coronavirus

পুলিশ আর আনাজের ভ্যান

লকডাউনে বহু শহরে পুলিশি অত্যাচারের দৃশ্য দেখা গিয়েছে।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২১ ০৫:৩৬
Share:

লকডাউনের মধ্যে বাইপাসের পাশের এক পাড়ায় একটা আনাজের ভ্যানের পাশে পুলিশের গাড়িকে ব্রেক কষতে দেখা গেল। এক জন পুলিশকর্মী নেমে এসে ভ্যান থেকে ওজনযন্ত্রটা তুলে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন, গাড়ি ছেড়ে দিল। রসিদ কাটার প্রশ্নই নেই। এ হল বেলা দশটার পরেও রাস্তায় থাকার ‘শাস্তি’।

Advertisement

আনাজের ভ্যান পুলিশের সহজ শিকার, কারণ তা সম্পূর্ণ অবৈধ। অটো বা টোটোকে একটা ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসার যেটুকু চেষ্টা হয়েছে নানা পুরসভায়, ভ্যানের ক্ষেত্রে তা-ও দেখা যায়নি। এদের রেজিস্ট্রেশন বা লাইসেন্স হয় না, হওয়া সম্ভবও নয়। চালকের নিরাপত্তা কিংবা দূষণ নিয়ন্ত্রণের আইন মানার ক্ষমতা ভ্যান নির্মাতাদের নেই। এ হল গরিব চাষি-ব্যবসায়ীর জন্য গরিব মিস্ত্রির তৈরি গাড়ি। যদিও এই সব ভ্যান-বাহিত আনাজ, মাছ মধ্যবিত্ত, ধনী, সকলেই কেনেন। সেই কেষ্টবিষ্টুদের হাত থেকে বাজারের ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার সাধ্য পুলিশের নেই। তারা পারে আনাজের ভ্যান উল্টে দিতে। লকডাউনে বহু শহরে এই পুলিশি অত্যাচারের দৃশ্য দেখা গিয়েছে। ঘুরছে সমাজমাধ্যমে।

অনেক চাষি নিজেরাই ভ্যান কিনে নেন, চালক ভাড়া করেন। আবার অনেক বেকার যুবক ভ্যানে ফসল বয়ে রোজগার করেন। বাঁধা রুটে যাতায়াত করেন যে চালকরা, তাঁরা স্থানীয় থানায় তিনশো-চারশো টাকার মাসিক ব্যবস্থা করিয়ে নেন। সমস্যা হয় আলিনুর মোল্লার মতো চালকদের। “ভাঙড় থেকে কোনও দিন যাই মালঞ্চ, কোনও দিন বারাসত, বা মধ্যমগ্রাম। পুলিশ ধরলেই চেয়ে বসে দু’-তিন হাজার টাকা। শেষে পাঁচশো টাকায় হয়তো রফা হয়।” রবি সর্দার গড়িয়া ব্রহ্মপুরের পাইকারি বাজার থেকে আনাজ এনে বিক্রি করেন পিয়ারলেস হাসপাতালের কাছে। “ব্যাটারি গাড়ি অ্যালাউ হয়নি, এই বলে রাস্তায় ধরে পুলিশ,” জানালেন তিনি। এক বার ধরলে সঙ্গের সব টাকা কেড়ে নেয়, অমানবিক ব্যবহার করে, এ নালিশ মুখে মুখে।

Advertisement

প্রশ্নটা কেবল দুর্নীতির নয়, কৃষি বিপণন নীতির। নড়বড়ে, অবৈধ ভ্যানকে ভরসা করেই রোজ খেত থেকে পাইকারি বাজার, সেখান থেকে খুচরো বাজারে যায় ফসল। যে কোনও গ্রামীণ হাটে গেলে দেখা যায় ভ্যানের সারি। তাদের কোনওটার চেহারা এক রকম নয়— নানা রকম ইঞ্জিন, নানা রকম টায়ার, চালকের সিটের উচ্চতাও এক-এক রকম। ইঞ্জিনের জোর বুঝে পাঁচশো কেজি থেকে বারোশো কেজি মাল বয়, চলে ব্যাটারি, ডিজ়েল বা কেরোসিনে। বিকট আওয়াজ, বদখত ধোঁয়া, গতি ঘণ্টায় ৪০-৪৫ কিলোমিটার। নতুন ভ্যানের দাম পড়ে ৩৫ হাজার থেকে ৬৫ হাজার টাকা।

কৃষি পরিবহণের বৈধ দুনিয়ায় রয়েছে নানা মাপের ট্রাক— এক টনের মিনি ট্রাক (চলতি কথায়, ‘ছোট হাতি’) যথেষ্ট জনপ্রিয়। কিন্তু বাংলায় জমির মাপ ছোট, একটা ভ্যান ভরাতেই দু’তিন জন চাষির ফসল লাগে। একটা ‘ছোট হাতি’ ভরতে চাই অন্তত দু’হাজার কিলো ফসল, ভাড়া অন্তত বারোশো টাকা। ব্যবসায়ীদের মাপও খুব বড় নয়— একটা মাঝারি ট্রাক ভরাতে ৬-৭ জন, কখনও ১০-১২ জন ব্যবসায়ীর মাল লাগে। এই জন্য কিসান রেল চালু হলেও তাতে তেমন সুবিধে হয়নি বাংলার চাষির। পূর্ব রেলের এক আধিকারিক জানালেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রথম কিসান রেল যায় ২৯ জানুয়ারি, তারকেশ্বর থেকে নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর। নিয়ে যায় প্রধানত আলু-পেঁয়াজ। চাষিদের সুবিধের জন্য রেল নিয়ম করে, রাস্তায় যে কোনও স্টেশনে মাল তোলা বা নামানোর জন্য গাড়ি দাঁড়াতে পারবে। তা সত্ত্বেও মার্চ মাস পর্যন্ত মাত্র ছ’বার যাতায়াত করেছে সেই ট্রেন। বয়েছে মোট ১১৭২ টন মাল, যার আর্থিক মূল্য ৪৭ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ, কৃষির বিপণনে চাহিদা জোগানে গরমিল হচ্ছে। সরকার যা দিচ্ছে, তা চাষির কাজে লাগছে না। আর চাষি যা কাজে লাগাচ্ছেন, সরকার তা থেকে মুখ সরিয়ে রেখেছে। যা বাংলার আনাজ চাষির কাজে লাগতে পারত, তা হিমায়িত পরিবহণ। আক্ষেপ, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে সারা রাজ্যে রেফ্রিজারেটেড ট্রাক আছে ডজন দুয়েক। অতএব তাজা আনাজ বেচে লাভ করতে চাইলে চাষির একমাত্র উপায়, যথাসম্ভব দ্রুত আনাজ বাজারে পৌঁছনো।

প্রান্তিক চাষির ফসল কী করে যাবে বাজারে, সে প্রশ্নটা নীরবে এড়িয়ে যাচ্ছে সরকার। তাতে চাষির ক্ষতি কত, চাষি নিজেও তা খেয়াল করেন না। কৃষি বিপণনের ভর্তুকি পান বড় ব্যবসায়ীরা, যাঁরা ট্রাকে বা ট্রেনে মাল পাঠান। ২০১৬-১৭ সালে আলু ব্যবসায়ীদের ১৯ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছিল রাজ্য সরকার। চাষিদের কোম্পানি (এফপিসি) ট্রাক কিনলে দামের ৫০ শতাংশ ভর্তুকি পায়। কিন্তু কৃষক, বা কৃষি পরিবহণ কর্মীকে টাকা ধার করতে হয় পরিচিত কারও কাছ থেকে, সুদ মাসে পাঁচ-দশ শতাংশ। ডিজ়েলের আকাশ-ছোঁয়া দাম দেন, তার পরেও পুলিশের ঘুষের দাবি মেটান।

চাষিকে দূষণহীন, সাশ্রয়কারী, দ্রুতগতির বৈধ পরিবহণ দিতে কী করতে চায় রাজ্য সরকার, ঘোষণা করুক এ বার। আর কত দিন মধ্যবিত্তকে সব্জি খাওয়াতে দরিদ্র চাষি পুলিশকে ‘অনুদান’ দেবেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন