পরিবর্তন নানা রকম বদলের নাম! মত বদল, সরকার বদল, দল বদল, ভোল বদল আরও কত কী! প্রথমে মত পরিবর্তনের কথায় আসা যাক। সব সময় অহিংস প্রথায় মত বদল হয় না। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় একটি হাসির গানে মত পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করেছিলেন: “প্রথম যখন ছিলাম কোন ধর্মে অনাসক্ত/ খ্রীষ্টীয় এক নারীর প্রতি হলাম অনুরক্ত/ বিশ্বাস হল খ্রীষ্টধর্মে, ভজতে যাচ্ছি খ্রীষ্টে/ এমন সময় দিলেন পিতা পদাঘাত এক পৃষ্ঠে!/ ছেড়ে দিলাম পথটা, বদলে গেল মতটা,/ অমন অবস্থায় পড়লে সবারই মত বদলায়।”
সে কালে ‘লাভ ক্রুসেড’ বা ‘লাভ জেহাদ’ ধরনের ইতর শব্দবন্ধ কেউ ব্যবহার করতেন না! কিন্তু ধর্ম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আপত্তি পুরোমাত্রায় ছিল। এবং এই গানের কলি আমাদের বলে দিচ্ছে যে, পরিবর্তন প্রতিরোধের পদ্ধতি আদৌ অহিংস গাঁধীবাদী ছিল না!
যুগে যুগে গণবিপ্লব রাজনৈতিক পরিবর্তন এনেছে। মহাচিনের নেতা মাও জে দং বিপ্লব ব্যাপারটা সুন্দর বুঝিয়েছিলেন! গেছোদাদা কোথায় আছেন জানতে হলে যেমন বুঝতে হবে গেছোদাদা কোথায় কোথায় নেই, বিপ্লবের চরিত্র বুঝতে গেলে জানতে হবে কী কী বস্তু বিপ্লব নয়: “বিপ্লব একটি নৈশ ভোজসভা কিংবা নিবন্ধ রচনা নয়। বিপ্লব কোনও চিত্রশিল্প বা সূক্ষ্ম সূচিকর্ম নয়! বিপ্লব সুমার্জিত, ধীর-স্থির, সুললিত, বিনম্র, দয়ালু, সংযত, বিনীত আর উদার হতে পারে না। বিপ্লব একটি অভ্যুত্থান, যার দ্বারা একটি শ্রেণি বলপূর্বক অন্য শ্রেণিকে উৎখাত করে।” (সিলেক্টেড ওয়ার্কস, প্রথম খণ্ড)
চিন-বিপ্লবে রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক সংস্কার আসে অনেক পরে দেং জিয়াও পিং-এর নেতৃত্বে। দেং তাত্ত্বিক ভাবাদর্শ বিসর্জন দিয়ে বলেছিলেন: আমার জানার দরকার নেই বিড়ালের রং সাদা না কালো, ইঁদুর ধরতে পারলেই হল। তাঁর আমলে শুরু হয় বিশ্বায়ন এবং বাজার অর্থনীতির আরাধনা। সেই ব্যাপক রূপান্তরের ফলে চিন আজ গোটা বিশ্বের কারখানা। আমেরিকানরা বলেন, ঈশ্বর পৃথিবীটা বানিয়েছিলেন, আর সব কিছু বানায় চিন।
চিনের থেকে ভারত বা আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের মতো গণতান্ত্রিক দেশে শান্তিপূর্ণ ভাবে, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয়। প্রশ্ন হল: পরিবর্তন হলেই কি সুদিন আসে? পরিবর্তন কি সব সময় ভাল? ভাল থেকে খারাপ হয়ে যাওয়াও তো পরিবর্তন! আবার অনেক সময় পরিবর্তন হয় নামমাত্র। আকারে পরিবর্তন কিন্তু প্রকারে নয়। ফরাসিদের একটি সুন্দর বাগ্ধারা আছে: যতই বদলায়, ততই অপরিবর্তিত থাকে। আমরাও সরকার পরিবর্তন সম্পর্কে বলে থাকি: যে যায় লঙ্কায় সে-ই হয় রাবণ! অনেক পরিবর্তনের দাঁত থাকে না, যাকে আমরা বলি ফোকলা পরিবর্তন। শুধু পরিবর্তনের জন্য পরিবর্তন করে কী লাভ? আসল পরিবর্তন কী? পরিবর্তনের বিকল্প হল রূপান্তর।
দু’টি ক্ষেত্রে পরিবর্তন আর রূপান্তরের পার্থক্য আলোচনা করা যাক: একটি শিক্ষা, অন্যটি শিল্প।
শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন আর রূপান্তরের তফাত কী? যদি আমরা মনে করি শিক্ষার স্পর্শনসাধ্য পরিকাঠামোর উন্নতি করব, তা হলে সেটা অপেক্ষাকৃত সহজ কাজ। আমরা বিদ্যায়তনগুলির সংস্কার করব, ঝাঁ-চকচকে রং করব, চোখ-ধাঁধানো প্রেক্ষাগৃহ গড়ব এবং এই সব করতে আমাদের টাকা খরচ করতে হবে এবং কিছু সময় লাগবে! শক্ত পরিকাঠামোর সংস্কার অপেক্ষাকৃত সহজসাধ্য। আমাদের বিষয়সূচি যদি শক্ত এবং স্পর্শনযোগ্য পরিকাঠামো হয়, তা হলে পরিবর্তনের ঢেউ দিয়েই করা যাবে। শুধু সদিচ্ছা আর কোষাগারে টাকা থাকলেই হবে।
কিন্তু শিক্ষার কোমল পরিকাঠামো ? শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের এবং নেতাদের মৌরসিপাট্টার অচলায়তন ভাঙা সহজসাধ্য নয়!
আমাদের রাজ্যে সেই যাত্রার নাম ছিল অনিলায়ন! সেই পথের পথিক এখন সব রাজনৈতিক দল। যাদবপুর থেকে আলিগড়, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চণ্ডীগড়, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাস্টারমশাইরা বুঝে গিয়েছেন খেলার নিয়ম। সিঁড়ি কোনটা, লিফট কোনটা, তাঁরা চিনে গিয়েছেন। শাসক গোষ্ঠীর ভজনা করলে উন্নতি আর বিরোধিতা করলে শাস্তি। মানুষ গড়ার কারিগরদের অনেকেই রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত, পড়াশুনা শিকেয় উঠেছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সরকার বদল হলেও, এস ওয়াজেদ আলির ভাষায়, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। অতএব শিক্ষাক্ষেত্রে রূপান্তর প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। শিক্ষক ও অধ্যাপক নিয়োগের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, মেধাভিত্তিক করতে হবে। কোমল পরিকাঠামোর খোলনলচে বদলে রূপান্তর ঘটাতে হবে।
এ বার শিল্পে আসা যাক। আমাদের রাজ্যের একটি ব্যাপক সমস্যা হল কর্মহীনতা। যদি দ্রুত শিল্পায়ন না হয়, তা হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। কিন্তু সরকার পরিবর্তন হলেই কি হইহই করে শিল্প এবং বিনিয়োগ আসবে? বিশ্ববাণিজ্যে একটি শ্রুতিকথা চালু আছে: ব্যবসা করার স্বাচ্ছন্দ্য নাকি অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাঙ্ক তাই একটি তুলনামূলক সূচক প্রকাশ করে: কোন দেশে ব্যবসা করা সব থেকে সহজ। কিন্তু শুধু ব্যবসা করার স্বাচ্ছন্দ্য কি পুঁজিকে টানে? শুধু লাল ফিতের ফাঁসের জন্যই কি ব্যবসা আসে না? সব আমলাতান্ত্রিক জট ছাড়ালেই কি পুঁজির প্লাবন আসবে? তা হলে তো সমস্ত আইনি প্রতিবন্ধন শিথিল করলে সোমালিয়া হয়ে যাবে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের রাজধানী! পিছিয়ে পড়বে ভারতবর্ষ আর আমেরিকা। তা কোনও মতেই হবে না, কারণ সোমালিয়াতে দক্ষ এবং মেধাবী তথ্যপ্রযুক্তি কুশলী নেই। আইনের জাল শিথিল করলেই কারখানা এবং ভারী শিল্প চিন এবং ভারত ছেড়ে ভেনেজ়ুয়েলা কিংবা বুরুন্ডিতে যাবে না, কারণ সেখানে না আছে বাজার, না আছে দক্ষ শ্রমিক। আইন সহজ হলে লগ্নিকারীরা উৎসাহিত হন, কিন্তু তাঁদের পাখির চোখ হল বাজারের আয়তন এবং মুনাফার সুযোগ।
হার্ভার্ডের বিখ্যাত অধ্যাপক মাইকেল পোর্টার পড়াতে গিয়ে একটি সুন্দর উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, শিল্পায়নের প্রেক্ষিতে রূপান্তর কী। উনি বলেছিলেন, ধরা যাক তৃতীয় বিশ্বের একটি কাল্পনিক দেশে একটি অপূর্ব হোটেল নির্মাণ করা হল। সারা বিশ্ব থেকে খুঁজে খুঁজে শেফ এবং বাবুর্চি নিয়োগ হল! হোটেল পরিচালনার ভার দেওয়া হল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি সংস্থাকে। হোটেলটি সমস্ত মাপকাঠিতে হয়ে উঠল বিশ্বের একটি শ্রেষ্ঠ পাঁচতারা হোটেল। হোটেলের দরজা খুলল। অতিথিরা বিজ্ঞাপন আর হোটেলের আলোকচিত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে ইউরোপ এবং আমেরিকা থেকে দলে দলে আসতে শুরু করলেন। এ বার গল্পের মোড় বদলালো। তাঁরা বিমানবন্দরে দেখলেন শুল্ক এবং অভিবাসন কর্মচারীরা দুর্ব্যবহার করছেন এবং ঘুষের হাত পেতে দিয়েছেন। রাস্তাঘাটের অবস্থা বেহাল, খানাখন্দে পড়ে কয়েক জন অতিথির গাড়ি বিকল হল। গাড়ি ঘিরে স্থানীয় মস্তানরা চাঁদার জুলুম জুড়ে দিল। হোটেলে ঢুকে তাঁরা দেখলেন মোবাইল ফোন বিকল এবং ইন্টারনেট অনুপস্থিত। হোটেল কর্তৃপক্ষ অপারগ, কারণ মোবাইল ফোন চালায় (কিংবা চালায় না) একটি সরকারি সংস্থা। ক্রেডিট কার্ড চলল না, কারণ নেটওয়ার্ক নেই।
অতিথিরা পেলেন অপূর্ব খানাপিনা। তাঁরা দেখলেন, পাঁচতারা হোটেলের আতিথেয়তার কোনও ত্রুটি নেই। কিন্তু কিছু দিন বাদেই অতিথি আসা কমে গেল। তার পর হোটেলটিও বন্ধ হয়ে গেল। পোর্টার বলেছিলেন, একটি সংস্থা বিচ্ছিন্ন ভাবে সর্বাঙ্গসুন্দর হতে পারে, কিন্তু সফল হতে গেলে তার পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলের সাহায্য পেতে হবে। অতিথিদের সার্বিক ক্রেতা-অভিজ্ঞতা যদি নেতিবাচক হয়, তা হলে সেই সংস্থা প্রতিযোগিতার বাজারে টিকবে না! যাঁরা শিল্পে লগ্নি করেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও একই মানদণ্ড প্রযোজ্য।
পরিবর্তন স্রেফ রদবদল। রূপান্তর শুধু ভোল পাল্টানো নয়, মৌলিক বিবর্তন।
সাপের দেহ যত বৃদ্ধি পায়, তাদের ত্বক ছোট হতে থাকে। সাপকে সাধারণত প্রতি তিন মাস অন্তর খোলস পরিবর্তন করতে হয়। খোলস পরিবর্তিত হওয়ার পর সাপ অধিকতর মসৃণ ও উজ্জ্বল হয়। সেই সময় সাপকে অনেক পরিষ্কার ও আকর্ষক মনে হয়। এই পরিবর্তন পোশাক-বদলের মতো। কিন্তু শুঁয়োপোকার জীবন কী ভাবে রূপান্তরিত হয়? খোলস ছেড়ে সে যখন বেরিয়ে আসে, তখন সে হয়ে যায় একটি অনিন্দ্যসুন্দর বর্ণময়, প্রজাপতি। সেই প্রক্রিয়াটি হল রূপান্তর!