Economy

যন্ত্রসম মানুষের উপনিবেশ

কাজের প্ৰথম দিনই ডেলিভারি কর্মীদের বলে দেওয়া হয়, তাঁরা এই সংস্থার অধীনস্থ শ্রমিক নন, ফ্রিল্যান্সার— ডেলিভারি পার্টনার।

Advertisement

অর্ক দেব

শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২২ ০৫:৩০
Share:

ফুড ডেলিভারি ব্যবস্থা।

আজকের গিগ অর্থনীতির মধ্যে একটা বড় অংশ জুড়ে আছে ফুড ডেলিভারি ব্যবস্থা। অন্যান্য ই-কমার্সে পণ্যের ডেলিভারির সঙ্গে এর মূলগত ফারাক হল এই যে, এখানে পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সময় খুব কম। তাদের এই প্রতিশ্রুতি পূরণের দায়িত্ব লাল বা কমলা পোশাক পরা দু’চাকার সওয়ারিদের, খাবার-বাজার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে যাঁরা বলেন, “স্যর, রেটিংটা একটু দিয়ে দেবেন।”

Advertisement

কাজের প্ৰথম দিনই ডেলিভারি কর্মীদের বলে দেওয়া হয়, তাঁরা এই সংস্থার অধীনস্থ শ্রমিক নন, ফ্রিল্যান্সার— ডেলিভারি পার্টনার। কাজের ভিত্তিতে টাকা। প্রতি ঘণ্টায় কতগুলি খাবার তাঁরা ডেলিভারি করলেন, কতটা পথ কত কম সময়ে তাঁরা পাড়ি দিলেন, কত টাকার খাবার পৌঁছে দিতে দেরি হল তাঁর, এ সবের ভিত্তিতেই ঠিক হবে মজুরি। যত বেশি সময় অনলাইন থাকবেন, তত বেশি সময় তাঁর কাছে অর্ডার ঢুকতে থাকবে। যাঁর যত অর্থের প্রয়োজন, তিনি তত বেশি সময় অনলাইন থাকবেন। সরাসরি কর্মচারী হিসাবে নিযুক্ত নন, তাই বিমা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি কিছুই দিতে হয় না। ন্যূনতম খেয়ে-পরে বাঁচতে গেলে অন্তত ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়।

এই ডেলিভারি পার্টনারদের কারও কোনও স্বতন্ত্র পরিচয় নেই সংস্থার কাছে, তাঁরা এক-একটি ডিজিটাল আইডেন্টিটিমাত্র— কেউ ৪৭ফ, কেউ ৬৯ঙ, মানুষ থেকে তাঁরা হয়েছেন দশ-পঁচিশের ছক। যে নম্বরের কাজ জেগে থাকা, অনলাইন থাকা। মানবচরিত্র, মানবসম্পর্ক, মানুষের কামনা-বাসনা, ছুটির আর্তি, এগুলি যে তাঁদের আছে, কোনও প্রতিষ্ঠান তা মনে করে না— অন্তত যে ভাবে তাঁদের শ্রমনীতি সাজানো হয়, তাতে মানুষী ইচ্ছা-চাহিদাগুলিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এ এমন এক দাসব্যবস্থা, যেখানে অনলাইন হলে দাসের আর নিজের শরীরে নিজের কোনও অধিকার থাকে না। নির্দিষ্ট একটি টাস্ক দিয়ে সময় বেঁধে দেওয়া হবে, সেই সময়ের মধ্যেই গ্রাহকের কাছে পৌঁছতে হবে। তবে মিলবে গোনাগুনতি টাকা, যত বেশি কাজ তত টাকা, যত কম সময়ে যত বেশি কাজ তত বেশি উপার্জন। কিন্তু যে রক্তমাংসের শরীরটি এই ডিজিটাল দায়িত্ব পালন করছে, রাস্তায় জোরে ছুটতে গিয়ে যদি দুর্ঘটনা ঘটে? কেউ দায়িত্ব নেবে না।

Advertisement

একটাই দেহকে লড়তে হয় তিনটি স্তম্ভের সঙ্গে। একটি স্তম্ভ গ্রাহক, যিনি খাবারটা নির্দিষ্ট সময়ে পেতে চাইছেন; একটি স্তম্ভ প্রেরক, যে এই দেহকে দৌড়ে নামিয়েছে সময়কে হারানোর লক্ষ্য দিয়ে; এবং, তৃতীয় স্তম্ভটি রাস্তার আইনরক্ষক। এই তিনটি স্তম্ভই তাঁকে দেখছে। ক্রেতা তাঁর মোবাইলে দেখছেন যে, ডেলিভারি পার্টনার তাঁর খাবারটি তুললেন দোকান থেকে, তিনি এগোচ্ছেন— হঠাৎ তাঁর বাইকটি পথে দাঁড়িয়ে গেলেই গ্রাহক প্রশ্ন করবেন, থামলেন কেন? প্রেরক সংস্থাও প্রশ্ন করবে— দেরি হলে সংস্থার বদনাম যে! ডেলিভারি পার্টনার জানেন, অদৃশ্য কর্তৃপক্ষ তাঁকে দেখছে প্রতিটা মুহূর্তে, নিয়ম ভাঙলেই শাস্তি। এই লড়াইয়ে হেরে যাওয়া চলে না, জেতার জন্য ছুটতে থাকেন নতুন দাস। সস্তার শ্রমই সংস্থাগুলির পুঁজি।

দুটো ডেলিভারির ফাঁকে জিরিয়ে নিতে হলে ফুটপাত ভরসা, বাথরুম পেলে বহু ক্ষণ চেপে রাখাই দস্তুর। গিগ শ্রমিকেরও যে শারীরবৃত্তীয় প্রয়োজন থাকতে পারে, নৈর্ব্যক্তিক অ্যাপ তা স্বীকার করে না। সর্ব ক্ষণ নজরদারির মধ্যে থেকে, নিজের ন্যূনতম প্রয়োজনগুলিকেও অস্বীকার করে যাঁরা প্রতি দিন বারো ঘণ্টারও বেশি ছুটছেন নির্দিষ্ট লাল-কমলা পোশাক পরে, তাঁদের শুধুমাত্র ধনতন্ত্রের চলমান যন্ত্র না ভেবে এক জন গোটা মানুষ ভেবে তাকালে চোখে পড়বে, তাঁরা আসলে একটা অনন্ত জেলখানায় বন্দি।

শুধু ফুড ডেলিভারি বয় নয়, ই-কমার্সের সঙ্গে যুক্ত যে কোনও ডেলিভারি পার্টনারকে দেখবেন, পণ্যবোঝাই ব্যাগটা পিঠে বয়েই ডেলিভারি করতে আমাদের দরজায় পৌঁছন। বাইকের উপরে রেখে এলে চুরি হয়ে যেতে পারে। অনেক বহুতলেই ডেলিভারি পার্সনদের লিফটে চড়া মানা, ফলে চার-পাঁচ-ছ’তলা তাঁদের হেঁটেই উঠতে হয়। প্রতি দিন ওজন বইতে বইতে ওঁদের মেরুদণ্ড কাঁধের স্নায়ু ক্ষতবিক্ষত হয়। সফদরজং হাসপাতালের স্পোর্টস ইনজুরি সেন্টারের চিকিৎসক প্রদীপ চৌধুরী একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, রোজ আউটডোরে অন্তত তিন জন এমন রোগী আসেন, মেরুদণ্ডের সমস্যা নিয়েও যাঁরা ডেলিভারির কাজে যুক্ত। কারও কারও ক্ষেত্রে বিশ্রাম বা আইস ব্যাগ ব্যবহারে সাময়িক সুরাহা হয়। অনেকের ক্ষেত্রেই দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা দেখা দেয়। মেরুদণ্ডের কার্যকারিতা নষ্ট হতে থাকে।

ডেলিভারি কর্মীদের শরীর, সেই শরীরের ভেঙে পড়া, সেই শরীর ঘিরে গড়ে ওঠা প্রেরক-প্রাপকের নজরদারি ব্যবস্থা এক নয়া উপনিবেশের কথা বলছে। যে উপনিবেশের কেন্দ্রে আছে খাবার এবং খাবার কেনার সামর্থ্য, আছে চাহিদা অনুযায়ী জোগানের বাহুবল। বৃত্তের ভিতর নানা বিন্দুতে জোগানের জন্যে রাখা হয়েছে পরিধিস্থ কিছু ডেলিভারি কর্মীদের। যাঁরা দুপুরে দু’চার জনের সঙ্গে ভাগ করে বাড়ি থেকে আনা হাতে গড়া রুটি খাবেন, বাইক রেখে ফুটপাতের ধারেই গোল হয়ে বসে বিড়ি ধরিয়ে সামান্য আয়েশ করবেন, তার পর আবার সেই দে ছুট। করোনায় সারা বিশ্বে কাজ গিয়েছে নিম্নবিত্তের। লোক বেড়েছে ফুড ডেলিভারি সংস্থাগুলিতে। মাথা যত বেড়েছে, জনপ্রতি রোজগারের গ্রাফ স্বাভাবিক নিয়মে ততই পড়তির দিকে।

আর আছে কাজ হারানোর ভয়। আমেরিকায় ড্রোন মারফত খাবার ডেলিভারি করা চালু হয়ে গিয়েছে। ২০১৯ সালে এ দেশেও ড্রোন ডেলিভারির ট্রায়াল হয়েছে। দেখা যায় ১০ কিলোমিটার দূরত্বে পাঁচ কেজি খাবার সফল ভাবে দিয়ে আসতে পারছে ড্রোন। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ড্রোন ডেলিভারির অনুমতিও পেয়ে গিয়েছে কুড়িটি সংস্থা। এ হল নতুন ডিজিটাল ব্যবস্থার ‘আদর্শ’ সমাপতন। মানুষকে যন্ত্রসম করে তুলতে চেয়েছে একটি ব্যবস্থা, তার পর অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্রকে তার পরিবর্ত হিসেবে নিয়ে আসছে। ডেলিভারি শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত যন্ত্রের গর্জন শুনতে পাচ্ছেন। এর পর কী, তাঁদের ক্লান্ত শরীরগুলো সত্যিই জানে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন