BJP

সাত বছরে রাষ্ট্র যা যা পেল

গত সাত বছরে বহু জনবিরোধী ‘সরকার-নির্মিত’ প্রলয় মানুষকে এ কথা বুঝতে বাধ্য করেছে।

Advertisement

শ্রীদীপ

শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০২১ ০৪:৫৬
Share:

দূরত্ব যত কমে, আলেয়া ততই অলীক হয়। ‘সুদিন’ আর ‘পাঁচ ট্রিলিয়ন অর্থনীতি’র সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা সে রকম। দূর থেকে দেখতে-শুনতে অদ্ভুতুড়ে লেগেছিল। সাত বছর পর, যখন বেঁচে থাকাটাই অনিশ্চিত, তখন সুদিনের ‘জুমলা’র তুলনায় সুস্বাস্থ্যের অভাবের বাস্তব চিত্রটা তেলের ঊর্ধ্বগামী দামের চেয়েও বেশি খোঁচা মারে।

Advertisement

আসন্ন ‘অচ্ছে দিন’-এর বুলি আওড়ে, সবার সঙ্গে সবার বিকাশের মঙ্গলময় মন্ত্রপাঠ করে, শেষাবধি সবাইকে নিয়ে ডোবার এই রাজকাহিনি সত্যিই বিরল। তা জনাদেশের অবমাননা, মানবিকতা-বিমুখও। মানবাধিকার, বাক্‌স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সার্বিক উন্নয়ন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মান, রুটি-রুজি ইত্যাদি সকল আকাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক শর্তগুলি আলেয়ার মতোই দূরবর্তী হয়ে গিয়েছে। সাংবিধানিক অধিকারকে পরাভূত করে, প্রাতিষ্ঠানিক বিপর্যয় সুনিশ্চিত করে, শাসক যে ঔদ্ধত্য ও ঔদাসীন্যে ভরপুর, সেখানে নাগরিকের জীবনের বিন্দুমাত্র দাম নেই। করোনার প্রকোপ ও বিভ্রান্ত টিকা-নীতি এই কঠোর সত্যটিকেই মেনে নিতে শেখায়।

গত সাত বছরে বহু জনবিরোধী ‘সরকার-নির্মিত’ প্রলয় মানুষকে এ কথা বুঝতে বাধ্য করেছে। অপরিকল্পিত নোটবন্দি ও লকডাউন গরিবকে ভুগিয়ে মেরেছে, আচমকা পতন ঘটেছে একাধিক নির্বাচিত রাজ্য সরকারের, মাসের পর মাস রাজধানীর সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকার পর ‘পরজীবী’ তকমা জুটেছে প্রতিবাদী কৃষকদের। মানুষ নিমেষে ভুলে গিয়েছে উন্নাও-হাথরসের নৃশংসতা, গোগ্রাসে গিলেছে বালাকোটের ‘দেশাত্মবোধক’ আখ্যান। হয়েছে অজস্র রাজদ্রোহের মামলা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ, গণপিটুনি ও ছাত্র পিটুনি, প্রতিবাদের অধিকার কেড়ে নিয়ে আজ্ঞাধীন করার চেষ্টা। এবং, এ সবই এত চরম মাত্রায় পৌঁছেছে যে, সর্বোচ্চ আদালতকে মনে করিয়ে দিতে হয়েছে: সরকারের সমালোচনা মানেই রাজদ্রোহ নয়।

Advertisement

আপাত-নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলির অধঃপতন ঘটিয়ে আরও বেশি করে শাসকের কথা মেনে চলতে বাধ্য করা হয়েছে। মন্দির ‘ওখানেই’ বানানোর আইনসিদ্ধ বিধান মিলেছে, অতিমারির দুর্দিনেও কোটি টাকা খরচ করে ঐতিহ্যবাহী ইমারত ভেঙে রাজমহল নির্মাণ চলেছে, ফ্রান্স থেকে দুর্নীতি জর্জরিত যুদ্ধবিমান উড়ে এসেছে, বিতর্ক সত্ত্বেও ইলেক্টরাল বন্ড চালু থেকেছে, এবং সংখ্যালঘুকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক সাব্যস্ত করার চেষ্টা জারি রয়েছে। উন্নয়ন তলানিতে ঠেকলেও চলছে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের উগ্র আগ্রাসী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি। হিংসা ও তার প্রদর্শনী জোরদার হচ্ছে। প্রশ্ন তোলা নাগরিক তাই ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ হচ্ছেন। কাশ্মীরে আরও কিছু মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে কী আসে যায়! প্রশ্রয় পাচ্ছে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’। ধর্মগুরুরা মানুষকে মাতিয়ে রাখছেন ভক্তির জালে। দেশবাসীও উৎসাহভরে গোমূত্র সেবন করছেন, গোবর মেখে যজ্ঞ করছেন, থালা বাজিয়ে বা বাতি জ্বালিয়ে করোনা মোকাবিলায় জাগ্রত হচ্ছেন।

ভক্তির সামনে যুক্তি টেকে না, যুক্তি দিয়ে ভক্তি খণ্ডনও করা যায় না। অতএব, ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ দেশ যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়েও তাঁর মনের কথা শুনে বিগলিত হচ্ছে, ‘নমো নমো’ ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে তাঁর অতিমানবিক সত্তা। আমরা সাক্ষী হচ্ছি তাঁর আত্মনির্ভরতার বাণীর, বাক্‌রুদ্ধ অশ্রুর এবং বুদ্ধিজীবীদের প্রতি অবজ্ঞার। এ এক নৃশংস নয়া ভারত। না আছে জীবনের মর্যাদা, না আছে মরণের সম্ভ্রম। ভাসমান বা ভস্মীভূত শব, কিছুই এখানে রাষ্ট্রীয় করুণার অংশীদার নয়। করোনায় সংক্রমিত অক্সিজেন-মরিয়া মানুষ রাষ্ট্রীয় সহানুভূতির দাবিদার নন। বরং, এহেন অবস্থাতেও নাগরিকের ক্ষোভ দেশদ্রোহিতার সমতুল। শাসক দল উদ্বিগ্ন, মৃত্যু-দৃশ্যে যদি রাষ্ট্রনেতার ভাবমূর্তিতে দাগ লাগে! মানুষের প্রাণ গেলেও অক্সিজেন ও টিকার চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় অন্য কিছু। ভোটের পশ্চিমবঙ্গে আঠারো বার উড়ে এসে নির্বাচনী জনসভায় মানুষের ঢল দেখে অভিভূত হন তিনি, যদিও তাঁকে এক বারও হাসপাতালে দেখা যায় না। আর, যখন তাঁর সঙ্কল্পের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি, তখন তিনি বেপাত্তা। শোনা যায়, তিনি চেষ্টা করছেন। দেখা যায়, সেন্ট্রাল ভিস্টা সমাপনের সময়সীমা থাকলেও টিকাকরণের নেই। তিনি কি দেখছেন না? অবশ্য, তিনি যে সমালোচনার ঊর্ধ্বে।

সমাজ বলতে যদি সামাজিক দূরত্ব বোঝায়, তবে তাকে এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে এই রাষ্ট্র। আজ রাষ্ট্রের অবস্থান সুস্থ ও অসুস্থ নাগরিকের থেকে বহু দূরে। তা আজ আলেয়া। প্রয়োজনে তাকে পেতে চাইলে পাওয়া যায় তার নিশ্চিহ্নতার প্রমাণ। মানুষের দুঃখ-কষ্ট, জীবন-মৃত্যু, অসুখবিসুখ স্পর্শ করে না এই বধিরকে। মৃত্যু এখানে পরিসংখ্যান— বেঠিক গণনামাত্র। দিনে আরও কিছু হাজার? অক্ষমতা আর নিস্পৃহতা মিলিয়েই এই নিশ্চুপ প্রত্যাখ্যান।

সমাজতত্ত্ব বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন