Indian Cricket Team

অন্তরের আলোয় বিশ্বজয়ী ওঁরা

দীপিকা-সুনীতা-সিমু-গঙ্গা-অনিখারা এখন বিশ্বসেরা হওয়ায় ওঁদের নিয়ে মানুষের এখন উৎসাহ বেড়েছে। নেতা-মন্ত্রীরা প্রশংসা, আপ্যায়ন করছেন। কিন্তু খেতাব জয়ের আগে এই মেয়েদের যে লড়াই করতে হয়েছে তা অবর্ণনীয়।

সূর্যশেখর দাস

শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:৪৯
Share:

জন্মান্ধ মেয়েটির মাকে তার পাড়া-প্রতিবেশীরা বলেছিল, “এই মেয়েকে ঘরে রেখেছ কেন? ফেলে দাও, নয় কোনও আশ্রমে দিয়ে দাও।” অন্যের কথা শুনে মা তাঁর ‘কানা’ মেয়েটিকে বিসর্জন দেননি। সেই মেয়ে, সুদক্ষ বোলার সিমু দাস দৃষ্টিহীন ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটারদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হতে এ বছর বড় ভূমিকা পালন করেছেন। লোকে যাকে আঁস্তাকুড়েতে ছুড়ে ফেলতে বলেছিল, সে-ই আজ বিশ্বজয়ী!

সিমুরই সতীর্থ দীপিকা। ছোটবেলা থেকেই সমাজ ঠারেঠোরে তাকেও বুঝিয়ে দিয়েছিল, তিনি সমাজের বোঝা, কলঙ্ক। সেই দীপিকাই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক! জনজাতি গোষ্ঠী থেকে আসা অন্ধ‌ খেলোয়াড় ফুলা সোরেনও ছোটবেলা থেকেই চার পাশের অপমানের থুতু সহ্য করেছেন। বিশ্বকাপ ফাইনালে নেপালের বিরুদ্ধে তাঁর ব্যাট যখন অমানুষিক দক্ষতায় ঝলসে উঠছিল বার বার, ফুলা যেন উত্তর দিচ্ছিলেন— পাল্টা থুতু নয়, ব্যাট হাতে মাঠে রান করে!

দীপিকা-সুনীতা-সিমু-গঙ্গা-অনিখারা এখন বিশ্বসেরা হওয়ায় ওঁদের নিয়ে মানুষের এখন উৎসাহ বেড়েছে। নেতা-মন্ত্রীরা প্রশংসা, আপ্যায়ন করছেন। কিন্তু খেতাব জয়ের আগে এই মেয়েদের যে লড়াই করতে হয়েছে তা অবর্ণনীয়। অনিখা-ফুলারা সমাজে ব্রাত্য, এমনকি অনেকেই পরিবারের কাছেও খুব একটা প্রিয় নন! গরিব বাড়ির মেয়ে, মা-বাবা ভাল করে দু’বেলা দু’মুঠো খাবারও দিতে পারেননি। ছোটবেলা থেকেই লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে হয়েছে: একে তো মেয়ে, তায় চোখে দেখে না, ঠিকঠাক লেখাপড়াও হবে না— এদের বাড়িতে বসিয়ে খাবার গিলিয়ে লাভ কী! বরং মাঠে-ঘাটে কাজ করুক। দীপিকা যেমন চাষের খেতে কাজ করতেন।

ওঁদের সাম্প্রতিক সাফল্য কিন্তু বহু দৃষ্টিহীন মেয়েকে ক্রিকেট খেলায় আশার আলো দেখিয়েছে। ওঁদের বিশ্বজয় সেই মেয়েদের মা-বাবাকেও বোঝাবে, অন্ধত্ব বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা মানেই একটি মেয়ের জীবন শেষ হয়ে যায় না। পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক, লড়াইটা যে চালিয়ে যায়, সে এক দিন ঠিক জিতবে। আশপাশের লোক, আত্মীয়-স্বজনও মানসিক ভাবে বার বার রক্তাক্ত করবে, তবু হাল ছাড়লে চলবে না।

ক্রিকেট খেলার সঙ্গে যুক্ত নন যাঁরা, অথচ শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতার জেরে সমাজের এক কোণে দমবন্ধ হয়ে গুমরে মরছেন— এই জয় তাঁদেরও উদ্বুদ্ধ করবে। ২০২৫-এর নভেম্বর মাসটা ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটে এক সোনার সময়— এ মাসেই হরমনপ্রীত কউর-স্মৃতি মন্ধানা-রিচা ঘোষরা প্রথম বার সিনিয়র স্তরে বিশ্বকাপ জিতলেন; এই নভেম্বরেই দৃষ্টিহীন মহিলা ক্রিকেটাররা উদ্বোধনী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে নজির গড়লেন। গঙ্গা-সিমু-ফুলারা জীবনে শত অসম্মান লাঞ্ছনার মুখেও নীরবে নিজেদের কাজটা করে গিয়েছেন: যতটুকু সময় পেয়েছেন, ‌মন দিয়ে ক্রিকেট খেলেছেন। গোটা বিশ্বকাপে আশ্চর্য এক ‘ইনটেনসিটি’ বজায় রেখে খেলেছেন, ওঁদের ‘পারফরম্যান্স’-এর তীব্রতা সত্যিই প্রশংসনীয়। আবার ম্যাচের কঠিন পরিস্থিতিতেও ছিলেন শান্ত, অযথা অধৈর্য বা মরিয়া হননি।

দৃষ্টিহীন মহিলা ক্রিকেটারদের এই খেতাব জয় বুঝিয়ে দিল, জীবনে সফল হতে গেলে সবচেয়ে বড় মূলধন পরিশ্রম। হাতে অর্থ বা রসদ কম থাকতে পারে; সামাজিক শারীরিক মানসিক নানান প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে, তা সত্ত্বেও যে নিঃশর্ত পরিশ্রম করে, জীবনযুদ্ধের মাঠে সে জিতবেই। এই দৃষ্টিহীন মহিলাদের স্কোয়াডে যে ষোলো জন খেলোয়াড় রয়েছেন, এঁদের অনেককেই শুনতে হয়েছে, “এ তো দেখতেও ভাল না, বিয়ের বাজারেও দাম পাবে না গো!” কোন দৃষ্টিসম্পন্ন সক্ষম পুরুষ আর অন্ধ মেয়েকে বিয়ে করতে চায়? দীপিকা-সুনীতা-গঙ্গা-ফুলারা বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে, সাফল্য ছিনিয়ে এনে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা এমন কিছু করতে পারেন যা বহু তথাকথিত সক্ষম ও দক্ষ মানুষও সারা জীবনে অর্জন করতে পারবেন না। পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক, যে যতই মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করুক, অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে কিছুতেই দূরে সরে যাওয়া চলবে না। তা হলেই এক দিন সাফল্য করতলগত হবে।

চোখের আলো না থাকা এক দল মেয়ে দেখিয়ে দিল, শুধু অন্তরের আলোয় দেখে, শিখেও গন্তব্যে পৌঁছনো যায় ঠিক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন