Euro 2020

গোল হলে ভাল, নইলে কালো

কালো-বাদামি মানুষ দেশ দখল করে নিচ্ছে, এই বিপন্নতার জমিতেই তো জাতিবিদ্বেষ সার-জল পায়।

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০২১ ০৪:২২
Share:

রহিম স্টার্লিংয়ের সৌভাগ্য, টাইব্রেকারে পেনাল্টি কিক নেওয়ার লিস্টিতে তাঁর নাম ছিল না। যদি থাকত এবং ইউরো ফাইনালে সেটা ফস্কাতেন, তা হলে সোশ্যাল মিডিয়া জামাইকার কবরখানায় শুয়ে থাকা তাঁর পূর্বপুরুষদেরও ছেড়ে কথা বলত না!‌ টাইব্রেকারে গোল করতে ব্যর্থ ইংল্যান্ডের অন্য তিন কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারের হাল সবার জানা। রহিম অবশ্য ফাইনালের আগে থেকেই জাতিবিদ্বেষীদের পছন্দের চাঁদমারি। গ্রুপ লিগ ও নকআউট পর্বে গোলের সুযোগ তিনিও নষ্ট করেছেন, অধিনায়ক হ্যারি কেন-ও। রহিম তবু ইংল্যান্ডের হয়ে ইউরো কাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা, হ্যারি ফর্মের ধারেকাছেও ছিলেন না। তবু তাঁর শরীরে খাঁটি ব্রিটিশ রক্ত, অভিবাসনের ভেজাল নেই। তাঁর দেশপ্রেমও তাই সব সন্দেহের ঊর্ধ্বে।

Advertisement

জামাইকান অভিবাসী মায়ের ছেলে রহিম‌ ছোটবেলায় কিংস্টনের যে পাড়ায় থাকতেন, সেখানে দিনরাত মারপিট, খুনোখুনি। গুলির আওয়াজ শুরু হলেই খেলা বন্ধ। ঘাতক বুলেট কেড়ে নিয়েছিল তাঁর বাবাকেও। চেপে রাখা কষ্ট বিকট রাগে ফেটে পড়ত, ফুটবলেও সামলানো যেত না। লন্ডনে স্কুলে ভর্তি হলে এক মাস্টারমশাই বলেছিলেন, এ ভাবে চলতে থাকলে সতেরো বছর বয়সে তুমি হয় ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে খেলবে, নয়তো জেলের ঘানি টানবে। যখন সিনিয়র জাতীয় দলে সুযোগ পাচ্ছেন, রহিম তখন আঠারো। জাতীয় দল ও প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুল, ম্যাঞ্চেস্টার সিটি-র হয়ে সাফল্য তাঁকে অর্থ, সচ্ছলতা সব দিয়েছে। তিনিও কৃতজ্ঞ।

তাতে কী! একটা-দুটো ম্যাচে গোল না পেলেই, ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ঠেলে ‘‌কালো’ পরিচয়টাই উঠে আসে। নানা দেশের অভিবাসী ফুটবলারদের ললাটলিখন একই। বেলজিয়ামের কঙ্গো-জাত স্ট্রাইকার রোমেল লুকাকু সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “রোজ গোল করলে আমি দেশের গর্ব, আদরের ‘বেলজিয়ান স্ট্রাইকার’, আর ভাল না খেললেই ‘‌কঙ্গো-জাত’ অভিবাসী ফরোয়ার্ড!” একই প্রতিধ্বনি মেসুট ওজ়িলের গলাতেও। তুরস্ক-জাত ওজ়িল ২০১৪-র বিশ্বকাপজয়ী জার্মান দলের মিডফিল্ডার। জার্মানিতেই বড় হওয়া। তাঁরও মনে হয়েছে, দল যত ক্ষণ জিতছে, তাঁর ‘‌জার্মান’‌ পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। হেরে গেলেই তুর্কি ‌যোগ‌ নিয়ে টানাটানি। তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান এর্দোয়ানের সঙ্গে তাঁর এক সৌজন্য-সাক্ষাৎকার ঘিরে এমন হট্টগোল, ওজ়িল আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে হঠাৎ অবসর নিলেন।

Advertisement

ইউরো ফাইনালে পেনাল্টি নষ্ট না করলে মার্কাস র‌্যাশফোর্ডও কি জানতে পারতেন, জন্ম ইস্তক জেনে আসা স্বদেশটা কতটা অচেনা!‌ তাঁর দিদিমা সেই কবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় থেকে ইংল্যান্ডে চলে এসেছিলেন। মার্কাসের জন্ম দক্ষিণ ম্যাঞ্চেস্টারে। সংসার চালাতে মাকে দিনে তিনটে চাকরি করতে হত। ফুটবল আর ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড মার্কাসের জীবন বদলে দেয়। তাঁর অস্তিত্বের কোথাও ওয়েস্ট ইন্ডিজ় নেই। গত বছর লকডাউনের সময় থেকে তিনি ম্যাঞ্চেস্টারের গরিব মহল্লার স্কুলগুলোয় বাচ্চাদের দু’‌বেলা খাবারের বন্দোবস্ত করেছিলেন। কৃতজ্ঞ এলাকাবাসী দেওয়ালে তাঁর মস্ত ম্যুরাল বানিয়েছিলেন। ইউরো ফাইনালের পর বর্ণবিদ্বেষী জনতা তাতে কালি মাখিয়ে দেয়। ‌‌

এই কালির উৎস ইউরোপের অভিবাসন-বিরোধী দক্ষিণপন্থী রাজনীতি। নব্বইয়ের দশক থেকে ইউরোপের নানা দেশের জাতীয় ফুটবল দলে অভিবাসীদের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্ম জায়গা করে নিতে লাগলেন, দক্ষিণপন্থীরাও লেগে পড়লেন। ইউরোপের প্রথম মিশ্র সংস্কৃতির ফুটবল দল ফ্রান্স ’৯৮-এ বিশ্বকাপ ও ২০০০-এ ইউরো জেতার পর তারা আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। ফ্রান্সের চরম দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের সুপ্রিমো জাঁ ল্যঁ পেন ও পরে তাঁর মেয়ে, নেত্রী মেরি ল্যঁ পেনও ফরাসি ফুটবলে মিশ্র সংস্কৃতিকে আক্রমণ করেছেন। জ়িনেদিন জ়িদানের দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন: আলজেরিয়ার জ়িদান আবার কিসের ফরাসি?‌‌ ২০০৬-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে ইটালি জেতার পর সে দেশের তখনকার দক্ষিণপন্থী সরকারের এক মন্ত্রী বলেছিলেন, যাক বিশ্বকাপটা শেষ অবধি কৃষ্ণাঙ্গ, মুসলিম আর কমিউনিস্টদের হাতে গিয়ে পড়ল না!‌

এ বারের ইউরো কাপের পর ইটালির কোনও নেতাকে অবশ্য মুখ খুলতে শোনা যায়নি। যদিও এই ইংল্যান্ড দলেও মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাব কম ছিল না। ২৬ জনের দলে অর্ধেকেরই বাবা-মা অথবা দাদু-ঠাকুমার মধ্যে এক জনের জন্ম ইংল্যান্ডের বাইরে। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের ভিত কাঁপাতে এই তথ্যই যথেষ্ট। কালো-বাদামি মানুষ দেশ দখল করে নিচ্ছে, এই বিপন্নতার জমিতেই তো জাতিবিদ্বেষ সার-জল পায়। ইউরো ফাইনালের পর সাকা-স্যাঞ্চো-র‌্যাশফোর্ডের উপর বর্ণবিদ্বেষী আক্রমণের বিরুদ্ধে সরকার কড়া মনোভাব নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ‘‌লজ্জাজনক’‌, হোম সেক্রেটারি প্রীতি পটেল (‌‌যিনি নিজেও জাতিবিদ্বেষী কুকথা সয়েছেন)‌‌ বলেছেন ‘‌বিরক্তিকর’‌। কিন্তু ইউরোর প্রতিটা ম্যাচের আগে ইংল্যান্ডের সব ফুটবলার যে ভাবে হাঁটু মুড়ে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন, প্রীতি তাকে ‘‌অঙ্গভঙ্গির রাজনীতি’‌ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। গ্যালারির একাংশ এই প্রতিবাদকে বিদ্রুপ করছিল, সেটাকেও ‘ওদের ব্যক্তিগত মতামত’‌ বলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। জাতীয় দলের ডিফেন্ডার টাইরন মিং তাই সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন, জাতিবিদ্বেষের আগুন যখন ধিকিধিকি জ্বলছে, তখন তা নেবানোর চেষ্টা না করে তোমরা আরও বেশি উস্কে দিলে, এখন মায়াকান্না কেঁদে কী হবে?‌

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন