Medical Students

শূন্যের ভিতরে এত ডাক্তার

অনেকে বিচলিত হচ্ছেন এই ভেবে যে, পরীক্ষায় শূন্য পাওয়া ছাত্রছাত্রীরাও এর পর এমডি/এমএস করবেন! ঠিকই, কিন্তু তাঁদের আশ্বস্ত করে জানাই, ব্যাপারটার ভয়াবহতা আর একটু বেশি।

Advertisement

বিষাণ বসু

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৪:৫৯
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

সদ্য দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের একটি ঘোষণায় কিঞ্চিৎ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রক ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিল-কে এই মর্মে বার্তা পাঠিয়েছে, যাতে পোস্টগ্র‍্যাজুয়েট মেডিক্যাল এন্ট্রান্স পরীক্ষার যোগ্যতামান কমিয়ে শূন্য পার্সেন্টাইলে নামিয়ে আনা হয়। পূর্বতন মেডিক্যাল কাউন্সিল, যা নির্বাচনের মাধ্যমে তৈরি হত, তাকে সরিয়ে তৈরি হয়েছে বর্তমানের এই মেডিক্যাল কমিশন, যেখানে অধিকাংশ সদস্যই সরকার কর্তৃক নির্বাচিত। সুতরাং, এই নির্দেশ যে যথাবিহিত গুরুত্বসহকারে পালিত হবে, তাতে বিশেষ সন্দেহ নেই।

Advertisement

গত কয়েক বছরের মধ্যে একাধিক বার এই যোগ্যতামান কমিয়ে আনা হয়েছে। তখন যোগ্যতামান কমানোর চেয়ে বেশি হইচই হয়েছে সংরক্ষিত শ্রেণির যোগ্যতামান কেন বেশি কমানো হল, তা নিয়ে। এ বারে সরকারবাহাদুর ল্যাঠা চুকিয়ে দিলেন। শূন্য পার্সেন্টাইল-ই যথেষ্ট।

অনেকে বিচলিত হচ্ছেন এই ভেবে যে, পরীক্ষায় শূন্য পাওয়া ছাত্রছাত্রীরাও এর পর এমডি/এমএস করবেন! ঠিকই, কিন্তু তাঁদের আশ্বস্ত করে জানাই, ব্যাপারটার ভয়াবহতা আর একটু বেশি। সকল পরীক্ষার্থীর পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর বেশি থেকে কম, এই ক্রমানুসারে সাজিয়ে কষা হয় পার্সেন্টাইল-এর হিসাব। এই হিসাব অনুসারে নব্বই(তম) পার্সেন্টাইল-এর অর্থ এমন নয়, যে, সেই ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষায় নব্বই শতাংশ নম্বর পেয়েছেন— এর অর্থ, নব্বই শতাংশ পরীক্ষার্থীই সংশ্লিষ্ট ছাত্র/ছাত্রীর চেয়ে কম নম্বর পেয়েছেন। শূন্য পার্সেন্টাইল-এর অর্থ, কেউই সেই পরীক্ষার্থীর চেয়ে কম নম্বর পেতে সক্ষম হননি। পোস্টগ্র‍্যাজুয়েট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় যে-হেতু ভুল উত্তরে চড়া হারে নেগেটিভ মার্কিং-এর বন্দোবস্ত থাকে, সে-হেতু পরীক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর শূন্যেরও নীচে নেমে যেতে পারে। এ বছর যেমন, একেবারে শেষ স্থানটি দখল করেছেন যিনি— অর্থাৎ যিনি শূন্য পার্সেন্টাইল-এ আছেন— তাঁর প্রাপ্ত নম্বর মাইনাস চল্লিশ। সরকারি নির্দেশানুসারে তাঁর সামনেও খুলে যাচ্ছে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরজা।

Advertisement

এমন নির্দেশের তাৎপর্য নিয়ে বিশদ আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের রাজত্বে এখন চাইলেই মেডিক্যাল কলেজ তৈরির ছাড়পত্র মিলছে— সরকারি ও বেসরকারি, দুই ক্ষেত্রেই। প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই পরিকাঠামোর দিকটা খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে না। সরকারের নতুন নতুন মেডিক্যাল কলেজ খোলার তাড়নায়, অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট পরিমাণ অধ্যাপক তো দূর, বাড়িঘরদোরই ঠিকঠাক নেই, হাসপাতালটিও মেডিক্যাল শিক্ষার উপযুক্ত মানের নয়, কিন্তু ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে পরিস্থিতি তো আরও সরেস। স্বাভাবিক ভাবেই, এই পরিস্থিতিতে ডাক্তারি শিক্ষার যে প্রত্যাশিত গুণগত মান, তা ব্যাহত হচ্ছে। পরিমাণ বাড়ানোর নামে মানের সঙ্গে সাঙ্ঘাতিক আপস করা হচ্ছে— বলা ভাল, মান ব্যাপারটাকে ইদানীং ভুলেই যাওয়া গিয়েছে। আর, এই রাজ্যে, বর্তমান সময়ে, রাজনৈতিক দাদাগিরি ও দুর্নীতির চোটে, মান-রক্ষার যেটুকু সম্ভাবনা ছিল, সে সব জলে ভেসে গিয়েছে।

সঙ্কট শুধু এমবিবিএস পঠনপাঠনের স্তরে আটকে নেই। পরিকাঠামো যেমনই হোক, অধ্যাপকের অভাব যে মাত্রারই হোক না কেন, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের ইচ্ছায় কলেজগুলোতে স্নাতকোত্তর স্তরের পাঠক্রম পড়াতে চাওয়ার ঢল নেমেছে। সুতরাং, সরকারি ও বেসরকারি, উভয় ক্ষেত্রেই এমডি/এমএস-এর আসনসংখ্যা বিপুল ভাবে বেড়েছে, বেড়েই চলেছে।

এক দিকে এই নতুন ব্যবস্থার ফসল নব্য-চিকিৎসককুল, আর এক দিকে পোস্টগ্রাজুয়েটে অজস্র আসন— মেডিক্যাল কলেজগুলোর তরফে ছাত্রছাত্রী পাওয়ার আকুল চাহিদার সাপেক্ষে যোগ্যতামান পেরোতে পারেন, এমন ছাত্রছাত্রীর জোগান যে কম হবে, এ তো বলা বাহুল্য। সুতরাং, চাহিদা-জোগানের মধ্যে সাযুজ্য আনার স্বার্থে, সরকারবাহাদুর যোগ্যতামান নামিয়ে আনছিলেন। এ বার যোগ্যতামান ব্যাপারটাই তুলে দিলেন। পরীক্ষায় বসলেই ভর্তি হতে পারার সুযোগ, ব্যস!

সস্তার ‘চাইনিজ়’ পণ্য ব্যবহারের অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই কম-বেশি আছে। অনেক সময়েই সে জিনিস ব্যবহারের অযোগ্য, কিন্তু মাঝেমধ্যে কয়েকখানা দিব্যি টিকে যায়। ডাক্তারির ক্ষেত্রে অনুরূপ অনুষঙ্গ ব্যবহার করাটা দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু এ ক্ষেত্রে উপায়ই বা কী! এই ব্যবস্থায় উৎপাদিত ডাক্তার, কিছু কিছু ক্ষেত্রে, মূলত সংশ্লিষ্ট ছাত্র/ছাত্রী-র ব্যক্তিগত উৎকর্ষের কারণেই, সুচিকিৎসক হবেন— কিন্তু সার্বিক ভাবে চিকিৎসকের গুণগত মান নির্ভরযোগ্য হবে না, হতে পারে না। সমস্যা হল, সস্তার পণ্য খারাপ বেরোলে দু’দিন ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া যায়। চিকিৎসকদের লাইসেন্স কিন্তু সারা জীবনের জন্য।

আশঙ্কা হয়, এর পর উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রীরা এই অসম্পূর্ণ প্রশিক্ষণে তুষ্ট না থেকে প্রথম বিশ্বের দিকে দৌড়বেন যথাযথ শিক্ষার আশায়। অধিকাংশই থেকে যাবেন প্রথম বিশ্বের দেশে। যাঁরা ফিরবেন, তাঁরাও যুক্ত হবেন পাঁচতারা হাসপাতালে। আর, জ়িরো পার্সেন্টাইলে থেকেও বিশেষজ্ঞ হওয়া ডাক্তাররা ‘নিরুপায়’ হয়ে যোগ দেবেন সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায়, অবশ্য সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা বলে তখনও যদি কিছুর অস্তিত্ব থাকে, তবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন