Stan Swamy

Stan Swamy: বন্দির অধিকার গণতন্ত্রেরই দায়

আধুনিক রাষ্ট্র সুচারু ভাবে নাগরিক জীবন ও অরক্ষিত জীবনের মধ্যে যে পার্থক্য করে, তারই নমুনা কারাবন্দির নাগরিকত্বের মৃত্যু।

Advertisement

শুভদীপ মণ্ডল ও অর্যমা ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২১ ০৪:৪৪
Share:

এক দিকে, স্ট্যান স্বামীর জামিনের বিরোধিতা করে তদন্তকারী সংস্থা। অন্য দিকে, তখনই সংশোধনাগারের ভিড় কমাতে বিচারাধীন বন্দিদের জামিনে মুক্তি দেওয়ার কথা বলে সুপ্রিম কোর্ট। রাজনৈতিক ও অন্য বন্দিদের প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্রের এমনই দ্বিচারিতা সামনে উঠে এল স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুতে।

Advertisement

২০১৮-র পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ধারণক্ষমতার চেয়ে ১৭ গুণ বেশি কয়েদি আছেন সংশোধনাগারে। উত্তরপ্রদেশে সংখ্যাটি ৫০ গুণেরও বেশি। এবং, সাজাপ্রাপ্ত কয়েদির তুলনায় বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা ভারতেই সবচেয়ে বেশি। চিরাচরিত বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা বহুখ্যাত। বিচার ও কারা বিভাগের প্রচুর পদ অনেক বছর ধরে খালি। ৩৩ শতাংশ কারা অফিসার এবং ২৮ শতাংশ কারা রক্ষীর পদ খালি। কাজের চাপও তাই পাহাড়প্রমাণ। প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুর বিচারকের কাজের চাপের অভিযোগ জানাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামনেই কেঁদে ফেলেছিলেন। তাতেও পরিস্থিতি বদলায়নি। এ ভাবেই চলছিল বৃহত্তম গণতন্ত্র, কিন্তু তার দ্বিচারিতা তুলে ধরল অতিমারি। করোনা পরিস্থিতিতে বন্দিদের হাসপাতালে ভর্তি করে পরিষেবা দেওয়ার নিরিখে যথাক্রমে এক ও দু’নম্বর আছে কেরল ও মহারাষ্ট্র। সংক্রমণের হারও ওই দুই রাজ্যে বেশি। তাই পরিস্থিতি সামলাতে প্রায় ১,১০০ বন্দিকে প্যারোলে বা বন্ডে মুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মহারাষ্ট্র। সেই পথে হাঁটে উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, রাজস্থানও। অথচ, তার সঙ্গেই বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবী, রাজনৈতিক কর্মীদের জামিনের বিরোধিতা চলেছে। উদাহরণ, স্ট্যান স্বামী।
আসলে, বন্দিদের মুক্তি দিলে নাগরিকদের ‘সুরক্ষা’র সঙ্গে আপস করা হয়, না দিলে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিপদ। রাষ্ট্র হয়তো এক ধাপ এগিয়ে ভাবে, যদি বা কিছু ‘সাধারণ’ অপরাধীকে ছাড় দেওয়া যায়, ‘দেশদ্রোহ’-এ যুক্ত লোকেদের ব্যাপারে কি এত সহজে নিষ্পত্তি হয়! এই উভয়সঙ্কট এক নৈতিক প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত— বিচারাধীন বন্দিদের নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন। আমাদের দেশে কারাবন্দিদের ভোটাধিকার নেই, অর্থাৎ তাঁরা ‘সুস্থ’ নাগরিক নন। সেই যুক্তিতে তাঁদের কারাগারের বাইরে রাখা অন্যদের পক্ষে বিপজ্জনক, অন্তত রাষ্ট্রের চোখে। কিন্তু সংক্রামক রোগের মধ্যে অপরিসর স্থানে ফেলে রাখাও মৃত্যু পরোয়ানার শামিল। তাই অতিমারির সময়ে রাষ্ট্র ‘কল্যাণমূলক’ হওয়ার বদলে ক্রমশ ‘দ্বিধাদীর্ণ’ হয়ে যাচ্ছে। মুখোমুখি এসে দাঁড়াচ্ছে ‘সুরক্ষা’ ও ‘কল্যাণ’।

জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫১-র ৬২(৫) ধারা অনুসারে কারাবন্দিদের ভোটাধিকার অস্বীকৃত। নাগরিক অধিকারের এই বিলোপ আইন মোতাবেক ঠিক হলেও এখন বহু দেশই তা থেকে সরে এসেছে। ২০০৫ সালে ‘হার্স্ট ভার্সেস ইউনাইটেড কিংডম (নং ২)’ নামক বিখ্যাত মামলার সুবাদে ব্রিটেনে সমস্ত কারাবন্দির ভোটাধিকার হরণের নিয়মটি বাতিল হয়। অপরাধের ধরন দেখে তা ঠিক করার কথা ভাবছে অনেক দেশই। যেমন, আমেরিকা বা কানাডা। ২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারেও তাঁদের ভোটাধিকার নিয়ে কথা উঠেছিল।

Advertisement

ভোটদানের মতো নাগরিক অধিকার নিয়ে নিলে যেমন ব্যক্তির নাগরিকত্বের অপমৃত্যু ঘটে, তেমনই ব্যক্তির সমাজসাপেক্ষ অস্তিত্বের সুরক্ষা, যা রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তি, তারও অবলুপ্তি ঘটে। আর এই চুক্তি মুছে গেলেই ব্যক্তির অবস্থান রাষ্ট্রের কাছে অরক্ষণীয় হয়ে যায়। ইটালীয় দার্শনিক জর্জিয়ো আগামবেন-এর তত্ত্ব অনুসারে, আধুনিক রাষ্ট্র সুচারু ভাবে নাগরিক জীবন ও অরক্ষিত জীবনের মধ্যে যে পার্থক্য করে, তারই নমুনা কারাবন্দির নাগরিকত্বের মৃত্যু। এ ভাবেই ইহুদি নাগরিকদের হত্যার আগে নাগরিকত্ব কেড়ে নিত নাৎসিরা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এই বৈশিষ্ট্য তার স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা জিইয়ে রাখে। অথচ, কারাবন্দিদের ভোটাধিকার দিয়ে সমস্যার সমাধান হতে পারে, তাতে নাগরিকত্বের মৃত্যু রোধ করা যায়।

ইউএপিএ নামক আইনের বলে বিনা বিচারে বন্দি ছিলেন স্ট্যান স্বামী। করোনার সময় বহু বন্দি মুক্তি পেলেও তিনি পাননি। এটাই রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রের সমস্যা, যা গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারের মধ্যে আদর্শগত সান্নিধ্যের ছবি তুলে ধরে। করোনা-কালে বন্দিদের মুক্তি দেওয়া ‘কল্যাণ’কামী রাষ্ট্র এ ভাবেই গঠনতন্ত্রের কারণে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। এই স্বৈরাচারের দায় মুষ্টিমেয়র থেকেও বেশি সেই ব্যবস্থার, যা তার পথ প্রশস্ত করে। আগামবেন বলেছিলেন, মানবিক প্রতিবাদই আইনানুগ হিংসার প্রতিকার করতে পারে। কিন্তু ‘জরুরি অবস্থা’র সুযোগ নিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র সেই প্রতিকারের পরিসরটিও কমিয়ে আনে। করোনার সময়ে তাই সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার অধিকার বাদ পড়ে। কিন্তু এই অবস্থাই যদি স্বাভাবিক হয়ে যায়, তা হলে মানবিক প্রতিবাদ দিয়ে আর রাষ্ট্রের আগ্রাসন থামানো যাবে না। আগামবেন হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। স্ট্যান স্বামী হননি।

এই মৃত্যু যদি গণতন্ত্রের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনতে পারে, তা হলেই প্রকৃত মর্যাদা পাবেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন