English Language

একটা সহজ কেজো ভাষা

উইলিয়াম বেন্টিঙ্ককে ছাড়া রামমোহনের উদ্যোগের বাস্তবায়ন, জন বেথুনকে ছাড়া বিদ্যাসাগরের স্বপ্নপূরণ কে করত?

অনমিত্র বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:৫১
Share:

পলাশির প্রান্তরে কৃষ্ণচন্দ্র ও নাটোরের রানি নিশ্চয়ই অত্যাচারী সিরাজউদ্দৌলার বিপরীতে রবার্ট ক্লাইভকে পরিত্রাতারূপে দেখেছিলেন। পোহালে শর্বরী, বণিকের মানদণ্ড তার দাঁত-নখ প্রকাশ করল। আনন্দমঠ-এর সত্যানন্দ তবু উপলব্ধি করেছিলেন, মহাকালের প্রারব্ধ সম্পূর্ণ করে ইংরেজ শাসকও জ্যোতিষ্কলোকের পথে রেখামাত্র চিহ্ন রাখবে না। বরং অর্ধ-সহস্রাব্দের পরাধীনতায় যে সংস্কৃতি আপনার মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে ‘স্ট্যাগনেটেড’ হয়ে গিয়েছিল, এই সুযোগ বাইরের পৃথিবীর জল-হাওয়া লাগিয়ে, শিল্পবিপ্লবের যা শিক্ষণীয় তা গ্রহণ করে তার সত্যযুগের মহিমায় ফেরার।

মেকলে ভেবেছিলেন, ইংরেজির শিকল পরিয়ে একটা বুর্জোয়া শ্রেণি তৈরি করবেন, যাদের গতিজাড্যে স্থায়ী হবে ভারতে ব্রিটিশ সিংহ। সেই শিকল গলিয়ে তার লোহা দিয়ে হাতিয়ার বানাল নবজাগরণের প্রণেতারা, উপড়ে ফেলল অধীনতার দেওয়াল। আফ্রিকার মতো উপনিবেশতন্ত্র এখানে দেশজ সংস্কৃতিকে মুছতে পারল না। বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষাকে দফতরি ভাষার মর্যাদায় গ্রহণ ও হিন্দুধর্মকে অজ্ঞাতবাস থেকে বার করলেন, রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ তাঁর দ্বিবিধ উদ্যমকে পূর্ণরূপ দিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র বিজ্ঞান দিয়ে জাতির মেরুদণ্ডের কাঠামো শক্ত করে বাঁধলেন। ছাত্ররা মার্কিন-জার্মানি-হিবাচি থেকে সংগ্রহ করে আনল কব্জা-কলের কঠিন লোহার ঘুম ভাঙানোর মন্ত্র। আমরা কি ভুলে যাব— এর সঙ্গে জড়িত ছিল কত ইংরেজের স্বপ্ন, যাঁরা ভারতের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল? উইলিয়াম বেন্টিঙ্ককে ছাড়া রামমোহনের উদ্যোগের বাস্তবায়ন, জন বেথুনকে ছাড়া বিদ্যাসাগরের স্বপ্নপূরণ কে করত?

মেনে নিলাম, মেকলের প্রতিস্থাপনমূলক পরিকল্পনার অন্য এক ফল হয়েছিল— সুকুমার সেনের ভাষায়, কয়েকটি আত্মপরিচয়হীন প্রজন্ম শিক্ষা বলতে বুঝেছিল ‘বিয়র, বাইবেল অ্যান্ড বেয়নেট’— আজ তাকে উপড়ে ফেলার শুভক্ষণ এসেছে। তেমনই, জেমস প্রিন্সেপ মৌর্য লিপি পাঠোদ্ধার না করতে পারলে সংস্কৃত ভাষার অতীতের সম্যক নির্ণয় সম্ভব হত না। হারিয়ে যেত অশোকের পরিচয় ও কীর্তি। আলেকজ়ান্ডার কানিংহাম সাঁচী-সারনাথের প্রত্নতাত্ত্বিক পুনরুদ্ধার ও রক্ষণাবেক্ষণে উদ্যোগী না হলে তথাগতের চরণরেখা ভুলেই থাকতাম। বুদ্ধের বাণী প্রস্তরশৈলীতে সংরক্ষণ করায় ধর্মাশোক বা কনিষ্কের চেয়ে কানিংহামের ভূমিকা এতটুকু কম নয়। তাঁদের অস্বীকার করা অপরাধ।

আজ মেকলেকে বাতিল করার আগে তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে হবে লেডি হেরিংহ্যামকে— যাঁর উদ্যোগ ও অর্থানুকূল্যে অজন্তা পুনরাবিষ্কারের অব্যবহিত পরে নন্দলাল বসু প্রমুখ আঁকিয়ে সেই ম্যুরালগুলো কপি ও প্রকাশ করে ভারতীয় চিত্রকলায় নবজাগরণের স্রোত বইয়ে দেন, ভারতীয় তদারককারীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় অজন্তার প্রাচীরচিত্র বহুলাংশে নষ্ট হওয়ার পরে যা শিল্পীর জন্য অক্ষয় সঞ্চয় হয়ে আছে। বা লেওনার্দ এলমহার্স্টকে— শান্তিনিকেতনে এসে সুরুল গ্রামে যাঁর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গ্রামোন্নয়নের কাজ, রবীন্দ্রনাথের মতে, সেই সত্যের সন্ধান দিয়েছে যা আবিশ্ব আধুনিক মানুষ হাতড়ে বেড়াচ্ছে।

মৃণাল সেনের ইন্টারভিউ ছবিতে ছেলেটি চাকরির দরখাস্ত করেছে। কিন্তু তার কোট-পাতলুন জুটল না; দিদি ও মা বললেন, ধুতি-পাঞ্জাবি পরলে ‘দেখাবেও বেশ ভাল’। রঞ্জিত তা-ই পরে ইন্টারভিউয়ে গেল, কর্পোরেট আভিজাত্যের বেড়া না টপকাতে পেরে ফিরে এল। ব্যবহারিকতার প্রেক্ষিতে ধুতি-পাঞ্জাবি আর কোট-পাতলুনের কোনওটাই অন্যটার চেয়ে সুবিধাজনক নয়। কিন্তু নান্দনিকতার যে মাপদণ্ড শাসনতন্ত্রের সিংহদ্বার ও ব্যবসায়িক রীতির খিড়কিদুয়ার দিয়ে সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে, তার প্রতি বিতৃষ্ণা হয়তো স্বাভাবিক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। অথচ ধুতি-পাঞ্জাবি পরা রঞ্জিতের স্বতঃস্ফূর্ত সিদ্ধান্ত নয়, বিকল্প ‘রিবাউন্ড’ ছিল। মর্যাদাবোধের এই দ্বিচারিতায় তার আপত্তি ছিল না। হল, ফ্যাশন বা দস্তুর যখন নির্মম ভাবে ‘ইমপ্লিমেন্টেড’ হল।

তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের গঠনগত সাঙ্কর্য বহু দেশ ও জাতির মধ্যে থেকে তার মনীষার উপাদান সংগ্রহ করেছে। অধ্যাপক মঞ্জুল ভার্গব বিরহাঙ্কের গণিত নিয়ে বক্তৃতার শেষে কটাক্ষ করেছেন, “অবশ্য ভারতে তো আমরা একে ফিবোন্যাচি সিকোয়েন্স বলি।” এ হালের কথা। তার পরিপ্রেক্ষিতে আজ যদি পাঠ্যক্রম ধুতি-পাঞ্জাবি পরে নেয়, দোষের কী? প্রাচীন কালে যজ্ঞবেদি বা পিরামিড যাঁরা তৈরি করতেন, পিথাগোরাসের সূত্র তাঁরা জানতেন। পিথাগোরাস-পূর্ব বৌধায়ন শুল্বসূত্রে তার সহজ স্বজ্ঞা-নির্ভর প্রমাণ আছে। গ্রিসে পিথাগোরাস কী সম্মান পেতেন জানি না, বিহার প্রদেশে বৌধায়নের মন্দির আছে। তার পরেও ইউক্লিডকে না চিনলে চলবে না, তাঁর মার্গ ছাড়া আধুনিক বিজ্ঞান অচল।

আজ ইংরেজি সরিয়ে উত্তর ভারতের ভাষাকে বাকি ভারতের ঘাড়ে মেকলের কায়দায় চাপিয়ে দেওয়ার হুজুগ উঠেছে। অথচ ভারতের বিস্তীর্ণ ভূমিখণ্ড যত বার এক শাসনতন্ত্রের তলায় এসেছে, তত বার এসেছে একটি বিদেশি ভাষাকে স্বীকারের প্রশ্ন— তার আধিপত্য নয়, ব্যবহারিকতা: মৌর্য যুগে গ্রিক, মোগল জমানায় ফারসি। ভারতের শেষ বহিরাগত শাসকের ‘লেগ্যাসি’ একটা সহজ কেজো ভাষা, বিশ্বময় যার অবাধ গতি। চোরের উপর রাগ করে আমরা নিশ্চয়ই মাটির থালায় ভাত খাব না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন