China

জনসংখ্যা নিয়ে যুক্তিহীন নীতি

জোর করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার নীতি যুক্তিহীন।

Advertisement

শুভনীল চৌধুরী এবং শাশ্বত ঘোষ

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২১ ০৪:৩৮
Share:

জনসংখ্যা বৃদ্ধি, উন্নয়ন ও আর্থিক বৃদ্ধির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে যা বেশ জটিল। কিন্তু জনসাধারণের মনে একটি ভুল ধারণা প্রোথিত করা হয়েছে যে, জোর করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা উন্নয়নের জন্য আবশ্যিক। এই ‘কমন সেন্স’-টি যে ভ্রান্ত, তা প্রমাণিত হল চিনের অভিজ্ঞতায়। মে মাসে চিনের জনগণনা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে, ২০২০ সালের শেষে চিনের মোট জনসংখ্যা ১৪১ কোটি, যা এক দশকে বেড়েছে মাত্র ৫.৪ শতাংশ।

Advertisement

চিনের ‘ফার্টিলিটি রেট’ বা প্রতি মহিলার গড় সন্তান প্রসবের সংখ্যা মাত্র ১.৩। যেহেতু এক পুরুষ এবং এক নারীর মিলনে একটি শিশু জন্মায়, অতএব জনসংখ্যাকে স্থিতিশীল রাখতে অন্তত ২.১ ফার্টিলিটি রেট হওয়া উচিত। চিনে এই সংখ্যা এখন ন্যূনতম হারের নীচে চলে গিয়েছে। অন্য দিকে বেড়েছে বৃদ্ধদের সংখ্যা। এক দশক আগের তুলনায় চিনে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের সংখ্যা বেড়েছে ৮ কোটি। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য বলছে যে, কর্মরত বয়সের ব্যক্তিদের অনুপাত (১৫-৬৪ বছর) চিনে ২০১০ সাল থেকে কমছে। ২০১০ সালে এই অনুপাত ছিল ৭৩.৩ শতাংশ যা ২০১৯ সালে কমে হয়েছে ৭০.৭ শতাংশ। এই অনুপাত নিম্নগামী হলে অর্থব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দেয়, কারণ পর্যাপ্ত পরিমাণ শ্রমিকের জোগান কমতে থাকে। এমতাবস্থায় প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ানো যেতে পারে, কিন্তু জাপানের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে, জনগণের একটি বৃহদাংশ যদি বার্ধক্যে পৌঁছয় তবে আর্থিক বৃদ্ধির হার নিম্নগামী হয়। যদিও জনসংখ্যা আর্থিক বৃদ্ধির হারের একমাত্র নির্ণায়ক নয়, কিন্তু বয়স্ক মানুষদের অনুপাত বাড়লে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ বাড়ে যেখানে তাঁরা সরাসরি আর্থিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারেন না।

চিনের সরকার ১৯৭৯ সালে জনসংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে এক সন্তান নীতি প্রবর্তন করে। ১৯৭৯ সালের বহু আগে থেকেই চিনের ফার্টিলিটি রেট নিম্নগামী ছিল। বহু বিশেষজ্ঞ গণনা করে দেখিয়েছেন যে, চিনের ফার্টিলিটি রেট কমার নেপথ্যে নগরায়ন, আর্থিক অগ্রগতি এবং উন্নয়নের অবদান এক সন্তান নীতি গ্রহণের তুলনায় বেশি। এই নীতি দীর্ঘদিন চলার পরে ২০১৫ সালে এক সন্তান নীতির পরিবর্তন করে দুই সন্তান নীতির প্রচলন করা হয়। তত দিনে চিনের ফার্টিলিটি রেট ১.৭ হয়ে গিয়েছে। এত কম সন্তান প্রসব করার প্রবণতার ফলে চিনের জনসংখ্যা এবং অল্প বয়স্কদের অনুপাত দুই-ই আগামী দিনে কমে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এই নীতির ছয় বছরের মধ্যেই, অর্থাৎ সম্প্রতি, চিনের সরকার আবার তা পরিবর্তন করে ঘোষণা করে যে, দম্পতিরা চাইলে তিনটি সন্তানের জন্ম দিতে পারেন। এই নীতির ফলে কী চিনের দম্পতিরা বেশি সংখ্যায় সন্তান ধারণ করবেন? বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত যে, সন্তান ধারণ করার ইচ্ছা রাতারাতি পালটানো যায় না। আসলে, কমিউনিস্ট পার্টির এক সন্তানের নীতিটিই ভ্রান্ত ছিল যেখানে চিনের ফার্টিলিটি রেট তার আগে থেকেই কমছিল। জোর করে মানুষের উপরে এই নীতি চাপিয়ে দিয়ে এখন বিপদে পড়ে সরকার তা ফেরাতে চাইলেও তা কত দূর ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

Advertisement

এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভারতের প্রসঙ্গ উঠে আসে। আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবত জানুয়ারি ২০২০ সালে বলেন যে, দেশে দুই সন্তানের বেশি করা যাবে না, এই আইন আনা উচিত দেশের উন্নয়নের স্বার্থে। অসমের মতন রাজ্যে দুইয়ের বেশি সন্তান থাকলে সরকারি চাকরি পাওয়া যাবে না বলে ঘোষণা করা হয়। এই নীতি সম্পূর্ণ রূপে ভ্রান্ত। প্রথমত, ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এবং ফার্টিলিটি রেট উভয়েই সম্প্রদায়-নির্বিশেষে নিম্নগামী। ২০১৫-১৬ সালের স্বাস্থ্য ও পরিবার সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে যে হিন্দুদের মধ্যে ফার্টিলিটি রেট ২.১ এবং মুসলমানদের মধ্যে ২.৬, যা আগের সমীক্ষার সময় থেকে অনেকটাই কম। ২০১৯ সালে ভারত সরকার দ্বারা প্রকাশিত জনসংখ্যার আগাম অভিক্ষেপ রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে ২০১৯ সালেই ভারতের ফার্টিলিটি রেট ইতিমধ্যেই ২.১-এ এসে পৌঁছিয়েছে। ২০১৯ সালের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২১-২০২৫ সালে এই সংখ্যা আরও কমে হবে ১.৯, যা ২০২৬-২০৩০ সালে হবে ১.৮ এবং ২০৩১-২০৩৬ সালে হবে ১.৭। ২০২০ সালের মধ্যে অসম-সহ অধিকাংশ রাজ্যেই ফার্টিলিটি রেট ২.১ বা তার নীচে চলে গিয়েছে বলে উক্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে। বিহার, উত্তরপ্রদেশ রাজস্থানের মতন কিছু রাজ্যে তা এখনও বেশি হলেও নিম্নগামী। এই প্রক্রিয়া সাধারণ ভাবেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ঘটবে, কোনও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতি ছাড়াই। অতএব, জোর করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার নীতি যুক্তিহীন।

আবার বয়সভিত্তিক জনসংখ্যার পরিসংখ্যান দেখলে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা উপরোক্ত রিপোর্ট থেকে উঠে আসে। ২০১১ সালে ১৫-৫৯ বছর বয়সের মানুষের অনুপাত ছিল ৬০.৭ শতাংশ, যা ২০২১ থেকে মোটামুটি ৬৫ শতাংশের আশেপাশে স্থিতিশীল হয়ে যাবে। কিন্তু ষাটোর্ধ্ব মানুষের অনুপাত ২০১১ সালের ৮.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২১ সালে হবে ১০.১ শতাংশ, যা লাগাতার বেড়ে ২০২৬ সালে হবে ১১.৫ শতাংশ, এবং ২০৩৬ সালে হবে ১৫ শতাংশ। ২০৩৬ সালে হিমাচল প্রদেশে এই অনুপাত হবে ১৯.৬%, পাঞ্জাবে এবং পশ্চিমবঙ্গে ১৮.৩%, ওডিশাতে ১৮.১%, মহারাষ্ট্রে ১৭.১%, অন্ধ্রপ্রদেশে ১৮.৯% এবং কেরলে ২২.৮%। কমতে থাকা ফার্টিলিটি রেট এবং বাড়তে থাকা ষাটোর্ধ্বদের প্রভাবে অচিরেই এই রাজ্যগুলিতে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বাড়বে এবং স্কুলের সংখ্যা কমবে। একই সঙ্গে ভারতের জনগণের গড় বয়স ২০১১ সালের ২৪.৯ বছর থেকে বেড়ে ২০২১ সালে হবে ২৬.৬ বছর এবং ২০৩৬ সালে তা হবে ৩৪.৭ বছর।

ভারতের সামনে এখনও সুযোগ আছে দেশের গড় বয়স কম থাকার সুবিধাটি গ্রহণ করার। কিন্তু যদি এই কমবয়স্ক মানুষদের রোজগার সুনিশ্চিত না করা যায়, আগামী ৫-১০ বছরের মধ্যে, তবে ভারতের বাড়তে থাকা বয়স্ক মানুষদের অনুপাত এবং এখনকার কমবয়সিদের রোজগারের অভাব ভারতের উন্নয়ন ও আর্থিক বৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তদুপরি, বয়স্ক মানুষদের দেখভাল করার জন্য যে পরিকাঠামো এবং নীতি দরকার, তা নিয়েও সরকারের ভাবার সময় এসে গিয়েছে। এই সব কাজ না করে আমরা যদি ক্ষুদ্র স্বার্থে জনসংখ্যা নিয়ে রাজনীতিতেই মন দিই, তবে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা অনেক গুণ বাড়বে।

ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন