Uttam Kumar

তাঁর বৈশিষ্ট্যের ভাষান্তর হয় না

তাঁর চোখের চাহনি, মণির সঞ্চালন, ঠোঁটের কুঞ্চন, উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য— সব বিন্দু থেকে উপচে পড়ত বাঙালি মনন, সমগ্র বাঙালিয়ানার পরিসর ও ইতিহাস।

Advertisement

এণাক্ষী রায় মিত্র

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২১ ০৮:৫১
Share:

আজ, ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে উত্তমকুমারকে একটু অন্য ভাবে স্মরণ করা যাক। হিন্দি ছবিতে উত্তমের উপর ‘আরোপিত অসাফল্য’-এর নিরিখেই মেপে নেওয়া যাক তাঁর আবহমান সাফল্যের ধারাটিকে। অনেক ভক্তই প্রিয় নায়ককে হিন্দি ছবিতে খুঁজে পান না। বলেন, তিনি খাঁটি বাঙালি, তাঁর শৈলী বাঙালিয়ানায় বিধৃত। মন্তব্যটির ব্যাখ্যা জরুরি।

Advertisement

তাঁর চোখের চাহনি, মণির সঞ্চালন, ঠোঁটের কুঞ্চন, উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য— সব বিন্দু থেকে উপচে পড়ত বাঙালি মনন, সমগ্র বাঙালিয়ানার পরিসর ও ইতিহাস। প্রতিটি কায়িক ও বাচিক ব্যবহারে আমরা এই বিরাট পরিমণ্ডল ও ইতিহাসকে বহন করি। কোনও ব্যবহারকে এই সমগ্র থেকে বাদ দিয়ে দেখলে তা তাৎপর্য হারাবে। পর্দায় স্বল্প সময়ে ও পরিসরে এই সমগ্রতাকে তুলে ধরার দুরূহ কাজটিই তিনি করেছেন।

বাংলা উচ্চারণে দাঁত চেপে বা ঠোঁট সরু করে, ইচ্ছাকৃত ইংরেজি টানে, মুখের উদাত্ত প্রসারণে পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন। মুখব্যাদান ও সঙ্কোচনের এই নকশাকে হিন্দি ভাষার মালমশলা ও ধ্বনিসংস্থানের উপর আরোপ করা যায় না। নায়ক-এ ফোন-সংলাপে ‘বলো’ শব্দটি খাদে নেমে যায়, ‘না এলে খুশি হব’-তে ‘শি’-র উপর জোর পড়ে। অপভ্রংশের ঐচ্ছিক প্রয়োগজাত রসবোধের (‘কিস্‌সু বোঝেননি’) অনুবাদ হয় না, হয়তো সমান্তরাল একটা প্রয়োগ উদ্ভাবন চলে। সেই মাত্রার সংশ্লেষণ আনতে হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতিতে অনেক গভীর শিকড় চাই। বাংলায় আজন্মলালিত মহানায়কের তো ওই ভৌগোলিক অবস্থান ছিল না!

Advertisement

দুই পুরুষ-এ নুটু মোক্তারের কথা জড়িয়ে গেলে কোন স্বরবর্ণ ও কোন ব্যঞ্জনবর্ণের কতটা বিকৃতি, জিভ ও মুখে কতটা শৈথিল্য প্রয়োজন— তাও অনুবাদযোগ্য নয়। অগ্নীশ্বর-এ চশমার উপর দিয়ে তাকানো, বাক্যের শেষ বর্ণগুলি গিলে ফেলে পরের বাক্যে আচম্বিতে উত্তরণ— একেও বাংলা ভাষা থেকে ছিঁড়ে হিন্দি প্যাকেজ বানানো যায় না!

উপরন্তু, মুম্বইয়ে উত্তম নাকি মর্মবিদারক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। তিক্ত প্রসঙ্গটির বদলে তাঁর অভিনীত হিন্দি ছবিগুলিকে ধরা যাক। দূরিয়া-য় ডাব করা স্বরের সানুনাসিকতা, স্বরভঙ্গিমার সঙ্গে মহানায়কের স্বর ও ব্যক্তিত্বের মিল নেই। যেন তাঁর অর্ধাংশই বাদ চলে গিয়েছে। আবার তখনকার হিন্দি চিত্রনাট্যে থাকত খলনায়ক ও খলনায়িকার সঙ্গে ঘাত-প্রতিঘাত, ঈর্ষা ইত্যাদি। তা ওই জমানার বাঙালি নায়কের সঙ্গে খাপ খায় না। এই উপাদানগুলি তখন বাংলায় পরিমার্জিত ভাবে ছিল। ফলে, বাংলা ছবিতে তাঁর নায়কোচিত ব্যক্তিত্ব, রুচি, পরিমিতিবোধ বজায় থেকেছে। স্বপ্রযোজিত ছোটি সি মুলাকাত-এও সবটা তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল না। ক্ল্যারিয়োনেট বাজানোর দৃশ্যে উপনায়কের সঙ্গে রুচিহীন প্রতিযোগিতা, টুইস্ট নাচের অদ্ভুত আরোপণে তাঁর অভিনয়-শৈলী চাপা পড়েছে। হিন্দিবলয়ের মেকআপ নামক ছ’পোঁচ ফাউন্ডেশনের গোলাপি মুখোশের আড়ালে হারিয়ে গিয়েছেন প্রিয় নায়ক। লাল কোটের উত্তমকে দেখে হঠাৎ প্রেম চোপড়াকে মনে পড়ে!

প্লট নাম্বার ফাইভ মুক্তি পেয়েছিল উত্তমের মৃত্যুর পর, ১৯৮১-তে। হুইলচেয়ারে বন্দি মধ্যবয়সি হত্যাকারী উত্তমের কাজ প্রশংসিত। কিন্তু বাংলায় তো একাধিক প্রতিবন্ধী চরিত্রকে স্মরণীয় করেছেন তিনি। যেমন পংখীরাজ-এর ফিরিঙ্গি প্রৌঢ় জর্জদা। ডান হাতটি অক্ষম, খুঁড়িয়ে হাঁটেন। ডান হাত অকেজো হওয়ার পুরো চাপটা প্রথমে পড়ছে বাঁ হাতে, সেখান থেকে উঠছে বুকে, গলায়, মুখে, শেষে ওষ্ঠদেশে। পেশিচালনায় এই বিকৃতির অত্যন্ত মৌলিক ছবি এঁকেছিলেন উত্তমবাবু। দুর্ভাগ্যবশত প্লট নাম্বার ফাইভ-এ এই উত্তরণের সুযোগ মেলেনি। প্রতিবন্ধী মানুষটি কী ভাবে হত্যা করছেন, মৃতদেহ সরাচ্ছেন দেখাতে বিশদীকরণ, শট ও কাট, মন্তাজ-কৌশলের প্রয়োজন ছিল। ছবিটিতে তার অভাব। চিত্রনাট্যের এই দৈন্য চরিত্রসৃষ্টিতেও সংক্রমিত। হিন্দি সিনেমার জগতে উত্তমবাবুর অভিনয়-সত্তা বারে বারে বিঘ্নিত হওয়ার এটাও একটা কারণ।

প্রশ্ন উঠবে, এতৎসত্ত্বেও অনেক বাঙালিই মুম্বইতে সফল। শর্মিলা, রাখী, জয়া ভাদুড়ি, বিশ্বজিৎ, মিঠুন চক্রবর্তী প্রমুখ। তার উত্তর, উত্তমকুমারের ব্যর্থতা কিন্তু তাঁর অভিনয়-উৎকর্ষেরই আর একটা মাত্রা। অভিনয়ের যে গুণগুলি এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদযোগ্য— সেগুলি আসলে মোটা দাগের। মারামারি, শারীরিক কসরত, নাচ, এবং নিছক দৈহিক সৌন্দর্য। এগুলি বিচ্ছেদ্য উপাদান। সহজেই এক ভাষা থেকে আর এক ভাষায় স্থানান্তরিত করা চলে। এই স্থানান্তরযোগ্য গুণগুলির কোনওটাই ঠিক উত্তমবাবুর হাতিয়ার নয়। শুধুই জিনদত্ত জম্পেশ উপহার বা প্রতিষ্ঠানলব্ধ বিশেষ দক্ষতায় তিনি উত্তমকুমার হয়ে ওঠেননি। বৈশিষ্ট্যগুলি সৃষ্টি করেছিলেন নিজে। অনেক ভাঙচুর, পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে, তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত।

উত্তমকুমার যে অবিচ্ছেদ্য ভাবে বাঙালিরই থাকবেন, নায়ক-এ স্পষ্ট ইঙ্গিত দেন সত্যজিৎ রায়। ট্রেনের করিডরে নায়ক অরিন্দমের পাশ দিয়ে বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে অবাঙালি মহিলা হেঁটে গেলেন। ‘রেস্তরাঁ কার’-এ অরিন্দম ও অদিতির পাশেই দু’জন পাগড়ি বাঁধা শিখ যুবক। নায়কের গা ঘেঁষে থেকেও এদের তাপ-উত্তাপ ছিল না।

দর্শন বিভাগ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন