Literary Works

বিনা অপেক্ষায় স্বীকৃতি

সমাজমাধ্যমে সাহিত্য ও সঙ্গীতের রমরমা নিয়ে মুখ খোলাটা অনেকাংশে যেন বিজ্ঞান নিয়ে ছোটবেলায় মুখস্থ-লেখা রচনার মতো— ‘উন্নয়ন’ মাত্রেই তার সুফল ও কুফল থাকবে।

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০২৪ ০৭:৪৭
Share:

নতুন গানের জন্য এখন যেমন আর কেউ পুজোর পথ চেয়ে বসে থাকে না, নতুন লেখার জন্যও কি আর পুজোসংখ্যা বা বইমেলার প্রতীক্ষা রয়েছে? এখন লেখা আর গানের বিপুলাংশই আগে পাঠক-শ্রোতার কাছে সরাসরি চলে আসে— অনলাইনে, সমাজমাধ্যমের দৌলতে। আর এখানেই আমাদের, বিশেষত প্রাচীনপন্থীদের, হতাশা ও বিরক্তি। অনেকের মতে, এখনকার বাংলা গান আর সাহিত্য পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়; আর তার জন্য দায়ী শুধুমাত্র সমাজমাধ্যম।

Advertisement

সমাজমাধ্যমের বিপক্ষে প্রথম ও প্রধান অভিযোগ হল, সেখানে যে চায়, সে-ই গায়ক, সে-ই সাহিত্যিক। সকলেই যে কবি নন, এবং কোনও দিনই যে হতেও পারবেন না, এই সারসত্যটি সমাজমাধ্যম আমার মতো ভুঁইফোঁড় সাহিত্যিকের মুখের উপরে বলে না। তার চেয়েও বড় সমস্যা হল, অধিকাংশ সমাজমাধ্যমের পাতায় কোনও সম্পাদক নেই যিনি ভাল-মন্দ বিচার করে শ্রোতা-পাঠকের কাছে শুধুমাত্র ভালটাই পৌঁছে দেবেন। অনেকের ধারণা, এ-হেন দ্বাররক্ষক নেই বলেই ভাল গান বা লেখা তৈরিই হয় না।

সমাজমাধ্যমে সাহিত্য ও সঙ্গীতের রমরমা নিয়ে মুখ খোলাটা অনেকাংশে যেন বিজ্ঞান নিয়ে ছোটবেলায় মুখস্থ-লেখা রচনার মতো— ‘উন্নয়ন’ মাত্রেই তার সুফল ও কুফল থাকবে। উল্টো দিকের সবচেয়ে বড় যুক্তি হল, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে, বাংলা গল্প-উপন্যাস, কবিতা-গান আর আমাদের সে ভাবে মন কাড়ে না, তা হলেও, বাংলা গানের স্বর্ণযুগের শেষ চিহ্নটুকুও আমরা কয়েক দশক পিছনে ফেলে এসেছি— নব্বইয়ের দশকে, বা বড় জোর এই শতকের গোড়ায়। মৌলিক লেখা-গানের মান তো সমাজমাধ্যমের উত্থানের অনেক আগে থেকেই নিম্নমুখী।

Advertisement

সৃষ্টির এই গণতন্ত্রীকরণ থামানোর কী প্রয়োজন? জীবনস্মৃতি শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন লিখবেন? যা প্রত্যক্ষ করছি, তা নিয়ে, আমার গানে-লেখায় ভুবন ভরিয়ে দিতে আমি নিজেও পারি বইকি। নীরদচন্দ্র চৌধুরী নিজেই তো অখ্যাত অপরিচিত বাঙালির আত্মকথা লিখে শুরু করেছিলেন। আর, পরিমাণ বেশি মানেই যে মান নিম্নমুখী হবে, তার কোনও সঙ্গত ব্যাখ্যা তো নেই। বরং, সবাইকে ‘আত্মপ্রকাশ’-এর স্বাধীনতা দিলে, সমাজমাধ্যমকে পোষণ-তোষণ করলে, হয়তো সৃষ্টি-কৃষ্টির মান বাড়তে পারে। ‘করতে করতে কাজি’, অতএব, অনেকে মিলে অনেক-অনেক লিখলে, গাইলে, তার মধ্যে কিছু ভাল কাজ তো বেরোবেই।

সর্বোপরি, সম্পাদকমাত্রেই যে ঠিক সোনা চেনেন, তারও তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। ব্যক্তিগত ভাবে সম্পাদকের সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদেই লেখা ছাপা হয়, এই নেপোর গল্পও বাজারে কান পাতলে শোনা যায়। সমাজমাধ্যম পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত লেখক-গায়কদের আমাদের সন্নিকটে যেমন এনেছে, তেমনই দিয়েছে অপরিচিত নতুন প্রতিভার সন্ধান।

এই দুই পক্ষের বিবাদ ও তর্কের তাই কোনও মীমাংসা হয় না। কার্য-কারণ নির্ধারণের আগে সমাজমাধ্যমকে তো কাঠগড়ায় তোলা চলে না। সমাজমাধ্যমে দ্বাররক্ষক কেন দরকার, সেই তর্কে না ঢুকে বরং আধুনিক বাংলা লেখার-গানের মানের অবনমনের পিছনে সমাজমাধ্যমের আদৌ কোনও অবদান আছে কি না, সেটা অর্থনীতির যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা যাক।

আগেকার যুগের সঙ্গে আজকের সমাজমাধ্যমের যুগের তফাত শুধু দ্বাররক্ষকের নয়। আরও দুটো বড় ফারাক আছে। প্রথমত, প্রাক্‌-সমাজমাধ্যম যুগে ভাল-লাগা দেখানোর মূল্য বা কারেন্সি ছিল পকেটের অর্থ। ছাত্রাবস্থায় পয়সা জমিয়ে একটা করে ক্যাসেট কিনতাম। সেই যুগেই চালু হয়েছিল কিশোরকণ্ঠী, লতাকণ্ঠীদের গানের তুলনামূলক ভাবে বেশ সস্তার ক্যাসেট। বাজার বিভাজন হল— দুই প্রকার জিনিসের দু’রকম দাম, পরিভাষায় যাকে বলে ‘প্রোডাক্ট ডিফারেন্সিয়েশন’। দামটা স্থির করতেন বিক্রেতা বা পরিভাষায় ‘প্রোডিউসার’রা, এ ক্ষেত্রে, ক্যাসেট কোম্পানি। আমরা অনেকেই কিন্তু সে বাজারেও জমানো টাকা দিয়ে ‘অরিজিনাল’ জিনিস ছাড়া কিনতাম না। পর্যাপ্ত টাকা না হলে অপেক্ষা করব, কিন্তু ‘ডুপ্লিকেট’ কিনব না— এমনই ছিল কিছু ক্রেতার মানসিকতা।

তুলনায়, এখনকার বাজারদর হল ‘লাইক’। আসলে, মুদ্রাটা এখন হল আমাদের বা ক্রেতাদের নিজেদের ব্যক্তিগত সময়, যা আমরা একটা লেখা বা গান পড়তে-শুনতে ব্যবহার করি। সেখানে কিন্তু বাজারদর দু’রকম হয় না— কিশোরকুমারের গান শুনতে যা সময় লাগে, কিশোর-কণ্ঠের একটা শর্ট বা রিল দেখারও ঠিক ততটাই; অর্থাৎ, দুটো জিনিস আলাদা হলেও তাদের ‘ইউনিট-প্রাইস’টা এক।

আর এখানেই চলে আসে অর্থনীতির মডেল, যা দিয়ে হয়তো একটা ব্যাখ্যা খাড়া করা যেতে পারে। সেটা হল, উনিশ শতকের ‘গ্রিশ্যাম’স ল’ অথবা বিশ শতকের ‘লেমন’স মডেল’। যুক্তিটা সহজ ভাষায় বললে, মুড়ি-মুড়কির এক দর হলে বাজারে ভাল জিনিস আর মেলে না। আমেরিকাতে ‘লেমন’ শব্দটার প্রচলিত মানে হল খারাপ, পুরনো গাড়ি। নোবেলজয়ী জর্জ একারলফ প্রমাণ করেছিলেন, ব্যবহৃত গাড়ির বাজারে ভাল গাড়ি থাকবেই না, শুধুই লেমন বিক্রি হবে। আর এটাই হয়তো সমাজমাধ্যমের কুফল।

পুরনো যুগের তুলনায় সমাজমাধ্যমের আরও একটা ফারাক হল, সকলকে জায়গা করে দেওয়ার অপরিসীম স্থান। আগেকার দিনে, পত্রিকা সম্পাদককে সেরাটা বেছে নিতেই হত, কারণ পাতার সংখ্যা ছিল বাঁধা। সেই মডেলে দ্বাররক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অন্যের বাছাই করা লেখা বা গান পাঠক-শ্রোতা হিসাবে আমরা পেতাম— সেটা দাম দিয়ে কিনব বা শুনব কি না, আমাদের চয়নের অধিকার সীমাবদ্ধ ছিল সেটুকুতেই। বেছে নেওয়ার জন্য ছিল দু’টি বিকল্প— হ্যাঁ, অথবা না। যদি মনে করি যে, কোনও পত্রিকার সম্পাদক সেরা লেখা বাছাইয়ের কাজটা ঠিকই করেছেন, তা হলেই সেই পত্রিকা কিনব, নচেৎ নয়। অর্থাৎ, ভেবে দেখলে, ক্রেতার প্রদেয় মূল্য এক জন মধ্যস্বত্বভোগীর হাত ঘুরে লেখক বা শিল্পীর কাছে আসত। এখনকার মডেলে লেখক বা গায়কের সঙ্গে ক্রেতার সম্পর্ক সরাসরি, কোনও মধ্যস্বত্বভোগী নেই। বাছাই করার প্রয়োজনই নেই, কারণ জায়গার কোনও কমতি নেই।

এখানেই মাথায় আসে অর্থনীতির আর একটা মডেল— কনটেস্ট থিয়োরি বা প্রতিযোগিতার তত্ত্ব। অর্থনীতিতে ‘কনটেস্ট’ হল যখন অনেকে পরিশ্রম করছেন একটা পুরস্কার লাভের জন্য, সেটা অর্থ বা সম্মান যা-ই হোক না কেন। কিন্তু, পুরস্কার একটাই, অথবা সীমিত। যেমন, পত্রিকার পাতা, রেডিয়োর স্লট বা এগারো জনের ক্রিকেট টিমে জায়গা। প্রতিযোগীরা সবাই চেষ্টা বা পরিশ্রম করবেন পুরস্কার পেতে। এই মডেলে জয়ের সম্ভাবনাটা হল আনুপাতিক— নিজের পরিশ্রমটা সামগ্রিক পরিশ্রমের তুলনায় যাঁর যত বেশি, পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনাও তাঁর তত বেশি। তাই, পরিশ্রম করলে পুরস্কার মিলবে, এই আশায় গায়ক-লেখকরা ভাল কাজ করতেন, আর আমরা পাঠক-শ্রোতারা তার সুফল পেতাম।

তুলনায়, এখনকার সমাজমাধ্যমে জায়গা বা পুরস্কার সকলের জন্যই আছে। অতএব, সেই অর্থে কোনও ‘কনটেস্ট’ নেই। বদলে, আছে আমাদের দৃষ্টি বা সময় আকর্ষণ করার এক কদর্য প্রতিযোগিতা। তাই হয়তো গায়ক-লেখকেরা আর পুরস্কার পাওয়ার পরিশ্রম করেন না; আমরাও তাই আর কোনও দিনই স্বর্ণযুগ ফিরে পাব না।

এই পত্রিকাতেই সুবোধ সরকার (‘যদি বাংলাতেও লেখেন’, ১৫-৯-২৩) লিখেছিলেন, “শ্রম, প্রতিভা ও সাধনা... এই তিনটে থাকলেই হয় না। তার পরও একটা জিনিস লাগে। ‘সা’। ত্রিশ বছর ধরে প্রতি দিন আট ঘণ্টা প্র্যাকটিস করেও বহু গায়ক, বহু লেখক ‘সা’ লাগাতে পারেন না। ‘সা’ সবার কাছে আসে না।” আজকের নতুন লেখক-গায়করা হয়তো সেই ‘সা’-এর প্রতীক্ষায় আর বসে থাকতে চান না। বিভিন্ন লেখকের স্মৃতিকথায় পড়ি, সম্পাদকের টেবিল থেকে বারে বারেই ফিরে এসেছে লেখা, তাঁরা আবার লিখেছেন, আরও পরিশ্রম করেছেন। শেষ পর্যন্ত লেখা মনোনীত হয়েছে, লেখক হিসাবে ক্রমে স্বীকৃতিও এসেছে। অলস কৌতূহল হয়— তাঁরা যদি আজ লেখা শুরু করতেন, সেই সম্পাদকের মন জয়ের অপেক্ষায় থাকতেন কি? না কি, তাঁরাও আত্মপ্রকাশের মাধ্যম হিসাবে বেছে নিতেন সমাজমাধ্যমকেই?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন