Mughal Empire

রাম ও রহিমের ইতিহাস

রহিম ছিলেন আকবরের সভার নবরত্নের অন্যতম রত্ন। তাঁর আর একটি বড় পরিচয়, বৈরাম খাঁ-র পুত্র।

Advertisement

সীমান্ত গুহঠাকুরতা

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৭:৪৮
Share:

গহি সরনাগতি রাম কী, ভবসাগর কী নাও।/ ‘রহিমন’ জগত-উধার কো, ঔর ন কছু উপায়।।”— এই দোঁহাটি যখন লেখা হচ্ছে, তখন দিল্লির তখতে বাদশা আকবর। লিখেছেন এক মুসলিম কবি, নাম আবদুর রহিম খান-ই-খানান, সংক্ষেপে রহিম। শোনা যায়, কবি রহিম খুবই দানশীল ছিলেন। তাঁর এক অদ্ভুত অভ্যাস ছিল— যখন কাউকে দান করতেন, তাঁর দিকে তাকাতেন না, দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখতেন অন্য দিকে। রহিমের প্রিয় বন্ধু ও অনুরাগী কবি তুলসীদাসও এই স্বভাবের কথা জানতে পেরে কৌতূহলী হয়ে দু’লাইনে একটি দোঁহা লিখে তাঁকে পাঠান— “ঐসী দেনী দেন জু/ কিত সীখে হো সেন।/ জ্যোঁ জ্যোঁ কর ঊঁচৌ করৌ/ ত্যোঁ ত্যোঁ নীচে নৈন।।” বাংলায় অর্থ, আপনি এই ভাবে দান করেন কেন? কোথা থেকেই বা শিখলেন? আপনার হাত ততখানিই উঁচু যতখানি নিচু আপনার চোখ। কবির ভাষাতেই রহিমের উত্তর: “দেনহার কোউ ঔর হৈ, ভেজত সো দিন রৈন।/ লোগ ভরম হম পৈ ধরৈঁ, য়াতে নীতে নৈন।।” অর্থভেদ নিষ্প্রয়োজন।

Advertisement

রহিম ছিলেন আকবরের সভার নবরত্নের অন্যতম রত্ন। তাঁর আর একটি বড় পরিচয়, বৈরাম খাঁ-র পুত্র। সেই বৈরাম খাঁ, যিনি বালক আকবরের রক্ষক ও অভিভাবক ছিলেন। তাঁর পুত্র রহিমও তাঁর মতোই যোদ্ধা ছিলেন, একাধিক যুদ্ধে আকবরের সেনাপতিত্বও করেছেন। কিন্তু মোগল রাজপুরুষ ও যোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন মরমিয়া কবি। হিন্দি কবিতাজগতে রহিমকে নিয়ে চর্চা কমই হয়েছে। তবে তুলসীদাস বা কবীরের মতো তাঁর কবিতা হিন্দি বলয়ের (বিহার ও উত্তরপ্রদেশের) খেটে-খাওয়া গরিব মানুষের মুখে মুখে ফেরে আজও।

রহিমের লেখা প্রায় ৪০০ দোঁহার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তার মধ্যে ৬১টি বেছে নিয়ে সম্প্রতি বাংলায় একটি অনুবাদ-সঙ্কলন প্রকাশ করেছেন কুমার রাণা। বইটির নামও রহিমের একটি দোঁহা থেকেই, মোমের ঘোড়ায় সওয়ার। ভূমিকা থেকে জানা গেল এক অদ্ভুত সমাপতনের কথা। রহিমের জন্ম ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে, সে বছরই আকবর সিংহাসনে বসেন; পরে আকবর ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ নামের যে ক্যালেন্ডার চালু করেন, তাতে শূন্য বছর ধরা হয়েছিল ওই ১৫৫৬ সালকে। সেই শূন্য বৎসর মিলিয়েই তৈরি হয়েছিল আমাদের বাংলা ক্যালেন্ডার— বঙ্গাব্দ।

Advertisement

একটু ভুল হল। এটা ঠিক ‘সমাপতন’ নয়। ইদানীং কথায় কথায় সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতির জিগির তোলা হয়। কিন্তু এটাই হল সেই সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতি, যেখানে বহু ধর্মের ও সংস্কৃতির অজস্র ধারা এসে মিশে তৈরি করেছে একটি সভ্যতা। সেখানে অনায়াসে ইসলাম ধর্মাবলম্বী এক জন কবি তাঁর কবিতায় রামচন্দ্রের ধ্যান করেন, সেখানে হিন্দুদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যের অনুবাদক বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকেন এক মুসলিম কবির সঙ্গে। আমরা ক’জন খোঁজ রাখি যে, সম্রাট শাহজাহানের জ্যেষ্ঠপুত্র দারাশুকো উপনিষদ অনুবাদের পৃষ্ঠপোষণা করেছিলেন, এবং নিজে অনুবাদ করেছিলেন গীতা, রামায়ণ ও যোগবশিষ্ঠ। আমরা হয়তো এ-ও জানি না যে, আকবরের রাজপ্রাসাদের ইবাদতখানায় সব ধর্মের মানুষকেই যোগ দেওয়ার জন্য ডেকে নেওয়া হত। হিন্দুধর্ম বইয়ে ক্ষিতিমোহন সেন লিখছেন, “তথাকথিত আর্য-আক্রমণের পূর্বেকার দ্রাবিড় সংস্কৃতি, অদ্রাবিড়ীয় জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, যথার্থ সংস্কৃতায়িত আর্য সংস্কৃতি, আরও পরবর্তীকালে আক্রমণকারীদের সংস্কৃতি, (হিন্দুধর্ম থেকে জন্ম নেওয়া) বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ধর্ম এবং বাইরের থেকে আসা ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম— হিন্দুধর্মের বিবর্তনের নানা ধাপ হিসেবে এ সমস্তই অনুসন্ধানের বিষয়।” যাঁরা ভারত ও হিন্দু ধর্মকে সমার্থক করে দেখেন, তাঁরা আমাদের সভ্যতার এই সমন্বয়ী চরিত্রটির কথা মাথায় রাখেন না, অথবা সচেতন ভাবেই এড়িয়ে যান। সুলতানি বা মোগল আমলের আরও অনেক ইসলাম ধর্মাবলম্বী কবির মতোই রহিমও আরবি-ফারসির পাশে সংস্কৃত ভাষাতেও পণ্ডিত ছিলেন, হিন্দু শাস্ত্রেও। একটি দোঁহায় তিনি লিখছেন, “রহিমন পর উপকার কে করত ন য়ারী বীচ/ মাঁস দিয়ো শিবি ভূপ নে দীন্‌হোঁ হাড় দধীচ”। কুমার রাণা এর অনুবাদ করেছেন, “পরোপকারের ব্রত যে নিয়েছে, মাঝপথে নেই ছাড়।/ শিবি রাজা দেন গায়ের মাংস দধিচী দিলেন হাড়।” পুরাণ, শাস্ত্রাদিতে দখল না থাকলে এমন উপমা ব্যবহার সম্ভবই নয়।

এখন কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের নির্দেশে নতুন করে লেখা হচ্ছে ইতিহাসের পাঠ্যবই, তাতে মোগল যুগের ইতিবাচক দিকগুলিকে সযত্নে মুছে দিয়ে মোগল সম্রাটদের শুধুমাত্র বহিরাগত আক্রমণকারী হিসাবে চিহ্নিত করে নতুন ইতিহাস ‘তৈরি’ হচ্ছে। কিন্তু এই ভাবে কি রহিমের মতো কবিকে, এবং ভারতীয় সংস্কৃতিতে তাঁর অবদানকে মুছে দেওয়া সম্ভব? ভারতের মুসলিম শাসনপর্বের সাংস্কৃতিক অবদানকে অস্বীকার করা সম্ভব? রহিম, তুলসীদাস, সুরদাস, কবীর, দাদূ, মীরাবাইকে মুছে দেওয়া সম্ভব? এঁরা তো কেবল অতীত নন, এক বহমান লোকায়ত সংস্কৃতির অঙ্গ, যা শুধু ‘ইতিহাস’ নয়, প্রবল ভাবে ‘বর্তমান’। বর্তমানকেও কি তবে এ ভাবে মুছে দেওয়া যায়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন