Alipore Correctional Home

অনুভূতিও কি কারাগারেই বন্দি

দেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস যখন প্রদর্শনকক্ষে টিকিট-কাটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তা দেখতে মানুষ আসবেন— দেখবেন, মন্তব্য করবেন, খিদে পেলে খাবেন।

Advertisement

সোনালী দত্ত

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২২ ০৬:৩১
Share:

কান্না-ঘাম-রক্তে লেখা অনেক আত্মত্যাগের কাহিনি। ফাইল চিত্র।

আলিপুর জেল জাদুঘরের রেস্তরাঁর থালিগুলির নাম ছিল ‘সিপাহি বিদ্রোহ’, ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’, ‘বিনয়-বাদল-দীনেশ’ এবং ‘আইএনএ’-র নামে। হইচই হতে সেই নাম পাল্টেছে বটে, কিন্তু লুচি-আলুর দমের ঢেকুর তুলে মানুষ যখন বাইরে আসছেন, তখন কারও মাথায় নেই যে, খানিক দূরেই সেই কারাগার, ফাঁসির মঞ্চ, যেখানে কান্না-ঘাম-রক্তে লেখা হয়েছে অনেক আত্মত্যাগের কাহিনি। তাঁদের কণ্ঠে তখন, “খাবার খারাপ নয়, তবে বড্ড দাম!”

Advertisement

দেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস যখন প্রদর্শনকক্ষে টিকিট-কাটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, তা দেখতে মানুষ আসবেন— দেখবেন, মন্তব্য করবেন, খিদে পেলে খাবেন। এই জৈবিক চাহিদাগুলোর সামনে নত হওয়া ছাড়া গতি নেই। তবুও মানবিক হৃদয়ের কাছে একটি দাবি থাকে। পূর্বসূরির আত্মত্যাগের ইতিহাসের সামনে মৌন হওয়ার দাবি, এই পবিত্র গাথার এতটুকু অসম্মানেও রুখে দাঁড়ানোর দাবি। এ-হেন মানুষ-সুলভ আবেগ থেকে কি আমরা দূরে সরে যাচ্ছি? নচেৎ, যে কারাগারে বন্দি ছিলেন দেশপ্রাণ, দেশবন্ধু এবং দেশনায়ক; তার সামনে নৃত্যসহযোগে ভিডিয়ো তোলা হচ্ছে কী ভাবে? ‘সলিটারি সেল’-এ ফাঁসির আগে বিপ্লবীরা যে বেদির উপর ঘুমোতেন, সেখানে ক্যামেরাধারী যুগল বলছে, “আমি শুয়ে পোজ় দিচ্ছি। ছবি নে!” এই যুবসমাজ কি হৃদয় বিবর্জিত যান্ত্রিকতার দিকে এগিয়ে চলেছে? এই বীর বিপ্লবীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হয়, এই কথাটিও কি আজকের প্রজন্মকে বলে দিতে হবে?

এক দিদিমণি ক্লাস সেভেনের ঘরে ঢোকার সময় খুব উৎফুল্ল। ক্লাস থেকে বার হওয়ার সময় তাঁর মুখেই শ্রাবণের মেঘ। ‘টেনিদা’র গল্পেও যে কেউ হাসেনি! অন্য দিদিমণির ক্ষোভ, ‘বলাই’ পড়াচ্ছিলাম। একটা মেয়েরও চোখে জল নেই! রবি ঠাকুর যাদের কাঁদাতে পারেন না, এবং নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় যাদের হাসাতে পারেন না, আমাদের যাপনের হাসিকান্নায় শরিক হতে তারা অনেকেই শিখছে না। পথের পাশে অসুস্থ সহযাত্রী পড়ে থাকলেও এখন শুশ্রূষা করার জন্য তরুণ-তরুণী জোটে না। বিপদে সাহায্য চাইলে শুনতে হয়, “মিটিং-এ। সন্ধেবেলায় যোগাযোগ করে নেব।” কিছু জনের মধ্যেও যদি এমন যান্ত্রিকতার ভাইরাস ঢুকে পড়ে, ছড়িয়ে পড়তে কত ক্ষণ? যে সব সান্ধ্য-সিরিয়াল সমাজকে বিকৃতির পথ দেখাচ্ছে, সেগুলির দর্শকরা যদি বাড়ির সকলের সঙ্গে সন্ধেবেলায় বসে হাসিঠাট্টা, খাওয়াদাওয়ার সুযোগ পেতেন, এই ভয়ঙ্কর ফাঁদে তাঁরা পা দিতেন কি না সন্দেহ।

Advertisement

কেন এই ভাবে মানুষের হৃদয় কেবল হৃৎপিণ্ড নামক যন্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে? উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা ‘ভার্চুয়াল’ সুখদুঃখে এমন অভ্যস্ত যে, মোবাইলের বাইরের দুনিয়ায় বাস্তবের কান্নাহাসি তাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারছে না। ‘কান্নার স্টেটাস’, ‘চিল করার সেলফি’, ‘প্রোটেস্ট পোস্টার’ ইত্যাদি এমন স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে যে, স্মার্টফোন কিনতে না পারা হাত অন্যের ফোন ছিনিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু বন্ধুর হাতটা সহমর্মিতায় ধরতে পারছে না। ‘নাগরিক কবিয়াল’ এখন চাইলেও বিক্ষোভ, বিপ্লব অথবা প্রেমে সেই ‘তুমি’কে খুঁজে পাবেন না। যাদের পাবেন, তাদের এক হাতে মোবাইল আর অন্য হাতে ক্যালকুলেটর।

মহম্মদ আখলাককে যারা ‘গোমাংস খাওয়ার ‘অপরাধ’-এ পিটিয়ে মারল, যারা পড়শির পোশাক, খাদ্য ইত্যাদিতে ফতোয়া দেয় এবং না মানলে ফালাফালা করে দেয়, তারা তা কেন করে? তা হলে কি মানবমনের স্তরগুলি নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে? মানুষ ‘এটা’ নয়তো ‘ওটা’— দুই চরমের মাঝামাঝি কিছু ভাবতে পারছে না? আমাদের ইতিহাস, সাহিত্যে এমন অনেক চরিত্র আছে যাদের ‘নায়ক’, ‘খলনায়ক’ কোনও শ্রেণিতেই ফেলা যায় না। মনের সেই বৈচিত্র কি হারিয়ে গেল? তাই বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর উপর হওয়া অত্যাচারের সাক্ষী জেলখানার কুঠুরিতে দাঁড়িয়ে সেলফি তোলার দৃশ্যে কেউ বিচলিত হয় না, কিন্তু ধর্মের নামে, প্রথার নামে মানুষকে ডান্ডা তুলে ‘দণ্ড’ দিতে দু’দণ্ড লাগে না?

মা-বাবা শৈশব থেকে কারও সঙ্গে মিশতে না দিয়ে, অপেক্ষাহীন চাহিদার জোগান দিয়ে, পাঠ্যবইতে বেঁধে ফেলে সন্তানের সহৃদয়তা এবং মনুষ্যত্বকে মেরে দিচ্ছেন— এ তত্ত্বও অবহেলার নয়। কিন্তু কোথাও তো এই প্রবণতা, এই যন্ত্রায়নের যন্ত্রণায় একটা সীমারেখা থাকবে? না হলে মানুষের সুস্থ আবেগের জায়গা নিয়ে নেবে হয় অসুস্থ নির্বিকারত্ব, অথবা মৌলবাদের যুক্তিহীন আস্ফালন।

সরকার থেকে ঐতিহাসিক দিনগুলি উদ্‌যাপনের নির্দেশ আছে। হেড স্যরের মনে হয়, ও সব সময় নষ্ট। আর ছাত্রও নির্বিকার হতে শেখে। সম্প্রতি জাপান সরকার এক নির্দেশিকা জারি করেছে। দেশের পড়ুয়া এবং কর্মীদের নাকি কাউন্সেলরের পরামর্শ নিয়ে সপ্তাহে এক দিন কাঁদতে হবে। কারণ, পরিস্থিতির চাপে তারা অনুভূতিহীন হয়ে যাচ্ছে। এর পরও এই বিশ্বকে ‘সভ্য’ বলতে হবে? কাল যদি আমাদেরও সরকারি নির্দেশিকা মেনে দুঃখ পেতে বা আনন্দ করতে হয়, সে বেঁচে থাকাকে কি ‘জীবন’ বলা হবে?

নির্বিকারত্ব বা বিকার, দুটোই মানুষকে বৃহত্তর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একা করে দেয়। আমাদের পথঘাট কি ভবিষ্যতে নিজের মধ্যেই আটকে পড়া সেই অসংখ্য ‘একা’য় ভরে যাবে, যারা কারও জন্য ভাবে না অথবা যাদের জন্য কেউ ভাবে না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন