গত দু’শতকে বিদ্যুৎ, টেলিফোন, অ্যান্টিবায়োটিক, সবুজ বিপ্লব, কম্পিউটার, ইন্টারনেট— কত কী পেয়েছে মানুষ। তার প্রতিটিই সহায়ক হয়েছে মানুষের ক্রমোন্নতিতে— আবার, প্রতিটিই বয়ে এনেছে নতুন ধরনের বিপদ। ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর তারিখটি মানুষের উন্নতির এই যাত্রাপথের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সে দিন চ্যাটজিপিটি নামে একটি মহাশক্তিশালী চ্যাটবট-এর আবির্ভাব হল। এর পিছনে যে ‘ডিপ লার্নিং’ প্রযুক্তি রয়েছে, তা শুধু টেক্সট বা ভাষা নয়, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস এমনকি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো যে কোনও কাজে ব্যবহার করা যায়। প্রযুক্তির স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বরা কেউ কেউ প্রথমে একে ‘বৈপ্লবিক’ বলে স্বাগত জানালেও, ধীরে ধীরে এর বিরুদ্ধমতই প্রবল হয়ে উঠল। উন্নত দেশগুলিতে এআই সংক্রান্ত গবেষণায় বেশ কিছু সতর্কতামূলক বিধিনিষেধ আরোপ করা হল, যার চূড়ান্ত সিলমোহর পড়ল যখন আধুনিক এআই-এর গডফাদার জেফ্রি হিন্টন নিজেই নৈতিক দায়িত্বের কথা বলে গুগল থেকে পদত্যাগ করলেন। অথচ, এআই-এর জয়যাত্রা অব্যাহত। অতি সম্প্রতি চ্যাটজিপিটি ভার্সন ৪.৫ ও আর একটি চ্যাটবট বিখ্যাত টিউরিং টেস্টেও পাশ করেছে। অর্থাৎ, মানুষের থেকে তাদের আলাদা করা কঠিন।
এই নতুন প্রযুক্তি এত বিতর্কিত কেন? কারণ, সমস্যাটা এআই-এর মূল প্রযুক্তি ‘ডিপ লার্নিং’ নিয়েই। ডিপ লার্নিং কাজ করে মানুষের মস্তিষ্কের অনুকরণে তৈরি নিউরাল নেটওয়ার্কের সাহায্যে। মডেলগুলিকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিপুল পরিমাণ তথ্য দিয়ে ‘প্রশিক্ষিত’ করা হয়। তার পর তারা এই তথ্যগুলির বিচার করে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম নকশা খুঁজে বার করে এবং কোনও বিষয় ‘শিখে নেয়’ অনেকটা মানুষের মতোই। আর, প্রথম আশঙ্কা তৈরি হয় এখানেই। ডিপ লার্নিং কী ভাবে কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা এর স্রষ্টারাও পুরোপুরি বোঝেন না। দ্বিতীয়ত, এর বুদ্ধিমত্তা ও অসীম ক্ষমতা। প্রায় মানুষের মতো সহজাত বুদ্ধি, সেই সঙ্গে বিপুল তথ্যভান্ডার। ফলে, অচিরেই একে নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে।
এআই-এর ঝুঁকি ঠিক কী কী? প্রথমেই আসে এর বৈষম্যময় ও ক্ষতিকারক উপাদানের কথা। ২০১৬ সালে, আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে বিচারব্যবস্থায় ব্যবহৃত কম্পাস নামক এআই সিস্টেম অডিট করে দেখা যায়, কৃষ্ণাঙ্গ অপরাধীদের শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় দ্বিগুণ অপরাধপ্রবণ বলা হচ্ছে। যদিও বাস্তব তথ্য তা বলে না। দুই, গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা লঙ্ঘন। যেমন, সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীদের অজানতে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে সেই অনুযায়ী রাজনৈতিক প্রচার করা। তিন, ভুল তথ্য পরিবেশন। ২০২৩ সালে নিউ ইয়র্কে এক কোর্ট-কেসে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে বেশ কিছু কাল্পনিক মামলার উদাহরণ দেওয়ায় এক আইনজীবী ও তাঁর ল-ফার্মকে জরিমানা দিতে হয়েছিল। সবচেয়ে বড়, এর ইচ্ছাকৃত ও দুরভিসন্ধিমূলক অপব্যবহার। যেমন, লোককে ভুল বোঝানো, প্রচার, নজরদারি ও সেন্সর চালানো তথা সাইবার-ফ্রড বা জালিয়াতি। ২০২৩ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জ়েলেনস্কি-র ডিপ-ফেক ভিডিয়ো বানিয়ে আত্মসমর্পণের ভুয়ো খবর ছড়ানো হয়েছিল। এই ভাবে ভোটের ফল প্রভাবিত করা, এমনকি যুদ্ধ বা দাঙ্গা বাধিয়ে দেওয়া খুবই সম্ভব। এই অবস্থায় ভারতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এর ফল কতখানি ভয়াবহ হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
তা ছাড়া, এই প্রযুক্তি ক্ষমতা ও সম্পদ মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী বা একনায়কদের হাতে কেন্দ্রীভূত করে আর্থসামাজিক অসাম্য বাড়িয়ে বিপুল কর্মহানি ঘটাতে পারে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সমীক্ষা বলছে, ইতিমধ্যেই সফটওয়্যার ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে। আর, শেষে রয়েছে এআই-এর সীমাবদ্ধতা ও যান্ত্রিক ত্রুটি। অদূর ভবিষ্যতে অত্যন্ত শক্তিশালী কোনও কম্পিউটারকে বিশেষ কোনও নির্দেশ দেওয়া হলে সে চাইবে যে-কোনও মূল্যে নির্দেশটি পালন করতে, তার জন্য সমাজ-পৃথিবী-পরিবেশ ইত্যাদি ধ্বংস হয়ে গেলেও তার কিছু যাবে আসবে না। অনেকটা জ্যাকবসের বিখ্যাত গল্প ‘দ্য মাঙ্কি’জ় প’-এর মতো। ইচ্ছাপূরণ হবেই, তবে বড় কঠিন মূল্যে।
তবে ঝুঁকির তালিকায় থাকলেও এআই সচেতন ও স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন হয়ে উঠবে, এই সম্ভাবনা এখনও অনেক দূরে। ‘কম্পিউটেশনাল থিয়োরি অব মাইন্ড’-এর তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের মন ও চেতনাকে সম্পূর্ণ ভাবে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামে পুরোপুরি ধরা সম্ভব। কিন্তু আদৌ সিলিকনের মস্তিষ্কে চেতনার সঞ্চার করা যায় কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে।
তবে এর বিপুল ক্ষমতাকে আয়ত্তে এনে জনহিতে ব্যবহার করে দুরারোগ্য রোগ সারানো, নতুন শক্তির উৎস সন্ধান, শিল্পক্ষেত্রে বিপুল উৎপাদন বৃদ্ধি, শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে তৈরি করা পাঠক্রম ও শিক্ষাপদ্ধতি, পরিবেশ-বান্ধব উৎপাদন ও পরিবহণ চালু করতে পারলে আমাদের গ্রহটি অনেক বেশি বাসযোগ্য হবে। চাই বা না-চাই, এই নতুন প্রযুক্তিকে নিয়েই আগামী দিনে চলতে হবে। ইতিহাস ও প্রযুক্তির সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, তাই প্রতিটি পদক্ষেপে অত্যন্ত সতর্কও থাকতে হবে।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে