Sunil Gangopadhyay

সুনীল অথবা প্রথম বিদ্যুৎ তরঙ্গ

কবিতাগুলির ছত্রে-ছত্রে প্রকৃতপক্ষে লুকিয়ে এক অমোঘ ডিসগাস্ট, ব্যবস্থার প্রতি রাগী এক যুবকের প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ মুষ্ট্যাঘাত।

Advertisement

অভীক মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১০:২৪
Share:

ফাইল ছবি

গাঢ় ছাই রঙের উপর সাদা হরফে লেখা ‘আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি’। কৃশকায় একটি কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৭২ সনে (১৯৬৬) মধ্যচৈত্রে। কবিতার সংখ্যা ৭১। কবির নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বইটি দৈবাৎ আমার হাতে আসে, বাবার বইপত্রের মধ্য থেকে। তখন আমার মেরেকেটে ১৫ বছর। সত্যি বলতে কি, আমার পুরো জীবনটাই লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল ওই কবিতাগুলো। সেই থেকে আজীবন ওই কাব্যগ্রন্থটি আমার কাছে অভিজ্ঞতার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আজ মাঝে মাঝে ভাবি, কেন ঘটেছিল এরকম? ওই কবিতাগুলির ছত্রে-ছত্রে প্রকৃতপক্ষে লুকিয়ে আছে এক অমোঘ ডিসগাস্ট, ব্যবস্থার প্রতি রাগী এক যুবকের প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ মুষ্ট্যাঘাত, প্রচলিত সমাজ-সংসার-সংশ্লিষ্ট মূল্যবোধ আর ভণ্ডামিকে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করার গনগনে গর্জন। এক ছন্নছাড়া, প্রতিষ্ঠানবিরোধী, উদ্ধত তরুণের সঙ্গে কাব্যসংলাপে সেই যে জড়িয়ে পড়লাম, ওই কবিতা থেকে আর মন সরাতে পারলাম কই?

Advertisement

পরবর্তী কালে, পরবর্তী জীবনে, দেশবিদেশের বহু মহৎ কবিতা বা কাব্যগ্রন্থ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে, কিন্তু এই বইয়ের স্বরদ্যুতি আমার কাছে অমলিন। কেননা তীব্র ক্রোধ, তীক্ষ্ণ প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, অগ্নিভ অভিমান বহুক্ষেত্রেই কাব্যসংরূপে ততটা সার্থক হতে পারে না। প্রতিবাদী কবিতায় সারা বিশ্বজুড়েই প্রায়শই প্রতিবাদের অনুপাত এত বেশি হয়ে ওঠে যে, কবিতা বিষয়টাই বনবাসে চলে যায়। এ ক্ষেত্রে জাদুবলে সুনীল অকল্পনীয় এক আধুনিক কাব্যভাষাকে রপ্ত করেছেন। যেখানে নির্ধারিত ছন্দে অথবা গদ্যস্পন্দে ব্যক্তিজীবনের রাগ, দুঃখ, হতাশা, কল্পনা, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, বাস্তব-পরাবাস্তব, প্রেম, যৌনতা, রিরংসা, একাকিত্ব আর অস্তিত্ব জিজ্ঞাসার স্নায়ুকম্পনগুলিকে অত্যাশ্চর্য রুক্ষনৈপুণ্যে প্রকাশ করা যায়। একটু ভেবে দেখলে মনে হয়, পরবর্তী কালপর্বের অতি তরুণ কবিদের কাব্য উচ্চারণে এই কেতাবের স্বরক্ষেপ প্রভাব ফেলেছে। ভাস্কর চক্রবর্তী, শামসের আনোয়ার কিংবা সুব্রত চক্রবর্তীর গোড়ার যুগের কবিতার দিকে তাকিয়ে দেখুন।

ওই কবিতাগুলির ছত্রে-ছত্রে প্রকৃতপক্ষে লুকিয়ে আছে এক অমোঘ ডিসগাস্ট ফাইল ছবি।

সেই মধ্য কৈশোরে এত কথা বুঝিনি। শুধু বলা চলে, কবিতা নামক বিদ্যুৎতরঙ্গে প্রথম হাত ছোঁয়ানোর রোমাঞ্চ এবং অভিঘাতে আপাদমস্তক কেঁপে উঠেছিলাম। আমৃত্যু বারংবার তেমন সব অজস্র কবিতার দপ করে জ্বলে ওঠা ধাক্কায় বোবা অন্ধ নুয়ে পড়ার সেই শুরু। সেই নিয়তি। কী সব পংক্তি, কী সব দুঃসাহসিক ভাষা প্রয়োগ, কী প্রবল রূপদক্ষতা— ‘একলা ঘরে শুয়ে রইলে কারুর মুখ মনে পড়ে না / মনে পড়ে না, মনে পড়ে না, মনে পড়ে না, মনে পড়ে না / চিঠি লিখব কোথায় কোন মুণ্ডহীন নারীর কাছে ?/ প্রতিশ্রুতি মনে পড়ে না, চোখের আলো মনে পড়ে না / ব্লেকের মতো জানলা খুলে মুখ দেখব ঈশ্বরের?’ (অসুখের ছড়া)। অথবা, ‘বাস স্টপে দেখা হল তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ / দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে সিন্ধুপারে দিকচিহ্নহীন— / বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে / তোমাকে দেখেছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের / নীল দুঃসময়ে’ (হঠাৎ নীরার জন্য)। কিংবা, ‘রোকোকো কথাটা খুব সুন্দর। যেমন বুকলিক, কিন্তু প্যাস্টোরাল / নয়। একটা দীর্ঘনিশ্বাসের শব্দ তিনশো মাইল দূরে চলে গেল— / এখন হঠাৎ ময়দানে নেমে পড়লে আমি কি ফের রাখাল সেজে বাঁশী / বাজাতে পারবো?’ (দুপুরে রোদ্দুরে)।

Advertisement

এই যে জীবনযাপন থেকে উঠে আসা চোখ ধাঁধানো কবিতা, এই যে বিবৃতি আর বিবরণ থেকে দেড়-দুশো মাইল দূরের দৃপ্তাক্ষর, রহস্যময়তার মুক্তো ধারণ করা পংক্তিঝিনুক — এ সিদ্ধি চিরন্তনের। পাঠক হিসাবে আমার মনে হয়, এক দিকে যেন সমর সেন আর অন্য দিকে অন্তিম পর্বের বুদ্ধদেব বসুর কবিতার এবং বোদলেয়র-রিলকের অনুবাদের দুই বিপরীত বিন্দুকে ধারণ করছেন সুনীল। তাকে এগিয়ে দিচ্ছেন বহু চড়াই-উতরাই পেরনো স্বর্ণসৈকতে।

কবিতা নামক বিদ্যুৎতরঙ্গে প্রথম হাত ছোঁয়ানোর রোমাঞ্চ এবং অভিঘাতে আপাদমস্তক কেঁপে উঠেছিলাম। ফাইল ছবি।

বিশ্বকবিতার সঙ্গে এ সময়কালে বেশ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। ষাটের দশকের গোড়া থেকে তার সূত্রপাত। গিন্‌সবার্গ, অরলভ্‌স্কির সঙ্গে বন্ধুতা, আইওয়া লেখক শিবিরের অভিজ্ঞতা, তর্জমার প্রয়াস— সবই টান দিচ্ছিল আন্তর্জাতিক কাব্যসান্নিধ্যের দিকে। পরবর্তীকালে সেই উন্মোচনের নানা ঝলমলে দিকচিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে ষাটের মধ্যপর্ব থেকে ‘সনাতন পাঠক’ ছদ্মনামে প্রকাশিত সাহিত্য বিষয়ক নিবন্ধগুলির মধ্যে। সেখানে ‘ফ্রানৎস কাফকার প্রেমিকা’ বা ‘কার্ল স্যান্ডবার্গ’, ‘বোদলেয়রের জীবনের শেষ একটি মাস’ কিংবা ‘রবার্ট গ্রেভ্‌সের খেয়াল’ প্রভৃতি সেই ইঙ্গিত দেয়। মনে রাখা ভাল, বিশ্বকবিতার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-কৃত অনুবাদ সংকলন ‘অন্য দেশের কবিতা’ প্রথম প্রকাশ পাচ্ছে ১৩৭৩ সনে (১৯৬৬)। এ সময় সম্পর্কে সুনীল লিখছেন, ‘বিদেশ প্রত্যাখ্যাত এক বেকার তরুণ বাঙালি লেখক জীবিকা অর্জনের জন্য নানার পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন নামে প্রায় প্রতিদিনই নানা বিষয়ে গদ্যরচনা প্রকাশ করেছিল।’

বুদ্ধদেব বসুর শতবর্ষে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ’ ২০০৫ সালে পাঁচ দিন ব্যাপী এক সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করে। আমার কাঁধে অনেকটা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বা়ড়ি গিয়ে আমন্ত্রণ জানাই। তিনি স্নেহশীল উষ্ণতায় সানন্দে রাজি হন। ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি প্রায় দু’ঘণ্টা ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। অনেক কবিতা পড়েছিলেন। কবিতার পড়ার সময় তাঁকে সেই ‘আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি’ কাব্যগ্রন্থের বেশ কয়েকটি কবিতা পড়তে অনুরোধ করি। তার একটি ছিল অবিশ্বাস্য তথা চমকপ্রদ— ‘মহারাজ আমি তোমার’। ‘আমি তোমায় চিমটি কাটি, মুখে দিই দুধের বাটি / চোখ থেকে চোখ পড়ে যায়, কোমরে সুড়সুড়ি পায় / তুমি খাও এঁটো থুতু, আমি তোমার রক্ত চাটি / বিলিবিলি খান্ডাগুলু বুম‌্ চাক্‌ ডবাং ডুলু / হুড়মুড় তা ধিন্‌না উসুখুসু সাকিনা খিনা / মহারাজ, মনে পড়ে না?’

ওই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি পাতায় আমার হৃৎকমলের রাঙা রেণু ছড়ানো আছে। যত দিন শ্বাস, ছড়ানো থাকবে। ফাইল ছবি।

উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেন, ‘‘এসব কবিতা এখন আর কেউ পড়ে?’’ আমি ঘাড় নেড়েছিলাম শুধু। উনি সবক’টি কবিতা আদর দিয়ে পড়েছিলেন। আমি সে দিন বলতে পারিনি, ওই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি পাতায় আমার হৃৎকমলের রাঙা রেণু ছড়ানো আছে। যত দিন শ্বাস, ছড়ানো থাকবে।

(লেখক কবি, অধ্যাপক। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন