Buddha Jayanti & Dharma Thakur

বৌদ্ধ দেবতাকে আত্মসাৎ করা হিন্দুরা এ বার ধর্মঠাকুরের নামে বুদ্ধকে আড়াল করতে চাইছেন!

বৌদ্ধ দেবতাকে ধর্মঠাকুরে রূপদান করে, বিবিধ পৌরাণিক উপন্যাসের আখ্যানে নিমজ্জিত করে, ধীরে ধীরে হিন্দু দেবতায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। বৌদ্ধ দেবতার আত্মীকরণ সম্পন্ন হয়েছে এই ভাবেই।

Advertisement

অরুণজ্যোতি ভিক্ষু

শেষ আপডেট: ০২ মে ২০২৩ ০৭:১৭
Share:

ধর্মঠাকুরের কথা বিজয় সেনের ষষ্ঠ শতকের এক তাম্প্রপত্রানুশাসন থেকে প্রথম জানা যায়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি

Advertisement

ধম্মং শরণং গচ্ছামি

সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি

Advertisement

বুদ্ধ, ধর্ম এবং সঙ্ঘ— এই ত্রিরত্নের আশ্রয়ই ত্রিশরণ। ২৫৬৭ বছর আগে তথাগত গৌতম বুদ্ধের আগমন এই মহাভারতে। রাজকুমার সিদ্ধার্থ রূপে বুদ্ধের আবির্ভাব ৫৬৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের বৈশাখী পূর্ণিমাতে বর্তমান নেপালের লুম্বিনী উদ্যানে। আশ্চর্যের বিষয় যে, ২৯ বছর বয়সে সংসার ত্যাগের পর ৬ বছর কঠোর তপস্যার শেষে, ৩৫ বছর বয়সে গয়ার নৈরঞ্জনা নদীর তীরে বোধিবৃক্ষতলে বুদ্ধত্বজ্ঞান লাভ করে জগতে তিনি বুদ্ধরূপে আবির্ভূত হলেন আর এক বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতেই।

প্রথম ধর্মপ্রচার (বৌদ্ধ পরিভাষায় ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র) করেন বারাণসীর অদূরে সারনাথের মৃগবনে, তাঁর ৫ জন সহচর ধ্যানী সহযোগীর কাছে। ত্রিপিটকের সূত্র পিটানুসারে অরিয় পরিয়সেনা সূত্রে তাঁদের পঞ্চবর্গীয় শিষ্য রূপে অভিহিত করা হয়েছে। বুদ্ধের দ্বারা প্রথম দীক্ষিত এই পাঁচ জন শিষ্য হলেন— বপ্প, ভদ্দিয়, মহানাম, অশ্বজিৎ ও কৌণ্ডণ্য। প্রথম ধর্মপ্রচারেই বুদ্ধ ভিক্ষুসঙ্ঘে মধ্যমপন্থার নির্দেশ দিয়েছিলেন। চারি আর্যসত্য— দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ নিরোধ, দুঃখের নিরোধের উপায় রূপে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের পথনির্দেশ করেন। সেই আট মার্গ হল— সৎ দৃষ্টি, সৎ সংকল্প বা ভাবনা, সৎ বাক্য, সৎ কর্ম, সৎ জীবিকা, সৎ প্রচেষ্টা, সৎ স্মৃতি এবং সৎ সমাধি। এই মার্গে অবিচলিত সাধকগণ নির্বাণ বা দুঃখমুক্তি লাভ করতে পারেন।

গৌতম বুদ্ধ স্বয়ং ৮০ বছর বয়সে মহাপরিনির্বাণ বা দেহত্যাগ করেছিলেন কুশিনগরের যমক শাল বৃক্ষতলে অপর এক বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে। মানবপুত্র বুদ্ধের জন্ম, সিদ্ধিলাভ ও দেহত্যাগের ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত বৈশাখী পূর্ণিমা পরবর্তী কালে বুদ্ধপূর্ণিমা বা বুদ্ধজয়ন্তী রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পরে বৌদ্ধধর্ম হীনযান বা থেরবাদ, মহাযান বা আধুনিক মতবাদে ভাগ হয়ে পড়ে। মহাযান বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমে বিভিন্ন দেবদেবীর আরাধনা শুরু হয়। মূলত খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মহান সম্রাট অশোক, পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধ সম্রাট কণিষ্ক থেকে অষ্টম শতাব্দীর পালযুগে বৌদ্ধধর্মে দেবদেবীর আরাধনার সঙ্গে ভগবান বুদ্ধেরও বিভিন্ন নাম এবং বিশেষণে পূজানুষ্ঠান চলতে থাকে।

ধর্মঠাকুরের কথা বিজয় সেনের ষষ্ঠ শতকের এক তাম্প্রপত্রানুশাসন থেকে প্রথম জানা যায়। যেখানে প্রথমেই তাঁকে বন্দনা করা হয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, তিনিই ছিলেন বৌদ্ধ দেবতা লোকনাথ, ত্রিলোকনাথ। তিনিই ধর্ম। এ ছাড়াও একটি শীল ও বৌদ্ধ ধর্মচক্রের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়েছে যে, এটি ছিল অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি। মূর্তি যখন শীল রূপে ব্যবহৃত হল, তখন তার প্রভাব ও প্রতিপত্তিও হল সুদূরপ্রসারী। ধর্মঠাকুরের প্রধান পীঠস্থান ছিল বর্ধমান জেলা এবং বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

চর্যাপদ আবিষ্কারক মহাপণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও ধর্মঠাকুরকে বৌদ্ধ দেবতা রূপেই উল্লেখ করেছেন। বুদ্ধপূর্ণিমায় ধর্মপূজা এবং বুদ্ধদেবের অন্যতম নাম ধর্মরাজ, মূলত এই দু’টি তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। ধর্মপূজা যে বৌদ্ধ সম্প্রদায়েরই, তার অগণিত প্রমাণ রাঢ় তথা পশ্চিম বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে। পরবর্তী কালে বৌদ্ধ ধর্মকে অপসারণের উদ্দেশ্য নিয়ে বৌদ্ধ দেবতাকে ধর্মঠাকুরে রূপদান করে বিবিধ পৌরাণিক উপন্যাসের আখ্যানে নিমজ্জিত করে, ধীরে ধীরে হিন্দু দেবতায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। কার্যত বৌদ্ধ দেবতাকে আত্মসাৎ করা হয়েছে এই ভাবেই। যার এখনও নানান প্রমাণ পাওয়া যায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে শুরু করে বর্তমান ভারতের বিভিন্ন বৌদ্ধ মহাতীর্থস্থান পর্যবেক্ষণে।

প্রতি বছরের মতো এ বারও পশ্চিমবঙ্গের ‘ইউনাইটেড বুদ্ধিস্ট ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন’ এবং সম্মিলিত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনুসারীরা মধ্য কলকাতায় বহু মানুষের জমায়েতে ২৫৬৭তম বুদ্ধপূর্ণিমা উৎসবে শামিল হবেন। পবিত্র এই দিনে সারা বিশ্বে ঘটমান হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, যুদ্ধের আবহে মানুষের হৃদয়ে শান্তির বাণী প্রচার করা হয়। শান্তির লক্ষ্যেই সাম্য, মৈত্রী, করুণার প্রতিমূর্তি তথাগত বুদ্ধের অমৃত বচন প্রদান করা হয়ে থাকে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ সারা বিশ্বের মানুষের জন্য প্রতি দিনই সুখী হওয়ার প্রার্থনায় নিবেদিত থাকেন। ‘‘সব্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু’’ (বিশ্বের সকল প্রাণী সুখী হোক)— এই মহামন্ত্রে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সকাল, সন্ধ্যার প্রার্থনায় রত হন।

ঐতিহ্য অনুযায়ী, ভগবান বুদ্ধের ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত এই স্মরণীয় দিন নিয়ে আলোকপাত করে ধর্মীয় বিধি পালন করা হয়। সাধুবাদের ধ্বনিতে অনুমোদিত হয় প্রতিটি বুদ্ধ বচন। শান্তির পূজারি বৌদ্ধ সম্প্রদায় সততই শান্তির গানে মুখরিত হয়ে ওঠেন। স্বাভাবিক ভাবেই বুদ্ধ পূর্ণিমার ভাবনায় মৈত্রী ভাব প্রাধান্য লাভ করে থাকে।

বুদ্ধ পূর্ণিমার এই বিশেষ দিনে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দু’টি ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় কর্মসূচি রয়েছে ধর্মতলার রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ এবং মেয়ো রোডে। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষণীয় এই যে, একই দিনে এই বছরে প্রথম বার সনাতন ধর্মের প্রবক্তারা মেয়ো রোডে ধর্মপূজার মহা আয়োজনে শামিল হয়েছেন। ধর্মঠাকুরের আবডালে বুদ্ধকে নিমজ্জিত করে রাখার নির্লজ্জ প্রয়াস আবারও শুরু হয়েছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ ধর্মপূজার এই আয়োজনে চিন্তান্বিত এবং শঙ্কিতও বটে।

বৌদ্ধ ধর্মের মানুষ ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ মতে বিশ্বাসী। সততই শান্তি ও মঙ্গল মৈত্রী পরায়ণ। তাঁরা আশাবাদী, কোনও প্রকার তিক্ততা ছাড়া মহান বুদ্ধপূর্ণিমা অনুষ্ঠান স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠবে। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি বুদ্ধপূর্ণিমার মৈত্রীস্নাত শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

(লেখক টালিগঞ্জ সম্বোধি বুদ্ধ বিহারের পরিচালক এবং ২৫৬৭তম বুদ্ধপূর্ণিমা উৎসবের প্রধান আহ্বায়ক। মতামত নিজস্ব।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন