loneliness

নিঃসঙ্গ বার্ধক্যের অপেক্ষায়

সাফল্যের পিছনে বন্ধুহীন দৌড় যখন ব্যর্থ হয়, পড়ে থাকে শুধু একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা। আবাসনের ঘরে মরে পড়ে থাকেন নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা।

Advertisement

বিষাণ বসু

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২২ ০৫:১৭
Share:

কয়েক বছর আগে এক আমেরিকান সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পড়ছিলাম— জাপানে বৃদ্ধদের নিঃসঙ্গ মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে। ভারতের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে সেই ঘটনাগুলোর বড় উদ্বেগজনক রকম বেশি মিল। জাপানে পরিবার ব্যাপারটা অতি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু পশ্চিমা ঢেউ এসে পরিস্থিতি বদলেছে। অতএব সে দেশে বৃদ্ধদের একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গ মৃত্যু বিরল নয়। সপ্তাহে এমন মৃত্যুর সংখ্যা, সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, চার হাজার।

Advertisement

প্রতিবেদনটি টোকিয়োর উপকণ্ঠে অতিকায় এক হাউজ়িং কমপ্লেক্সের জীবন নিয়ে। কয়েক হাজার ফ্ল্যাট সেখানে। ১৯৬০-এর দশকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, জাপানের অর্থনীতি যখন তরতর করে এগোচ্ছিল, তখন তৈরি হয় এমন বহু আবাসন। উচ্চবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্তরাই থাকতে পারতেন সেখানে। ভাড়ার অন্তত সাড়ে পাঁচ গুণ মাইনে না পেলে ফ্ল্যাটের আবেদনই করা যেত না। প্রতি ফ্ল্যাটে ফ্রিজ-টিভি-ওয়াশিং মেশিন— এক ঝলমলে জীবন। বিচ্ছিন্ন, আত্মমগ্ন, সঙ্কীর্ণ সাফল্যমুখী জীবন।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক বৃদ্ধি শ্লথগতি হয়। যে হেতু সব কিছু ছেড়ে অর্থনৈতিক উন্নতি আর পশ্চিমি জীবনযাপনকেই সাফল্যের চূড়ান্ত মাপকাঠি ধরা হয়েছিল, সেই বৃদ্ধির হার হ্রাস পেলে আর কিছুই হাতে থাকে না। সাফল্যের পিছনে বন্ধুহীন দৌড় যখন ব্যর্থ হয়, পড়ে থাকে শুধু একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা। আবাসনের ঘরে মরে পড়ে থাকেন নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা। মরাপচা দুর্গন্ধ নিকটবর্তী ফ্ল্যাটে না পৌঁছনো অবধি কেউই খবর পায় না। অনেক সময় সে ভাবেও খবর পৌঁছয় না। একটি মৃতদেহ আবিষ্কার হয় যখন, তখন তা আর দেহ নেই, কঙ্কাল মাত্র। রান্নাঘরে বেসিনের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা এক কঙ্কাল। জানা যায়, মানুষটা মারা গিয়েছেন প্রায় বছর তিনেক আগে। ব্যাঙ্কের আমানত থেকে বিভিন্ন বিল মেটানো হতো অটো-পে পদ্ধতিতে। সেই আমানত শূন্য হয়ে বিল বকেয়া না হলে, কে জানে, কবে কেউ খবর পেত মানুষটার! আশ্চর্য, কয়েক দশক সেই আবাসনের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও কেউ চিনতেন না তাঁকে।

Advertisement

যাঁরা বেঁচে আছেন— বেঁচে থেকে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছেন, বা নিঃসঙ্গ মৃত্যুর আতঙ্কে ভুগছেন— তাঁদের বেঁচে থাকাটাও অকল্পনীয়। যেমন, নব্বইয়ের কোঠায় পৌঁছে যাওয়া এক ভদ্রমহিলা আর এক ফ্ল্যাটের বাসিন্দাকে দায়িত্ব দিয়েছেন শুধু তাঁর ফ্ল্যাটের জানলাটুকুর দিকে লক্ষ রাখার। কেননা, তিনি রোজ রাতে জানলার পর্দা টেনে দেন, আর সকালে উঠেই সেই পর্দা সরিয়ে দেন— যদি কোনও সকালে দেখা যায় যে, পর্দা টানা রয়েছে, তবে বুঝে নিতে হবে…। নিয়মিত নিঃসঙ্গ মৃত্যুর ঘটনায় উৎকণ্ঠিত হয়ে কয়েক জন মিলে অসুস্থ ও আশঙ্কাজনক অবস্থার বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বেঁচে আছেন কি না, তার খেয়াল রাখেন। ভাল আছেন কি না, তার খেয়াল রাখা নয়— স্রেফ বেঁচে আছেন, না কি মরে গিয়েছেন, তাঁদের কাজ সেটুকু জানা।

কলকাতার আবাসনগুলোর ভবিষ্যৎও কি এই রকম? অন্তত, আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তা হলে? সাফল্য ও স্বাচ্ছন্দ্যের মাপকাঠিগুলো এতখানিই পশ্চিমের তারে বাঁধা হয়ে গিয়েছে যে, আমাদের সাবেক সামাজিক জীবন আপাতত শুধুই স্মৃতি আর নস্ট্যালজিয়া। উদয়াস্ত অর্থোপার্জনের পিছনে দৌড়নোর শেষে মোচ্ছবে উইকএন্ড আনওয়াইন্ডিং হতে পারে, হাতে হাত রাখার বন্ধু মেলা দুষ্কর। একমুখী উন্নতির স্বপ্নে বড় হওয়া পরবর্তী প্রজন্ম ইঁদুর-দৌড়ে শামিল— কতটুকু সুযোগ বাকিদের খবর রাখার? রাখতে চাইলেও কতটুকু সম্ভব, যখন উচ্চশিক্ষান্তে কাজের সুযোগ এই রাজ্যে অমিল, ক্রমশ দেশেও?

আমাদের বার্ধক্য ক্রমশ অতি সঙ্কটময়। সমাজের বিপুল অংশের মানুষের ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষার বন্দোবস্ত নেই। যাঁরা শারীরিক শ্রম দিয়ে আয় করেন, বার্ধক্যে তাঁরা কী করবেন? তাঁদের চাইতে আর একটু ভাল অবস্থায় যাঁরা, অর্থাৎ যাঁদের ব্যাঙ্কে কিছু আমানত রয়েছে, ক্রমহ্রাসমান সুদ ও ক্রমবর্ধমান মূল্যের বাজারে তাঁরাই বা কেমন রয়েছেন? বা থাকবেন? মধ্যবিত্ত? এমনকি উচ্চ-মধ্যবিত্ত? অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়— অতি বার্ধক্যে মানুষ চান একটু সান্নিধ্য। তা জুটছে কি? জুটবে কি?

বয়স্ক মানুষ উৎপাদক নন, গুছিয়ে কেনাকাটা করার মতো উপভোক্তাও নন। কাজেই সরকার বা বাজার কেউই তাঁদের কথা ভাববে না। ভবিষ্যৎ বার্ধক্যের কথা মনে রাখলে ভাবতে হবে নিজেদেরই। বৃহত্তর স্বার্থে না হোক, অন্তত নিজেদের স্বার্থেই। সাফল্যের লোভে দৌড়ে চলার মাঝে একটু থমকে দাঁড়াতে পারলে— ভবিষ্যৎ বলতে শুধুই আরও ভাল গাড়ি, আরও বড় বাড়ি, আরও জম্পেশ বিদেশভ্রমণ নয়, ভবিষ্যৎ বলতে বুড়ো হওয়া, ভবিষ্যৎ বলতে নির্ভরশীল হওয়া, এটুকু বুঝতে পারলে— ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কথাটিকে কোনও মহৎ আদর্শ হিসেবে নয়, স্রেফ নিজেদের ভাল থাকার জন্যই অত্যন্ত জরুরি ভাবনা হিসেবে দেখা যায়।

রেডিয়োথেরাপি বিভাগ, ক্যালকাটা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন