ঘর-বাইরের মিলনে ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ সমাজমনে স্থায়ী আসন পেয়েছে
Dance

নৃত্যে যখন মুক্তির রূপ

বিশ্বভারতী সম্প্রতি ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ ও পাঠক্রম চালু করেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় নৃত্যনাট্য প্রযোজনার সময় নানা দেশের নানা শৈলীর নাচকে স্বাগত জানিয়েছেন।

Advertisement

শৈবাল বসু

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৩ ০৪:৩৫
Share:

নিরুপম: রবীন্দ্রনৃত্যে মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার ও রঞ্জাবতী সরকার। —ফাইল চিত্র।

সেটা ১৯৬১ সাল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে রবীন্দ্র-শতবর্ষের অর্ঘ্য হিসাবে দেবকী বসু ছবি তৈরি করলেন, পূজারিণী। শ্রীমতীর ভূমিকায় অভিনয়ের শেষ দৃশ্যে নটীর নাচটি নাচলেন মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার। আমরা দেখি, শান্তিনিকেতনে নাচের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মৃদঙ্গ বা পাখোয়াজ নয়, তবলার দ্রুত বোলের সঙ্গে ঘুঙুরের তীব্র ঝনৎকার একটি শান্ত বিন্দুতে মিশে যায় এই নাচের সূচনায়। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বাঁশির সঙ্গে বেজে ওঠে সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে ‘নৃত্যরসে চিত্ত উছল’ হয়ে বেজে ওঠার গানটি। রবীন্দ্রগানের টেক্সট-এর সঙ্গে শুরু হয় নাচ।

Advertisement

আর তখনই যেন শিল্পীর ঈষৎ উত্তোলিত হাতের ভঙ্গিতে দেখা দেয় রবীন্দ্রনাথের আঁকা খুব পরিচিত নারীমূর্তির আভাস। আমাদের মনে পড়ে যায় শঙ্খ ঘোষের ‘রেখা নাট্যের নটী’ নিবন্ধটির কথা, যেখানে লেখক মনে করিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথের রেখাশিল্পের শরীরে কী ভাবে আভাস রচনা করে নৃত্যশিল্পের এক সম্ভাব্য প্রতিমা। নটীর পূজা-র প্রথম অভিনয়ের পঁয়তাল্লিশ বছর পরে মঞ্জুশ্রীর নৃত্যরচনায় যেন নির্মিত হয় রবীন্দ্রগানের সঙ্গে নৃত্যের এক অন্যতর বয়ান, যা বিগত চার দশকে শান্তিনিকেতনে চলতে-থাকা নাচের ধারা থেকে অনেকটাই আলাদা। কিন্তু তা কি একেবারেই আলাদা তাঁর নিজের গানের সঙ্গে নৃত্য বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রায় থেকে? এই যে ব্রাহ্মসমাজ ও প্রথম যুগের শান্তিনিকেতন আশ্রমে প্রায়-বর্জিত তবলা, এই যে ঘুঙুরের শব্দ, এই যে শাস্ত্রীয় নাচের মেধাবী চলন থেকে চিত্রকলার প্রায়-বিমূর্ত প্রতিমায় মিশে যাওয়া নাচ— এ কি রবীন্দ্রনাথের নৃত্যকল্প থেকে খুবই দূরের? “আমার গানের সঙ্গে যখন নাচবি, তখন সেই (শাস্ত্রীয়) কাঠামোর ওপরে গানের ভাব অনুযায়ী প্রতিমা গড়ে তুলবি,” সুকৃতি দেবীকে বলছেন রবীন্দ্রনাথ (বহিল আনন্দধারা, ১৯৯৯)। মনে পড়ে, নিজের গান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন কাঠামো ও তার উপরে শিল্পীর প্রতিমা নির্মাণের কথা। কিন্তু ‘রবিবাবুর গান’ যখন ক্রমে ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ হয়ে উঠল, সেই নতুন নামকরণটির কাছে আমরা সানন্দে নিজেদের সমর্পণ করলাম। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট কলাবিদ্যা হিসাবে ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ শব্দটি কিছুটা সংশয়ী করে তোলে আমাদের। রবীন্দ্রনাথ তো নাচিয়ে ছিলেন না, এবং যে অর্থে তিনি সঙ্গীত রচনা করেছেন সে অর্থে ‘নাচ’ রচনা করেননি। অথচ পাড়ায়-প্রতিযোগিতায়-প্রতিষ্ঠানে ধীরে ধীরে ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ শব্দটি কবে যেন স্থায়ী আসন পেয়ে গেল, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ শব্দটির সমান উচ্চতায়।

রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটি তথাকথিত ‘শুদ্ধ’ গায়ন নির্মাণের জন্য ১৯৪৪ সাল থেকে বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতি একাধিপত্য প্রয়োগ করেছিলেন। এমনকি দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া গানকে নাকচ করার সময় তাঁরা ওঁকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কাগজে রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে উপযোগী যন্ত্রের একটি অবিকল্প মুদ্রিত তালিকা। সঙ্গীত সমিতির আধিপত্যের এ ধরনের বয়ানে কুণ্ঠিত হয়ে রবীন্দ্রগান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকেন এ দেশের অনেক গুণী গাইয়ে। আন্তর্জাল বা ইউটিউবের মতো মাধ্যমগুলি আছে বলে আমরা বেশ বুঝে নিতে পারি, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ নামের যে মূর্তিটি বিশ্বভারতীর সঙ্গীত সমিতি অনুমোদিত রেকর্ড-ক্যাসেট-সিডি থেকে ক্রমশ উঠে দাঁড়িয়েছে, তার চেহারা রবীন্দ্রনাথ বা দিনেন্দ্রনাথের গাওয়া গানগুলির রূপটি থেকে অনেকটাই দূরের।

Advertisement

ফিরে যাই নাচের প্রসঙ্গে। রবীন্দ্র-শতবর্ষে নির্মিত যে নাচের কথা দিয়ে এ লেখা শুরু, সেই নটীর পূজা-র প্রথম অভিনয়ের জন্য নাচ তৈরি হয় ১৯২৬ সালে শান্তিনিকেতনে। প্রতিমাদেবী ‘পূজারিণী’ কবিতাকে নির্ভর করে একটি মূকাভিনয় করাবেন জেনে রবীন্দ্রনাথ লিখে ফেলেন এই নাটক, যার অভিনয়ের অন্তিম মুহূর্তটি মিশে যাচ্ছে একটি নাচে। আমাদের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে সেটিই প্রথম নাচ। মণিপুর থেকে আসা নৃত্যশিক্ষক নবকুমার সিংহের শেখানো কিছু ভঙ্গি আর প্রতিমা ঠাকুরের অভিনয়-নির্দেশ নিয়ে নেচেছিলেন নন্দলাল-কন্যা গৌরী বসু।

ঠিক তার পাঁচ বছর পর যখন কলকাতায় নটীর পূজা-র অভিনয় হওয়ার কথা, তখন শ্রীমতী চরিত্রের জন্য এই নাচকে নতুন করে তৈরি করার আদেশ পেলেন শান্তিদেব ঘোষ। তাঁর বয়ানে পাই, তিনি নাচটি তৈরির সময় পায়ের ছন্দের কাজের প্রতি বেশি জোর দিয়েছিলেন। কেবল মণিপুরির জায়গায় এ বার এল কথাকলি আর বাউল নাচের মিশেল। এই বর্ণনা পড়ে নাচটির যে ছবি আমাদের চোখে ভেসে আসে তা জোরালো আঘাত পায় নিউ থিয়েটার্স-এর উদ্যোগে নির্মিত এই অভিনয়ের চলচ্চিত্ররূপটি দেখে। আমরা কিন্তু প্রায় মাথা-নিচু-করা, অত্যন্ত মন্থর একটি শরীরী অভিনয়ের মধ্যে কথাকলি, মণিপুরি, বাউলের ‘নাচ’ বলতে যা বুঝি তা দেখতে পাই না ছায়াছবিতে ধরা নটীর পূজা-য় ললিতা সেনের নিবেদনে। রবীন্দ্র-শতবর্ষের পর থেকে বাঙালি সমাজে রবীন্দ্রনৃত্য বলতে ঈষৎ মণিপুরি কথাকলির মিশেল, বাটিকের উত্তরীয়, ঘুঙুরের অলঙ্করণবর্জিত চলন, এই সব কিছু খুব জরুরি চিহ্ন হিসাবে গণ্য হল। ঠিক যেমন ‘রাবীন্দ্রিক’ শব্দটা কিছু বিশেষ ভঙ্গি আর সাজকে অবলম্বন করে একটা প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক চিহ্ন হয়ে উঠল বাঙালি সমাজে।

একক স্থাপত্যের মতো এই অনড় কঠিন গড়ন কিন্তু বার বার দ্রব হয়েছে নানা সৃজনমূলক নৃত্য নির্মাণ ও নিরীক্ষার ধারায়। যে অমলা নন্দীর মায়ার খেলা-র অভিনয় দেখে একদা মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তিনি (তখন অমলাশঙ্কর) ও উদয়শঙ্কর ১৯৬১ সালেই তাঁদের নিজস্ব শৈলীতে তৈরি করলেন ‘সামান্য ক্ষতি’-র নৃত্য। সেই প্রযোজনায় পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও উস্তাদ আলি আকবর খান নানা ভারতীয় ধ্রুপদী ও লোকসঙ্গীতের যন্ত্র ব্যবহার করে এক অন্যতর আবহ নির্মাণ করলেন। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশনায় অভিনীত প্রথম চণ্ডালিকা প্রযোজনায় (১৯৩৯) মায়ের ভূমিকায় সাড়া জাগানো নৃত্য-অভিনয় করেছিলেন মৃণালিনী স্বামীনাথন, উত্তরকালে তিনি নিজের প্রতিষ্ঠান ‘দর্পণা’ থেকে কন্যা মল্লিকা সারাভাইকে সঙ্গী করে ভরতনাট্যমের নানা স্তরের অভিনয়শৈলী ব্যবহার করে এক অনুপম চণ্ডালিকা তৈরি করলেন। সেই প্রযোজনার পোশাকে ব্যবহার করলেন দক্ষিণ ভারতের মোটা সুতির শাড়ি আর লোকসমাজের গয়না। ঠিক তার পাশাপাশি এই বাংলায় মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার স্পষ্ট করলেন তাঁর ‘নবনৃত্য’ আন্দোলনের ধারণাটি, তাঁর বহু-অভিনীত প্রযোজনা ‘তোমারি মাটির কন্যা’-তে ব্যবহার করলেন মণিপুরের প্রাক্‌-বৈষ্ণব যুগের মহিলা পুরোহিতদের (মাইবি) নাচের আঙ্গিক। সেই নির্মিতি দেখে নির্দেশকের সঙ্গে সঙ্গে টেক্সটকে নতুন করে পাঠ করলাম আমরা। এঁরা কিন্তু খুব স্পষ্ট আর সচেতন ভাবেই এড়িয়ে গেলেন শান্তিনিকেতনের শৈলী ও সজ্জা, কিন্তু কোথাও সরে গেলেন না রবীন্দ্রনাথের থেকে, বরং শান্তিনিকেতনের প্রযোজনাগুলির পৌনঃপুনিকতার বাইরে আমরা নতুন পাঠ ও ব্যাখ্যান পেতে শুরু করলাম টেক্সট-এর, এমনকি নৃত্যেরও।

বিশ্বভারতী সম্প্রতি ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ শিরোনামে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ ও পাঠক্রম চালু করেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় নৃত্যনাট্য প্রযোজনার সময় নানা দেশের নানা শৈলীর নাচকে স্বাগত জানিয়েছেন। শেষ বয়সের এই নতুন সাধনায় রবীন্দ্রনাথ জন্ম দিয়েছিলেন এক বহমান ধারার, যে ধারায় নানা নদীর নানা স্রোত এসে মিশতে পারে। রবীন্দ্রপ্রয়াণের পরবর্তী সময়কালে আমরা লক্ষ করেছি বিশ্বভারতীর পড়ুয়া হিসাবে এসে কেউ কেউ যেমন রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করে নিজের পরিসরে নিজের ব্যাখ্যানে নাচ তৈরি করেছেন, তেমনই বাইরে থেকে শাস্ত্রীয় নাচ শিখে এবং শান্তিনিকেতনের বাইরে সেই নাচকে আশ্রয় করে খুবই আগ্রহ-জাগানো রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্য তৈরি করে, উত্তরকালে বিশ্বভারতীতে শিক্ষকতাসূত্রে এসে কেউ দিয়েছেন শান্তিনিকেতনে প্রচলিত ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ শব্দটিকে এক নতুনতর মার্জিত আকার। সেই নতুন ধাঁচের প্রযোজনা কিন্তু তৈরি হয়েছে শিল্পীর একক উদ্যোগে, বিশ্বভারতীর বাইরে।

অধুনা প্রাচীর-ঘেরা যে বিশ্বভারতী রবীন্দ্রনাথের চিরকালের শঙ্কার একমাত্রিক জাতীয়তাবাদের মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাতে শঙ্কা হয় যে শেষে বিশ্বভারতীর সইসাবুদ করা নাচটিই কেবল ‘রবীন্দ্রনৃত্য’ নামে একক ও অদ্বিতীয় বয়ান হয়ে উঠবে কি না, আমাদের নৃত্যরচনার নানা ছন্দ বিশ্বনাচের কেন্দ্র থেকে সরে যাবে কি না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন