কোনও আর্থিক পরিষেবার ক্ষেত্রে শতকরা একশো ভাগ স্ট্যান্ডার্ডাইজ়েশন বা প্রমিতকরণ না থাকার পরিণাম কী হতে পারে, তার অন্যতম উদাহরণ বিমা ক্ষেত্র। ‘ক্লেম সেটলমেন্ট’ বা দাবি নিষ্পত্তি নিয়ে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের বহর দেখে বোঝা যায় যে, একটা বড়সড় গোলমাল রয়েছে। মানুষ বিমা কিনে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচার পথ খোঁজেন। ও-দিকে, আগে বিমা ক্ষেত্রে নানা কারণে দাবি নিষ্পত্তি সংক্রান্ত অসুবিধার খবর মাঝেমধ্যে পাওয়া যেত— এখন তা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং, এই বিপত্তির মূলে রয়েছে সার্বিক প্রমিতকরণের অভাব।
বিমা ক্ষেত্রে ‘ইনশিয়োরেন্স ক্লেম সেটলমেন্ট রেশিয়ো’ বা বিমার দাবি নিষ্পত্তির অনুপাত একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। সাধারণ মানুষ কোনও বিমা পলিসি কেনার আগে দেখে নেন, সেখানে ‘ক্লেম’ বা দাবি দাখিল করার পদ্ধতি ঠিক কেমন, কত স্বচ্ছ ভাবে তাঁর দাবির নিষ্পত্তি হতে পারে। নিষ্পত্তির অনুপাত ভাল হলে গ্রাহকের কাছে সদর্থক বার্তা পৌঁছয়। কাজেই, ক্লেম সেটলমেন্ট রেশিয়ো সাধারণ ক্রেতাকে নির্দিষ্ট বিমা সংস্থা বিষয়ে কিছু তথ্য দেয়— অন্তত, তা দেওয়ার কথা। কিন্তু, তা দিচ্ছে কি?
এই সংশয়ের একেবারে গোড়ায় রয়েছে দাবি নিষ্পত্তির বিজ্ঞাপন নিয়ে খটকা। ‘ক্লেম’ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনে দেওয়া তথ্য, এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইনশিয়োরেন্স রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়া (আইআরডিএআই)-র কাছে পেশ করা তথ্য অভিন্ন নয়। অভিযোগ, কয়েকটা সংস্থা তাদের নিষ্পত্তির হার নিয়ে একপেশে প্রচার চালিয়েছে। সরকারি ভাবে হিসাবনিকাশের জন্য যে তথ্য জমা পড়ে, তার সঙ্গে এ সবের পুরোপুরি মিল নেই, এমনই বলা হচ্ছে। সংবাদে প্রকাশ যে, এই জাতীয় বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন আইআরডিএআই-ও।
এই অমিল বা ফারাক তৈরি হয় নিষ্পত্তির সংখ্যা হিসাবের একাধিক পদ্ধতি থাকার কারণে। তা আরও হয়েছে এই প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট স্ট্যান্ডার্ডাইজ়েশন বা প্রমিতকরণ বিধি না থাকার ফলে। বিমা ক্ষেত্রের একাংশ শুধু ‘পেয়েবল’ (যে প্রিমিয়াম পলিসি গ্রাহক দিয়ে থাকেন) নিজেদের গুনতির মধ্যে রাখে। যে সব ‘ক্লেম’ খারিজ হয়েছে বা ‘বিচারাধীন’, সেগুলো বাদ পড়ে। কোনও কোম্পানির জন্য আবার ‘অ্যাসেসড’ বা ‘রিপোর্টেড’ দাবির আলাদা ব্যবহার। এর ফল কী হতে পারে, সহজেই অনুমেয়।
২০২৩-২৪ সালের একটা পরিসংখ্যানের কথা ধরা যাক। সেখানে মোট ‘ক্লেম’-এর প্রায় ৮৩ শতাংশ নিষ্পত্তি হয়েছিল দেখা যাচ্ছে, আর প্রায় ১১% দাবি খারিজ করা হয়েছিল। অবশ্য খারিজ করার যথাযথ কারণ থাকতে পারে। যেমন, ভুল নথি দেওয়া বা পলিসির শর্তাবলির বাইরে থাকা কারণ খতিয়ে দেখা হয়নি। আর ৬% ক্লেম (সেই বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত) বকেয়া বা বিচারাধীন ছিল। তবে, এগুলোর অধিকাংশ ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট পরিমাণের। গ্রাহকরা যদি নিষ্পত্তির পরিসংখ্যান দেখে অভিমত গঠন করেন, তা হলে ‘মার্কেটিং’ নামক খেলার হাত থেকে তাঁদের বাঁচতে হবে। এর জন্য দরকার সমগ্র বিমা ক্ষেত্রের এক নিয়মের বাঁধন।
বিমা গ্রাহকরা কী ভাবে পলিসি কিনছেন, তার হদিস রাখা দরকার। এই জন্য জনসংযোগ সংক্রান্ত নীতির বক্তব্য সহজবোধ্য তো হতেই হবে, সেই সঙ্গে সরকারি নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যও থাকা চাই। অডিট করা হিসাব যেন কোনও সংস্থার মার্কেটিং বিভাগ নিজেদের সুবিধামতো সাজিয়েগুছিয়ে না নেয়। অধিকাংশ মানুষই বিজ্ঞাপন দেখেন। অনুপাত কত, কত টাকার মোট দাবি নিষ্পত্তি হয়েছে ইত্যাদির বিষয়ে খোঁজ নেন, কারণ সেগুলি সহজে পাওয়া যায়। কিন্তু, কত জন বা নিয়ন্ত্রকের প্রকাশিত জটিল তথ্যাবলি ঘেঁটে দেখতে বা জানতে চান যে, সংশ্লিষ্ট বিমায় খারিজের অনুপাত কেমন।
বিমা, বিশেষত স্বাস্থ্য বিমার ক্ষেত্রে তিনটে ইংরেজি শব্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে— ডিনাই, ডিলে আর ডিফেন্ড। সহজ বাংলায়— খারিজ করা; বিলম্ব করা; এবং নিষ্পত্তির সময় গ্রাহকের স্বার্থের বদলে সংস্থার স্বার্থ আগে দেখা। অভিযোগ যে, বহু সংস্থাই এই তিনটি নীতি অবলম্বন করে চলে। এই জাতীয় বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ আইআরডিএআই-কে উপযুক্ত মাপকাঠি আনতে হবে। এমন অনুরোধ নতুন নয়, অন্তত স্বাস্থ্য বিমার পরিসরে। সারা দেশের জন্য এক নিয়ম থাকা প্রয়োজন, না হলে নানা অসঙ্গতি দেখা দেবে। ইতিমধ্যে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কড়া বক্তব্য এসেছে। সেটা অবশ্যই সদর্থক। সাধারণ গ্রাহক হিসাবে অনেকেই চাইবেন যে, স্বাস্থ্য বিমা ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রেও ওই ‘একই সূত্রে গাঁথা’-র নীতি চালু হোক। অর্থাৎ, গাড়ি বা ব্যক্তিগত দুর্ঘটনা— কোথাও যেন গ্রাহকের অসুবিধা না হয়। সঠিক ভাবে দাখিল করা ‘দাবি’ যেন খারিজ না হয়।
জন গ্রিশম-এর দ্য রেনমেকার উপন্যাসে সদ্য আইন পাশ করা আদর্শবান নায়ক, বিরাট নামকরা সংস্থার দুঁদে উকিলদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এক মক্কেলের হয়ে লড়াই করেছিল, জিতেছিল। হেরেছিল দোষী বিমা সংস্থা। দাবি নিষ্পত্তি করার ন্যায্য দাবি ছিল সেই উপন্যাসের মূলে। জয়ী হয়েছিল এক দরিদ্র কালো মানুষ। উপন্যাসের নায়ক তো আর বাস্তবের মাটিতে নেমে আসবে না— তাই আমাদেরই চেষ্টা করে যেতে হবে, যাতে বিমা সংস্থাগুলি অনৈতিক পথে না চলতে পারে।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে