রাষ্ট্রিক গণতন্ত্রের আগে প্রয়োজন সমাজের গণতন্ত্রীকরণ
State

আমাদের জীবন রাষ্ট্রময়

অনুরাধা রায়

শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:৪৮
Share:

দেড়শো কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে নাজ়ারেথের ছুতার মিস্ত্রি জোসেফ বেথলেহেমে যাচ্ছেন আসন্নপ্রসবা স্ত্রী মেরিকে গাধার পিঠে চাপিয়ে, নিজে পায়ে হেঁটে। কারণ রোমক সম্রাট অগাস্টাস জনগণনার আদেশ দিয়েছেন এবং যে-যার আদি বাসস্থানে গিয়েই নাম নথিভুক্ত করতে হবে। চার দিনের যাত্রার শেষে বেথলেহেমে কোনও সরাইখানায় জায়গা মিলল না। অগত্যা গোয়ালঘরে জন্ম নিলেন জিশু। শাসকের দাপটের কাছে ঈশ্বরপুত্রও অসহায়।

কাহিনির পরবর্তী পর্বটিও জানা। হেরড রাজা, যিনি ওই অঞ্চলে সম্রাটের অধস্তন শাসক, খবর পেলেন, একটি শিশু জন্মেছে, সে ‘ইহুদিদের রাজা’। ক্ষমতাচ্যুতির ভয় শাসকের স্বাভাবিক। বেথলেহেমে যত দু’বছরের কমবয়সি শিশু আছে, সবাইকে হত্যার আদেশ দিলেন হেরড। এই রাজা কিন্তু ইহুদিদের জন্য মন্দির বানিয়ে দিয়েছিলেন। শাসিতকে ত্রস্ত রাখার পাশাপাশি কিঞ্চিৎ তুষ্ট রাখাও তো শাসকের দরকার। দু’হাজার বছর আগেকার এই কাহিনির সঙ্গে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির সাদৃশ্য লক্ষণীয়। সাদৃশ্যের সূত্রটি হল রাষ্ট্র।

রাষ্ট্র বরাবরই সর্বোচ্চ সাংগঠনিকতার সর্বজনীন একক। সামাজিক সংহতি, সম্পদের সদ্ব্যবহার, জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনার যুক্তি দিয়ে রাষ্ট্র নিজের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করে। ব্যাপারটা আসলে অল্পসংখ্যক মানুষের হাতে ক্ষমতা, বাদবাকিদের তা মেনে নেওয়া। শাসনের সুবিধার্থে শাসক বরাবরই প্রজা থুড়ি নাগরিকদের সংখ্যা-সহ নানান তথ্য সংগ্রহে ব্যগ্র। অপছন্দ যাদের, তাদের বিলোপের চেষ্টাও স্বাভাবিক। তবে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের যুগেই জনগণনা নিয়মিত ও সর্বব্যাপী হয়ে দাঁড়াল। রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং জনজীবনকে বেশি করে আয়ত্তে আনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে তা সম্পর্কিত।

আমাদের দেশে প্রথম জনগণনা ব্রিটিশ আমলে, ১৮৭১-এ। তার পর থেকে জনসংখ্যা শাসকের তো বটেই, ভারতীয়দের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। স্মর্তব্য জাতীয়তাবাদী আত্মঘোষণা, ‘সপ্তকোটিকণ্ঠকলকল’, ‘তেত্রিশ কোটি মোরা নহি কভু ক্ষীণ’, ইত্যাদি। জাতিরাষ্ট্র তো নিছক দেশপ্রেম-উদ্দীপক নয়, ক্ষমতার ঘোষণাও বটে। তার সীমানা যেমন মানচিত্র দ্বারা সুনির্দিষ্ট, তেমনই তা জনসংখ্যা দিয়ে সুসংজ্ঞায়িত। সংখ্যার হিসাব শুধু নয়, ভারতীয়দের বর্গীকরণ করে, জটিল পরিবর্তনশীল পরিচিতিগুলিকে সরল ও স্থিরীকৃত চেহারা দিল বিদেশি শাসক। এক-একটি বর্গ চিহ্নিত করে ধর্মগোষ্ঠী, জাতিগোষ্ঠী (কাস্ট) ও জনজাতি (ট্রাইব)-র তালিকা তৈরি হল, যা প্রায়শই ঐতিহাসিক বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। এ ভাবেই ‘এথনোগ্ৰাফিক স্টেট’ হয়ে উঠে শাসক শাসিতকে দখলে রাখতে চায়। প্রশাসন আইন ইত্যাদির দৌলতে শাসিতের জীবনযাত্রায় এক ধরনের শৃঙ্খলা আসে, শাসক-প্রদত্ত সুবিধাগুলি পাওয়া যায়। অন্যথায় অস্তিত্বসঙ্কট। তাই সাধারণ মানুষেরও দায় থাকে রাষ্ট্রের কাছে বৈধতা প্রমাণ করার, তাতে তার যতই নিগ্রহ হোক।

ঔপনিবেশিক ‘লিমিটেড রাজ’-এর যুগ পেরিয়ে এসে স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতীয় রাষ্ট্রে অর্থনীতি ও সমাজের গভীরে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ জরুরি বলে ঘোষিত হল, আধুনিকীকরণ ও জনকল্যাণের যুক্তিতে। শাসনপ্রযুক্তি অনেকাংশে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র থেকেই ধার করা, আবার নতুন প্রযুক্তিও এল। রিপাবলিক ডে প্যারেড, ফিল্ম ডিভিশনের ছবি, পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু নির্ধারণ, গণমাধ্যমগুলিকে নিয়ন্ত্রণ, হরেক রকম দৃশ্য শব্দ ও বয়ান নির্মাণ— প্রাক্-স্বাধীনতা জাতীয়তাবাদের মর্মস্থলের ব্রিটিশবিরোধিতার আবেগকে এ বার রাষ্ট্রলগ্নতা দিয়ে প্রতিস্থপিত করল। আবার যখন-তখন যাকে-তাকে গ্রেফতার করে, মন্ত্রীসান্ত্রিদের গতায়াতের পথে ট্র্যাফিক স্তব্ধ করে দিয়ে, রেশন থেকে আধার ও আরও নানা কার্ড বিতরণ করে, বায়োমেট্রিক তথ্য দিতে বাধ্য করে, চালু মুদ্রা রাতারাতি অচল করে, ক’ঘণ্টার নোটিসে লকডাউন করে, আরও কত শত উপায়ে রাষ্ট্র বুঝিয়ে দিতে লাগল— আমি তোমার প্রভু, বাধ্য নাগরিক হওয়াতেই তোমার জীবনের সার্থকতা। আর সত্যি প্রভুকে না মেনে তো উপায়ও নেই। রাষ্ট্র সকলেরই ‘কমনসেন্স’-এ প্রোথিত। মন্ত্রী, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষ সবারই অংশগ্রহণ থাকে এই প্রক্রিয়ায়। যাঁরা র‌্যাডিক্যাল রাজনীতি করেন তাঁরাও এর বাইরে নন। পুঁজিপতিদের সঙ্গে যোগসাজশে দিনে দিনে এই প্রক্রিয়া প্রবলতর হয়।

দ্রষ্টব্য উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতের ক্ষেত্রে শ্রীরূপা রায়ের বিয়ন্ড বিলিফ বা সাধারণ ভাবে জনজীবনে রাষ্ট্রের ভূমিকা বুঝতে জেমস স্কট-এর সিইং লাইক আ স্টেট। দিয়ের্দ্রি মাস্ক-এর দি অ্যাড্রেস বুক দেখিয়েছে, আঠারো শতক থেকে এমনকি রাস্তা আর বাড়ির নাম/নম্বর দেওয়াও কী ভাবে রাষ্ট্রীয় ও সংশ্লিষ্ট ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। এই ভাবে রাষ্ট্র আমাদের জীবনের নির্ধারক হয়ে উঠতে চায়। আর ভারত তো যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও ‘বৈচিত্রের মধ্যে একতা’ আওড়ালেও গোড়া থেকেই অতিকেন্দ্রীকৃত রাষ্ট্র, উপরন্তু সামাজিক অসাম্যগুলি চাপা দেওয়ার পক্ষপাতী। যেটুকু যা সমাজ সংস্কার তা রাষ্ট্রের উদ্যোগে ও শর্তেই হতে হয়। রাজা আসে, রাজা যায়। রাজার জামার রং বদলায়, দিন বদলায় না। বরং রাজার জটিল জালের আবরণ জটিলতর হয়ে ওঠে এবং তার প্রসারিত হাতের বজ্রমুষ্টিতে ৬৯ঙ কি ৪৭ফ-রা আরও অসহায় হয়। ইদানীং ভারত-সহ সারা পৃথিবীতেই রাষ্ট্রবাদ আরও সঙ্কীর্ণচিত্ত, স্বৈরাচারী, নির্বিবেক ও নির্মম। উপরন্তু কোনও কোনও জনগোষ্ঠীর প্রতি তার বিশেষ বিরূপতা। কিন্তু সমাজ জুড়েই চলে রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তি ও বহিষ্করণের খেলা। তাই অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান না থাকলেও রাষ্ট্রের স্বীকৃতিমূলক কাগজ মানুষের থাকতেই হয় এবং নিরক্ষর হলেও ফর্ম ভরতে হয় পড়িমরি করে।

স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সঙ্গতির অভাব এবং তার ফলস্বরূপ গণতন্ত্রের সঙ্কট গবেষকদের ভাবিয়েছে। ‘নাগরিক সমাজ’-এর দুর্বলতার জন্য রাষ্ট্রকে তেমন চাপে রাখাও যায় না। রাষ্ট্রশক্তির প্রতিভূ রাজনৈতিক দলগুলি অবশ্য জনকল্যাণ ও উন্নয়নের নামে ‘রাজনৈতিক সমাজ’ তৈরি করেছে, যে জমিতে নানা গোষ্ঠী ও তাদের বহুমুখী স্বার্থকে রাষ্ট্র নিজের আওতায় সমন্বিত করতে চায় পৃষ্ঠপোষক-পৃষ্ঠপোষিতের লেনদেনের মাধ্যমে, যেখানে ন্যায়নীতি আইন ইত্যাদির বিশেষ তোয়াক্কা করা হয় না, যে আলোচনা করেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কল্যাণ আর উন্নতি অবশ্য হয় প্রধানত দলগুলির ও নেতাদের। কিন্তু এটাই রাষ্ট্রের ‘গভর্নমেন্টালিটি’, যা জনসাধারণের সার্বভৌমত্বের সাংবিধানিক কল্পনার সঙ্গে মেলে না। আসলে দুটো যেন আলাদা এলাকা, তাদের ভাষাও আলাদা। প্রথমোক্ত এলাকা জনকল্যাণ, সমৃদ্ধি, উপযোগিতা, কার্যকারিতার কথা বলে, দ্বিতীয়টি বলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সমানাধিকারের কথা। আদর্শ আর বাস্তবে বিরাট ফারাক থাকে। বড় জোর তৈরি হয় জনপ্রিয়তাবাদী গণতন্ত্র। আমাদের আসলে তলার দিক থেকে নয়, উপর দিক থেকে রাষ্ট্রচালিত গণতন্ত্র। বদ্রী নারায়ণ লক্ষ করেছেন, উত্তর ভারতে রাষ্ট্র ও গণতন্ত্র দুটোকেই ‘সরকার’ বলা হয়। এবং কথাটার অর্থ সুযুক্তিসম্মত সুশাসন নয়; অর্থ হল, ক্ষমতাশালী মানুষ— ‘হুজুর’ বা নেতা, যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতার ধারক। তাঁদেরই ভোট দিয়ে, তাঁদেরই অনুগত থেকে সাধারণ মানুষ বেঁচেবর্তে থাকার প্রয়াস করে।

আজ আমাদের জীবন রাষ্ট্রময়। ভগবান তথা দেবদেবীরাও রাষ্ট্রের অধীন। বলতে গেলে, রাষ্ট্রই ভগবান। তবু রাষ্ট্র তো সমাজ নয়। বিবিধ স্থান-কালের পটভূমিতে ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন, রাষ্ট্রের (একদা শক্তিশালী রাজা বা রাজবংশ, আজকের দিনে রাজনৈতিক দল) উত্থান-পতনের সঙ্গে সমাজের ভাল-মন্দ কিন্তু সব সময়ে মেলে না। উদাহরণ উত্তর-গুপ্ত বা মোগল খণ্ডীকরণের যুগে আঞ্চলিক স্তরে আর্থ-সামাজিক বিকাশ। রাষ্ট্র যতই প্রতাপশালী হোক, সেটাই সমাজের এমনকি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারও সবটা নয় এবং বিকল্প রাজনীতিও হতে পারে (যেমন পুঁজিবাদেরও প্রতাপের আড়ালে আছে অন্য রকম অর্থনীতি এবং বিকল্প অর্থনীতি অসম্ভব নয়)। গান্ধী রবীন্দ্রনাথের মতো ‘এনলাইটেন্‌ড অ্যানারকিস্ট’ আজ বিরল। মার্ক্সের তত্ত্ব যে রাষ্ট্র ক্রমে সরে যাবে, সেই স্বপ্নও বিলীন; তবু সমাজের তরফ থেকে রাষ্ট্রকে অন্তত নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যাবশ্যক।

দুর্ভাগ্যবশত, রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্র ও তার মোকাবিলার পন্থা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা এ দেশে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। তবে এটুকু মনে হয়, যে পন্থাই নেওয়া হোক, রাষ্ট্রিক গণতন্ত্রে সন্তুষ্ট না থেকে সমাজের গণতন্ত্রীকরণ আগে প্রয়োজন, যার শর্ত ব্যাপক ভিত্তিতে সামাজিক বোধোদয় এবং পরিণতি বিপুল সমাজশক্তি নির্মাণ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন