ট্রেন বা চরিত্রগত কাঠামোর বিবর্তন ব্রিটেন এবং কয়েকটি দেশে সমস্যা এনেছে। সব মিলিয়ে পৃথিবীর ছোট, অথচ গুরুত্বপূর্ণ দেশটির আর্থসামাজিক ক্ষেত্র ছাড়াও, স্বাস্থ্য দফতরটির অবস্থা শোচনীয়। অথচ, এই যুগে ব্রিটেনের এনএইচএস-এর মতো উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা মেলা ভার!

ব্রিটেনের নাগরিকদের যাবতীয় চিকিৎসার দায়িত্ব সরকারের। কোনও চিকিৎসার জন্য প্রত্যক্ষ ভাবে টাকাপয়সা লেনদেনের নিয়ম নেই। সাধারণ চিকিৎসকেরা (জিপি) এনএইচএস-এর মূল স্তম্ভ। নাগরিকদের কোনও জিপি-র কাছে নাম নথিভুক্ত করাতে হয়। অসুস্থতার সময় প্রথমে তাঁর কাছে যেতে হয়। জিপি’রাই প্রয়োজনবোধে রোগীদের হাসপাতাল, তথা বিশেষজ্ঞদের কাছে রেফার করেন। এই পদ্ধতিতে হাসপাতালের দ্বারস্থ না হয়েই ৮০%-এরও বেশি অসুখ সেরে যায়। দেশের সকলের চিকিৎসার মান এক। করোনাবিধ্বস্ত হওয়ার আগেই দেশে ১২৫০টি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল ছিল। এখনও আছে। এনএইচএস-এর কর্মী ১০,৯০,০০০। চিকিৎসক ১,২০,০০০। নার্স প্রায় ৩.৫ লক্ষ। দেশে প্রায় ৯,৫০০ জিপি-সার্জারি বা ডাক্তারের চেম্বার।

করোনার তাণ্ডব এখানে এতটাই যে, এই সুবিন্যস্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থাও ধরাশায়ী। এই মুহূর্তে শুধু হাসপাতালেই করোনা রোগী ভর্তির সংখ্যা ৩২,০০০। কিছু দিন আগেও তা ছিল ৬০,০০০-এর আশেপাশে। এই বিপুল সংখ্যক রোগীর জরুরি চিকিৎসার জন্য বহু নিয়মিত চিকিৎসা ব্যাহত। যেমন, কিডনি-হার্ট-লিভার বা ক্যানসারের ফলো আপ, জরুরি অপারেশন, প্রতিস্থাপন, নিউরো সার্জারি, ইউরোলজি, চোখের অপারেশন, জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট— প্রায় সব বন্ধ। হাসপাতালের অধিকাংশ বেড কোভিডের দখলে। ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের ধরে এখন মৃত্যুসংখ্যা দিনে হাজারের উপর। হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুল্যান্সের লাইন। দেশের বিভিন্ন শহরে অস্থায়ী এসি মর্গ তৈরি করতে হয়েছে মৃতদেহ সম্মানজনক অবস্থায় রাখতে।

এখনও দেশে জরুরি ভিত্তিতে লকডাউন চলেছে। ছোট হলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্রিটেন আজও গুরুত্বপূর্ণ। দৃষ্টান্তমূলক দ্রুততায় এখানে টিকা প্রদান শুরু হয়েছে (সপ্তাহে কুড়ি লক্ষ)। অক্সফোর্ড আবিষ্কৃত টিকাও সারা পৃথিবীতে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। কিন্তু এই বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি আর স্বাস্থ্য দফতরের উপর প্রবল চাপ কবে যে রানির দেশ কাটিয়ে উঠবে, তা বলা খুব মুশকিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন