অগ্রপশ্চাৎ: জরুরি অবস্থার অর্ধশতক পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠানে ইন্দিরা গান্ধীর ছবির সামনে মন্ত্রিসমাবেশ, দিল্লি, ২৫ জুন। ছবি: পিটিআই।
গত ২৫ জুন ভারতীয় জনতা পার্টির আহ্বানে কোথায়, কারা, কী ভাবে ‘জরুরি অবস্থার স্বর্ণজয়ন্তী’ পালন করলেন, সেটা ঠিক ভাল ভাবে জানা গেল না। এমনকি এই উপলক্ষটি কি বিষাদোৎসব না আনন্দোৎসব, তাও যেন বোঝা গেল না। ব্যতিক্রম শুধু এক জন, ভারতের সদ্য-প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি। তিনি স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠান-সহ বিভিন্ন সভাসমিতিতে জরুরি অবস্থার বিষময় ফল উল্লেখ করে ‘সংবিধান হত্যা’-র বিবরণ তুলে ধরলেন।
প্রসঙ্গত, এই বছর জানুয়ারিতে তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় মুম্বইয়ে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ১৯৭৩ সালে কেশবানন্দ ভারতী মামলায় সুপ্রিম কোর্ট ‘সংবিধানের মূল কাঠামো’য় যে গুরুত্ব আরোপ করেছিল তা ধ্রুবতারার মতো পথ দেখিয়ে চলেছে। এ মন্তব্যের কয়েক দিন পরেই তাঁর বক্তব্যকে খণ্ডন করে প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি ওই মামলার রায়কে ‘খারাপ নজির’ বললেন। এ বার তিনি জরুরি অবস্থায় সংশোধিত সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ দু’টির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে তোপ দাগতে শুরু করেছেন।
এ কথা অনস্বীকার্য যে জরুরি অবস্থার সময় ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে সাবেক সংবিধানের প্রায় চার ডজন ধারার পরিবর্তন ও এক ডজন নতুন ধারা সংযোজন করা হয়েছিল। তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ পঞ্চাশ বছর পরে অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর— তবে মনে রাখা ভাল যে লোকসভায় বিলটির আলোচনার সময় বিরুদ্ধে মাত্র পাঁচটি ভোট পড়ে। ও দিকে রাজ্যসভায় তা সর্বসম্মতিতে মঞ্জুর হয়, একটি ভোটও বিরুদ্ধে যায়নি। কারণ, বেশির ভাগ বিরোধী সাংসদ তখন হয় জেলে, নয় গোপন আস্তানায় বাস করছিলেন। সেই সময় সংবিধানের প্রস্তাবনায় তিনটি শব্দ সংযোজিত হয়— সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও দেশের সংহতি।
সংহতি নিয়ে কেউ কখনও প্রশ্ন না তুললেও সংযোজিত অন্য দু’টি শব্দ নিয়ে আপত্তি আজকাল খুব বেশিই শোনা যাচ্ছে। জগদীপ ধনখড়ও এই শব্দ দু’টিকে ‘আলসার’ বা সংবিধানের ক্ষতস্থান বলে অভিহিত করলেন। বললেন, মূল সংবিধানের প্রস্তাবনায় ওই দু’টি শব্দ ছিল না, এবং পৃথিবীর কোনও সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ আজ অবধি পাল্টানো হয়নি, কারণ প্রস্তাবনাই সংবিধানের মূল সারবস্তু।
‘পৃথিবীর কোনও সংবিধানের মূল প্রস্তাবনা কখনও পাল্টানো হয়নি’, এ দাবি সত্য নয়, তবে সে কথায় পরে আসছি। প্রথমেই যেটা বলা দরকার, সেটা সংবিধানের সমালোচনার এই সময় নির্বাচন। মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, কেন্দ্রে প্রথম বিরোধী জোট শাসিত মোরারজি দেশাইয়ের সরকারের পতনের পরে ১৯৭৯ সালে চরণ সিংহ যখন প্রধানমন্ত্রী হন, জরুরি অবস্থার সময়ের চার ডজন সংবিধান সংশোধনীর মধ্যে অনেকগুলি বিষয় তিনি সুপ্রিম কোর্টে বিচারের জন্য প্রেরণ করলেও প্রস্তাবনায় সংযোজিত সংবিধানের ওই দু’টি ‘ক্ষতস্থান’ (প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতির ব্যাখ্যায়) নির্মূল করার কোনও প্রচেষ্টা করেননি। এমনকি তার পরে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ, চন্দ্রশেখর, দেব গৌড়া, গুজরাল, অটলবিহারী বাজপেয়ী, নরেন্দ্র মোদী অন্তত আঠারো-উনিশ বছর সরকার চালিয়ে গিয়েছেন। তাঁরাও সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার কথা ভাবেননি।
বিগত যে দুই দশকের কথা উল্লেখ করা হল, তার বেশির ভাগ সময় জগদীপ ধনখড় জনতা দল ও জাতীয় কংগ্রেস দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০৩ সালে তিনি বিজেপি-তে যোগ দেন, ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল, ২০২২ সালে উপরাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। ২০০৩ থেকে ২০২৪: এই একুশ বছরে তিনি সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্বন্ধে কোনও বিরূপ মন্তব্য করেননি। হয়তো এই কারণে যে, তিনি আইনজীবী হিসাবে জানতেন মিনার্ভা মিলস মামলায় সুপ্রিম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি ওয়াই ভি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চ রায়ে (মে, ১৯৮০) উল্লেখ করেছিলেন, “সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানের মূল দর্শন। প্রস্তাবনায় তার উল্লেখ সেই দর্শনকেই মান্যতা দিয়েছে এবং সংবিধানের ভিত্তিকে শক্তিশালী করেছে।” তা ছাড়া সংবিধানের ৩৬ থেকে ৫১ ধারায় রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিমালাতেও সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বহু উপাদান সম্পৃক্ত রয়েছে। একই ভাবে সংবিধানের ১৪, ১৫ এবং ২৬ থেকে ২৮ ধারায় ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বজায় রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এই বিষয়গুলি যেমন কোনও উপরাষ্ট্রপতি পদাধিকারীর অজানা হতে পারে না, তেমনই বিজেপির উচ্চমহলে এত কাল কাটানো ব্যক্তির পক্ষে দলের সংবিধানে কী লেখা আছে তা না দেখাও বিশেষ আশ্চর্য বইকি। আগ্রহী নাগরিকের জানা দরকার যে, ভারতীয় জনতা পার্টির দলীয় সংবিধানের ২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, “ভারতের সংবিধান ও সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি দল প্রকৃত বিশ্বাস ও আনুগত্য বহন করবে এবং ভারতের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখবে।”
জরুরি অবস্থায় প্রস্তাবনায় সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ভারতের সংহতি, শব্দগুলিই সংযোজিত হয়েছিল। তাই ২০১৫ সালে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ ও ২০২৪ সালে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ প্রস্তাবনা সংশোধনের প্রচেষ্টার কথা অস্বীকার করেন। কিন্তু শ্রীধনখড় এত দিন এ বিষয়ে মুখ না খুললেও সাম্প্রতিক কালে অকস্মাৎ প্রকাশ্যে বিষয়টি উচ্চকণ্ঠে বললেন কেন? কোনও দেশের কোনও সংবিধানের প্রস্তাবনা কখনও পাল্টানো হয়নি, এই দাবি তিনি করেছেন। অথচ এস্টোনিয়ার প্রতিরক্ষা দফতরে কর্মরত আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টল উরকে-র গবেষণা থেকে জানা যায়, এখনও পর্যন্ত আফ্রিকার ১৪টি, ইউরোপের ১০টি, এশিয়ার ৮টি, আমেরিকার ৬টি ও অন্যান্য ৪টি দেশে অর্থাৎ বিশ্বের ৪২টি দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা সংশোধিত হয়েছে (সূত্র: জুরিডিক্যাল ইন্টারন্যাশনাল, ২০২৪)।
প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি মহাশয় যে দিন প্রস্তাবনার ওই দু’টি আদর্শকে ‘আলসার’ বললেন, তৎক্ষণাৎ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবলে প্রস্তাবনার সংশোধনের দাবি তুললেন। তাঁর সুরে সুর মেলালেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানও। অবশ্য মানতেই হবে, আরএসএস স্বধর্মে স্থির, সংবিধানের জন্মলগ্ন থেকেই তা ভারতের সংবিধানের সমালোচনা করে চলেছে। বিনায়ক দামোদর সাভারকর যখন লিখেছিলেন, ‘নতুন সংবিধানে ভারতীয় বলে কিছু নেই’ (উইমেন ইন মনুস্মৃতি, ভল্যুম ৪, পৃ. ৪১৬), তখনও তিনি হিন্দু আইন-কে মনুস্মৃতির সঙ্গেও তুলনা করেন। আরএসএস নেতৃত্ব ভারতের প্রাচীন ভাবধারা ও মনুস্মৃতিকে বরাবর গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। তাই আজ যখন প্রস্তাবনা সংশোধনের দাবি বিজেপি-আরএসএস তুলছে, তা খুবই স্বাভাবিক মনে হয়।
কিন্তু উচ্চ সাংবিধানিক পদে কর্মরত অবস্থায় দেশের উপরাষ্ট্রপতি যখন ‘সংবিধানের আত্মা’-কে বিসর্জন দিতে উদ্যত হন, তখন রাষ্ট্রীয় সঙ্কট তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। বিভিন্ন মহলে এখন এই আলোচনা শোনা যাচ্ছে। অথচ, সাংবিধানিক নৈতিকতা ও শিষ্টাচারের স্বার্থে এই প্রশ্নের আশু সমাধান প্রয়োজন।
সংবিধান বিপন্ন হলে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব সঙ্কট দেখা দেবে। ভারত নামক দেশটির চরিত্রই যাবে পাল্টে। ‘সংবিধান হত্যা’র প্রচার ও সেই সুরে জরুরি অবস্থার স্বর্ণজয়ন্তী পালন করে কিন্তু সেই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব হবে না।
সাংসদ, তৃণমূল কংগ্রেস
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে