Pollution

আমরা কি পিছন দিকে হাঁটছি

দুঃখের কথা এই যে, কুম্ভমেলার অভিজ্ঞতাই পরিচিত, গঙ্গাসাগর ব্যতিক্রম। রাজ্য জুড়ে দেখা গিয়েছে, উৎসব শেষ হওয়ার পরে দূষণের জের থেকে যায় বহু দিন।

Advertisement

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৪:৩৮
Share:

কুম্ভমেলায় পর্যাপ্ত শৌচালয় না থাকায় শৌচকর্মের জন্য অনেকেই গঙ্গা এবং তার পাড়কেই বেছে নিয়েছিলেন। ফাইল ছবি।

সদ্য শেষ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ‘কুম্ভমেলা’। মেলা ঘিরে উৎসাহ এবং জনসমাগম— দুই-ই ছিল যথেষ্ট। যে কোনও উৎসব আনন্দের, সন্দেহ নেই। কিন্তু একই সঙ্গে কিছু দায়িত্ববোধের প্রশ্নও থেকে যায়। পরিবেশের প্রতি দায়িত্ব। সাম্প্রতিক কালে পরিবেশ দূষণের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে যে দায়িত্ববোধের বিস্মরণ চরম অন্যায়। অথচ দুর্ভাগ্য, কুম্ভমেলার মতো বিভিন্ন উৎসবের প্রতি যে আগ্রহ এই বঙ্গে দেখা যায়, উৎসব কালে এবং উৎসব-অন্তে মেলা ও সংলগ্ন অঞ্চলে পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে সাধারণত তার কণামাত্রও জোটে না।

Advertisement

এই বছর শুধুমাত্র শীতের ক’দিন পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় যত উৎসব এবং তদুপলক্ষে যে পরিমাণ মেলা আয়োজিত হয়েছে, এক উৎসবের রেশ কাটতে না কাটতেই অন্যটির সানাই বেজে উঠেছে এবং সেখানে যত জনসমাগম হয়েছে, তাতে অবিলম্বে উৎসবজনিত দূষণ বিষয়ে একটি সামগ্রিক ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত, গঙ্গাসাগরে এই বছর ‘গ্রিন ক্লিন’ মেলার আয়োজনে উদ্যোগী হয়েছিল প্রশাসন। প্লাস্টিকমুক্ত রাখতে দোকানগুলিতে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ বিলি করা হয়েছিল। আশার কথা। প্রশ্ন হল, এই পরিমাণ মনোযোগ এবং চিন্তাভাবনার অবকাশ অন্য স্থানীয় মেলাগুলি পায় কি? কল্যাণীর মাঝেরচর ঘাট এলাকায় বঙ্গ কুম্ভমেলার সমাপ্তির দু’দিন পরও মেলার মাঠ পরিষ্কার করা হয়নি। মাঠের মধ্যেই কোথাও নোংরা-আবর্জনা জড়ো করে তাতে আগুন লাগানো হয়েছে, পুজোর সামগ্রী অবহেলায় পড়ে থেকেছে গঙ্গার পাড়ে। হুগলির ত্রিবেণীতে আয়োজিত কুম্ভমেলায় পর্যাপ্ত শৌচালয় না থাকায় শৌচকর্মের জন্য অনেকেই গঙ্গা এবং তার পাড়কেই বেছে নিয়েছিলেন। দূষণের মাত্রাটি সহজবোধ্য।

দুঃখের কথা এই যে, কুম্ভমেলার অভিজ্ঞতাই পরিচিত, গঙ্গাসাগর ব্যতিক্রম। রাজ্য জুড়ে দেখা গিয়েছে, উৎসব শেষ হওয়ার পরে দূষণের জের থেকে যায় বহু দিন। রবীন্দ্র সরোবরের মতো স্থানে ছট পুজো বন্ধের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে পরিবেশবিদরা এই কথাটিই বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। জলে তেল, সিঁদুর, ফুল-মালা বিসর্জনের কারণে জলদূষণের যে বেলাগাম মাত্রা বৃদ্ধি ঘটে, সহজে তার থেকে মুক্তি মেলে না। প্রসঙ্গত, জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ এবং বিকল্প ব্যবস্থা সত্ত্বেও ২০১৯ সালে রবীন্দ্র সরোবর এবং সুভাষ সরোবরের মতো স্থানে ছটপুজো হয়েছিল, এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো। শুধু তা-ই নয়, যে প্রশাসন গঙ্গাসাগরকে দূষণমুক্ত রাখার সাড়ম্বর ঘোষণা করে, তারই একটি অংশ পরবর্তী বছরে রবীন্দ্র সরোবরে ছটপুজো করার বিশেষ আবেদন জানায় পরিবেশ আদালতে। আদালতের নির্দেশে সেই ভয়ঙ্কর অ-নিয়মে লাগাম পরানো গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু গঙ্গাদূষণ ঠেকানো যায়নি। বরং প্রশ্ন উঠেছে, সরোবর বাঁচানোর মূল্য কি গঙ্গাদূষণ? পুজো আর বিসর্জনের হাত থেকে নদীগুলোকে বাঁচানোর কাজটি এত দিনেও কেন করা গেল না?

Advertisement

বিকল্প ভাবনার নজির নেই তা নয়। বছর তিনেক আগের দক্ষিণ কলকাতার এক নামকরা পুজো বিসর্জনে ভিন্ন পথের দিশা দেখিয়েছিল। গত বছরেও একাধিক পুজো বিসর্জনে গঙ্গাকে এড়িয়ে জলদূষণের বিরুদ্ধে বার্তা দিয়েছে, গঙ্গার বদলে মণ্ডপেই প্রতিমা গলিয়ে ফেলা হয়েছে। ছটপুজোতেও অনেকে বাড়ির ছাদে, বাগানে, খোলা স্থানে কৃত্রিম জলাশয় তৈরি করে পুজো করেছেন। এই উদ্যোগগুলিকে প্রশাসনের তরফে যথেষ্ট উৎসাহ দেওয়া জরুরি ছিল। তেমনটা হয়নি। পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলি ব্যতিক্রমই থেকে গিয়েছে।

পুজোর সংখ্যা এবং আতিশয্য যত বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে দূষণমুক্তির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা অ-সম্ভব। কলকাতার ঘাটগুলিতে বিসর্জন আগের চেয়ে অনেক সুষ্ঠু, পরিবেশবান্ধব হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাতে আত্মতুষ্টির জায়গা নেই। গঙ্গাদূষণ রোধে জাতীয় পরিবেশ আদালত নির্দেশ দিলেও সর্বত্র তা সমান গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয় কি? যে সতর্কতা কলকাতার বড় ঘাটগুলিতে বিসর্জন-অন্তে দেখা যায়, জেলার দিকে তা চোখে পড়ে না। বিসর্জন মিটে যাওয়ার পরও হামেশাই গঙ্গার বুকে ফুল, মালা, পুজোর সামগ্রী ভাসতে দেখা যায়। দুর্গাপুজোর পর একাধিক গঙ্গার ঘাটে প্রশাসন পরিবেশবান্ধব বিসর্জনের ব্যবস্থা করলেও সাড়া মেলেনি। সাড়া যাতে মেলে, সেই চেষ্টাও যথাযথ হয়েছে কি? এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গঙ্গারতির নতুন আড়ম্বর। চতুর্দিক থেকে নদনদী, খালবিল আর তাদের সংশ্লিষ্ট বাস্তুতন্ত্রের উপরে অত্যাচার বেড়েই চলেছে।

উৎসবের সঙ্গে পরিবেশের এই বৈরী সম্পর্ক দেখে আশ্চর্য বোধ হয়। আমাদের উৎসবের যত আধুনিকতা, তা যেন কেবল তার বহিরঙ্গে। অন্তরে সেই গোঁড়ামি, অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর রীতি-রেওয়াজকে পুষে রাখার তাড়নাটি প্রবল। উৎসবের যা প্রকৃত অর্থ, সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলা, তার বিসর্জন হয়ে গিয়েছে বহু কাল আগে। উৎসব এখন এক শ্রেণির হুজুগ এবং অন্যদের যন্ত্রণার কারণ। উৎসব মানে যে সামাজিকতার উদ্‌যাপন, সেই সামাজিকতার বোধটাই কি তবে পুরোপুরি হারিয়ে ফেললাম আমরা? আধুনিকতার বহিরঙ্গ আকর্ষণে দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে আমরা কি ক্রমশ পিছনে হাঁটছি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন