College

বাঙালি অবহেলা করেছে বলে

যিনি পশ্চিমবঙ্গের কোনও কলেজে প্রায় সমস্ত বাঙালি ছাত্রকে রসায়ন বা পদার্থবিজ্ঞান পড়াবেন, তাঁর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানের চেয়ে ইংরেজিতে কথা বলতে পারা কেন বেশি জরুরি?

Advertisement

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৩ ০৪:৪২
Share:

— প্রতীকী ছবি।

কলকাতার ওই কলেজ স্নাতক স্তরে ভর্তির বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল সেখানে ‘শুধুমাত্র’ ইংরেজি মাধ্যমেই লেখাপড়া ও পরীক্ষা হয়; তাই অন্য মাধ্যমের ছাত্রীদের সেখানে ভর্তির জন্য বিবেচনা করা হবে না। এই বক্তব্য নিয়ে সমাজমাধ্যমে প্রবল তোলপাড়ের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের হস্তক্ষেপে কলেজ কর্তৃপক্ষ নিঃশর্তে ক্ষমা চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। দৃশ্যত ক্ষুদ্র কিন্তু সুদূরপ্রসারী এই ঘটনার পরতে পরতে অনেক প্রশ্ন-উত্তর জড়িয়ে থাকল।

Advertisement

যে কলেজে আগাগোড়াই ইংরেজি মাধ্যমে বিদ্যাভ্যাস হয়, আজ হঠাৎ কী কারণে তাঁদের অন্য ভাষামাধ্যমের জন্য দরজা বন্ধ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করতে হল? তাঁদের কেন মনে হল যে, পশ্চিমবঙ্গে বসে বাংলা মাধ্যমের ছাত্রদের ‘বিবেচনা’ না করা সম্ভব ও সঙ্গত হবে? উত্তরটা জানা। আমরা যারা বাংলা ভাষা না-জানাকে শিক্ষার ক্ষতি বলে মনে করিনি, সন্তানের দ্বিতীয় ভাষাটাও বাংলা রাখিনি, ঝরঝর করে ইংরেজিতে কথা বলতে পারলেই সপ্রতিভতা ও উৎকর্ষের মাত্রা পূর্ণ হয়ে যায় বলে ভেবেছি, এই কলেজের ‘টার্গেট’ সেই আমরাই। কলেজের অন্দরমহলটিতে ইংরেজি মাধ্যমের পবিত্রতা ‘ভার্নাকুলার’ মাধ্যমের সংস্পর্শে নষ্ট হয় না জেনে তাঁরা নিশ্চিন্ত, এমনকি আহ্লাদিতও হতে পারেন, এই ভেবেই এ-হেন সদম্ভ ঘোষণা। বাংলা মাধ্যম যে-হেতু সরকারি বোর্ডের ভাষা, এবং সরকারি বোর্ডের উপর নির্ভরশীল সমাজের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি করতে চাওয়া সেই ‘আমাদের’ তুষ্ট করার আশা এই ঘোষণার ভিত্তি।

মেধার চেয়েও ভাষামাধ্যম এই ভাবেই বড় হয়ে উঠছে আমাদের চার পাশে। আজ নয়, অনেক দিন ধরে। বহু বছর আগে কলেজ সার্ভিস কমিশনে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে এক ছাত্রী তীব্র ধমক খেয়েছিল ‘স্পিক ইন ইংলিশ’! উদ্বেগের দরুন গলা দিয়ে ঠিকমতো আওয়াজ বেরোচ্ছিল না, ইংরেজিতে কথা বললেও। অনেক পরে এক বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানীর গবেষণাগারে সেই ছাত্রী দেখেছিল, ছাত্রদের বাংলায় কথা বলা বারণ। বিজ্ঞান গবেষণায় তুখোড় বাংলা মাধ্যমের গবেষকরা যাতে জাতীয়/আন্তর্জাতিক স্তরে ইংরেজি বলতে না পারার জন্য পিছিয়ে না যায়, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। কিন্তু কলকাতার সেই গবেষণাগারে অবাঙালি ছাত্রদের মধ্যে হিন্দিতে কথাবার্তা চলত। কারণটা অনুসন্ধান করা হয়নি, ফলাফলেও বিশেষ তফাত দেখা যায়নি। কারণ প্রথমত বিজ্ঞানের গবেষণায় থাকতে থাকতে মোটের উপর কাজ চালাবার মতো ইংরেজি সবাই শিখেই যায়। দ্বিতীয়ত, ইংরেজিতে কথা বলতে পারা সত্যিই এমন কোনও বিষয় নয় যার জন্য গবেষকের মূল্যায়নের হেরফের হতে পারে। ইংরেজি প্রচ্ছায়ার বাইরের জাপান, চিন, কোরিয়ার ছাত্র/গবেষকরা ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে আন্তর্জাতিক স্তরে দিব্য কাজ চালিয়ে নেয়।

Advertisement

যিনি পশ্চিমবঙ্গের কোনও কলেজে প্রায় সমস্ত বাঙালি ছাত্রকে রসায়ন বা পদার্থবিজ্ঞান পড়াবেন, তাঁর ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানের চেয়ে ইংরেজিতে কথা বলতে পারা কেন বেশি জরুরি? পশ্চিমবঙ্গে কেন বাংলা বাধ্যতামূলক নয়, কলকাতায় পড়তে এসে কেন অবাঙালি ছাত্ররা (অনেকে) বাংলায় একটা শব্দও সহ্য করতে পারে না? আমরা এ সব কোনও কিছুকে অন্যায্য বলে মনে করিনি। বরং সরকারি পরীক্ষায় বাংলায় ৩০০ নম্বরের পরীক্ষা প্রশ্ন হবে শুনে আমরাই আপত্তি জানিয়েছি; বেসরকারি ইস্কুল বাংলা পড়াবার ব্যবস্থা না রাখলে আমরাও বলেছি, বাংলা পড়ে কী হবে, রাজ্যের বাইরে বাংলা তো কোনও কাজে লাগে না।

আরও একটা কথা আছে। যে অর্থে আঞ্চলিক ভাষার ক্ষেত্রে ‘ভার্নাকুলার’ শব্দটা ব্যবহার হত, সে অর্থে এই বঙ্কিম-রবীন্দ্রোত্তর বাংলাকে কি ভার্নাকুলার বলা যায়? ডুয়ার্স থেকে ডায়মন্ড হারবার জুড়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত নানা রকমের কথ্য ভাষা, উপভাষা, বাগ্‌ধারা আর বাংলা মাধ্যমের ছাত্রদের যে ‘লেখ্য বাংলা’ সব কি এক হয়ে গেল? তবে কিনা, ভারতের দ্বিতীয় সর্বাধিক মানুষের যে ভাষা, নিজভূমেই তার যদি এই হাল হয়, তা হলে কোথায় বা দাঁড়াবে সাঁওতালি আর নেপালি ভাষার অধিকার?

বাংলা ভাষাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার জন্য এক ভাবে চেষ্টা করেছিলেন প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ধর্মতলার দোকানে দোকানে গিয়ে অনুরোধ করেছিলেন দোকানের নাম-ধাম ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও লেখা হোক, কারণ স্থানীয় ভাষার এই ব্যবহার সংবিধানে উল্লিখিত। তাতে কিছু কাজ নিশ্চয়ই হয়েছিল, তাই আজ ধর্মতলায় দাঁড়ালে কিছু দোকানের নাম, নির্দেশ বাংলায় লেখা চোখে পড়ে। আর আজ— আমাদের বাংলা আবেগ একুশে ফেব্রুয়ারিতেই শুরু ও শেষ হয়ে যায়, যদি না মাঝেমধ্যে লোরেটো কলেজ এমন কোনও ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন