গাঢ়তর এই অন্ধকার
Coronavirus

এ বার তা হলে ভক্তির বেড়া দিয়ে অতিমারি আটকানোর চেষ্টা?

অসহায়তা ও সঙ্কট বহু মানুষকে পৌঁছে দিচ্ছে দু’টি বিপরীত বিন্দুতে। কেউ আত্মসমর্পণ করছেন দেবতার পায়ে, কেউ বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথ।

Advertisement

রঞ্জন সেন

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২১ ০৫:৫৪
Share:

অতিভক্তি: কোয়ম্বত্তূরের এক মন্দিরে চলছে করোনা দেবীর পুজো, মে, ২০২১।

অতি’ কথাটার মধ্যে একটা বাড়াবাড়ির ব্যাপার রয়েছে। অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ, অতি লোভে তাঁতি নষ্ট, অতি বৃষ্টিতে কৃষকের সর্বনাশ, অতি বাড় ভাল নয়— কথাগুলো লক্ষ করুন। বোঝাই যাচ্ছে, এই বাড়াবাড়িতে ভালর চেয়ে খারাপই হয় বেশি। প্রায় দু’বছর ধরে চলা অতিমারি সে কথা প্রমাণ করে ছেড়েছে। জীবন অনিশ্চিত, আত্মবিশ্বাস একেবারে তলানিতে, মানুষকে এত বেশি নড়বড়ে ও দ্বিধাগ্রস্ত এর আগে দেখা যায়নি। অসহায়তা ও সঙ্কট বহু মানুষকে পৌঁছে দিচ্ছে দু’টি বিপরীত বিন্দুতে। কেউ আত্মসমর্পণ করছেন দেবতার পায়ে, কেউ বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথ।

Advertisement

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এমনটাই হয়। কারণ, অতিমারি কোনও সাধারণ ঘটনা নয়। তা অতর্কিতে হানা দিয়ে বদলে দেয় সামাজিক জীবন। বদলে যায় মানুষ, পাল্টে যায় চেনা ছক এবং জীবন, মৃত্যু ও পরিবেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক। মনে পড়ছে আনন্দমঠ-এ বঙ্কিমচন্দ্রের দেওয়া গুটিবসন্তে আক্রান্ত একটি গৃহস্থ বাড়ির বর্ণনা— “যে গৃহে একবার বসন্ত প্রবেশ করে সে গৃহবাসী রোগী ফেলিয়া ভয়ে পালায়।” গ্রাম্য জীবনের পারিবারিক বন্ধনকে এ ভাবেই বদলে দিয়েছিল গুটিবসন্ত নামক একটি প্রাণঘাতী রোগ।

ভক্তদের দেওয়া বসন্তের ডাকনাম ‘মায়ের দয়া’ থেকে বাঁচতে গোটা বাংলা জুড়ে গড়ে উঠেছিল ওলাইচণ্ডীর মন্দির, ওলাবিবি, ঘেঁটুঠাকুরের থান আর শীতলার মন্দির। শহরের অনেক শীতলা ও ওলাইচণ্ডীর মন্দির এখনও সে দিনের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কবি নিত্যানন্দের শীতলামঙ্গল কাব্যে পাচ্ছি, একটা দুটো নয়, চোদ্দো রকম বসন্তের বর্ণনা। সেখানে গান গেয়ে শীতলার অনুচররা বলছে, “আমরা যে দেশে যাই মাতা ভগবতী।/ সে দেশে না থাকে কেহ বংশে দিতে বাতি।।” এর পরও ভয় না পেয়ে উপায় আছে!

Advertisement

সেই ভয়েই হোক বা ভক্তিতে— এই করোনাকালেও সারা দেশে বাড়ছে করোনা দেবীর মন্দির। বাংলা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, অসম, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাডু— সর্বত্র এই দেবীর পুজো শুরু হয়ে গিয়েছে। দেবীর নাম কোথাও করোনা মাতা, কোথাও বা করোনা মাই, আবার কোথাও তিনি লক্ষ্মী, সরস্বতীর মতো আর এক জন দেবী। মোতিচুর, লাড্ডু, ফুল, গঙ্গাজল দিয়ে রীতিমতো পুজো হচ্ছে তাঁর! আসানসোলের নিচুপাড়া বস্তিতে করোনা থেকে বাঁচতে মোতিচুর আর লাড্ডু দিয়ে পুজো দিয়েছেন স্থানীয় মানুষ, কোয়ম্বত্তূরে হয়েছে করোনা দেবীর মন্দির। উত্তরপ্রদেশে শুকলপুর গ্রামে ফুল, মিষ্টি, গঙ্গাজল দিয়ে করোনা মাতার পুজো করছেন গ্রামবাসীরা। শুধু ভারত নয়, পৃথিবীর সব দেশেই অতিমারি, মহামারির সময় ঈশ্বর আবির্ভূত হয়েছেন এক ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ হিসাবে।

বেশির ভাগ জায়গাতেই এই দেবীর যাঁরা দেখা পেয়েছেন বা শুরু করেছেন তাঁর পুজো, তাঁরা মূলত নিম্নবিত্ত মানুষ। এঁরা বিশ্বাস করেন, একমাত্র দেবীই তাঁদের এ রোগ থেকে বাঁচাতে পারেন। এটা শুধুই বিশ্বাস, এখানে যুক্তি-তর্ক খোঁজা ভুল। ভক্তির বেড়া দিয়ে অতিমারি আটকানোর চেষ্টা এ আমলেও কম নয়। একটু লক্ষ করলে দেখা যায়, এই করোনাকালে কলকাতা ও তার লাগোয়া এলাকার বহু জায়গায় প্রায় প্রতি দিনই গড়ে উঠছে ছোট ছোট শনি, কালী, শীতলার মন্দির। এখানে বড় মন্দিরের মতো ভিড় নেই। তাই সংক্রমণের আশঙ্কা নিয়ে হইচই হয় না।

সত্যি বলতে কী, অতিমারি যেন একটা আয়না, যা মানুষকে দেখায় আসলে আমরা কেমন। জীবন-মৃত্যু এবং পরিবেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে তা স্পষ্ট করে। এই দৃশ্যই তো গত প্রায় দু’বছর ধরে আমরা দেখছি। একই সঙ্গে দেখছি রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। এ সবের পাশাপাশিই আবার পথ হাঁটছে নিঃস্বার্থ সেবাধর্ম, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সদিচ্ছা ও দায়িত্ববোধ। সংবাদপত্রের ভাষায় যাকে বলে— মিশ্র প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়ার চেহারাও এক-এক জায়গায় এক-এক রকম। এমনটা আগের অতিমারিগুলির সময়ও ঘটেছে।

প্লেগ প্রশ্ন তুলেছিল মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক নিয়ে— ঈশ্বর কেমন করে এটা ঘটাতে পারলেন? আবার বিউবনিক প্লেগ মহাদেশগুলির জনসংখ্যা অর্ধেক করে দিয়েছিল, যার প্রভাব পড়েছিল শিল্প বিপ্লব, ক্রীতদাস প্রথা এবং ভূমিদাস প্রথার উপর। এ সব কিছু কখনও হয় খুব সংগঠিত ভাবে, আবার অনেক সময় নিঃশব্দে। অতিমারিতে মানুষের উজ্জ্বল ও অন্ধকার, দু’টি দিকই দেখছি আমরা। ইবোলার সময় ডাক্তাররা সেবাধর্ম পালন করতে গিয়ে সীমান্ত মানেননি, নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে মাথা ঘামাননি তাঁরা। করোনার সময়েও তো এই শহরের চিকিৎসকদের চিকিৎসা করতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হওয়া, এমনকি মারা যাওয়ার বহু ঘটনা দেখেছি আমরা। রেড ভলান্টিয়ার্স-এর মতো বহু সংগঠনের উল্লেখযোগ্য মানবিক পরিষেবার পাশাপাশি দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও দুর্নীতিও কম নয়।

সেবাধর্ম পালন করতে গিয়ে এক দল প্রাণ দিচ্ছেন আর এক দল করছেন আত্মহত্যা। করোনাকালে দেশে যে আত্মহত্যা বেড়েছে, সে কথা সরকারি রিপোর্টই বলছে। আত্মহত্যার ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের স্থান দেশে চতুর্থ। রাজনীতি, সংগ্রাম, সচেতনতায় এগিয়ে থাকা পশ্চিমবঙ্গে আত্মহত্যা কেন বাড়ছে, তা নিয়ে চট করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া এখনই ঠিক হবে না। সম্প্রতি প্রকাশিত ২০২০’র ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর রিপোর্ট বলছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর অবধি সময়কালে দেশ জুড়ে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে। আত্মঘাতীদের একটা বড় অংশ ছাত্র এবং দিনমজুর। কোভিডকালে এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষের হতাশা সবচেয়ে বেশি। অতিমারি এঁদের বিপর্যস্ত করেছে দু’দিক থেকে। দিনমজুররা হারিয়েছেন কাজ, ছাত্ররা আশা। স্বাভাবিক পঠনপাঠন এবং কর্মসংস্থানের অবস্থা ভয়াবহ। অনলাইনের জমানায় দেশের দু’কোটি নব্বই লক্ষ ছাত্রছাত্রীর কোনও ডিজিটাল অ্যাকসেস নেই। আত্মঘাতী দিনমজুরদের মধ্যে ৬৩.৩ শতাংশ মানুষ মাসে ৮০০০ টাকারও কম আয় করতেন। ঈশ্বর ও রাষ্ট্র এঁদের কোনও বাঁচার আশা তৈরি করতে পারেনি। দুইয়ের উপরই এঁরা বিশ্বাস হারিয়েছেন। যুক্তিহীন অতিভক্তি আর হতাশায় আক্রান্ত হয়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ঘটনায় আজ গাঢ়তর জীবনের অন্ধকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন