‘আমাদের গ্রামেরই বাচ্চা সব, তাদের ছেড়ে চলে যাব!’
Mid day Meal Cook

ভালবাসা ও সংগঠন

জননী শব্দটি কেবল কাজে সত্য নয়, নামেও যথাযথ। ওঁদের সংগঠনের নাম অ্যাসোসিয়েশন অব মিড-ডে মিল অ্যাসিস্ট্যান্টস, সংক্ষেপে ‘আম্মা’।

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২৩ ০৫:৩১
Share:

এক সঙ্গে: বিডিও অফিসে দাবি জানাতে সমবেত হয়েছেন মিড-ডে মিল কর্মীরা। ৮ মে। দেগঙ্গা, উত্তর ২৪ পরগনা। ফাইল চিত্র।

দেড় বছর হয়ে গেল, ওঁরা লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন। লড়াই নিজেদের জন্য, লড়াই শিশুদের জন্যও, সরকারি এবং সরকার পোষিত স্কুলে যে শিশুদের দুপুরবেলার খাবার রাঁধেন ওঁরা। কর্মীর স্বীকৃতি জোটেনি, কারণ কাউকে ‘কর্মী’ বলে মেনে নিলে দেশের আইনে, অন্তত খাতায়-কলমে, তাঁর জন্য নানা দায়িত্ব নিতে হয়। অতএব সরকারি খাতায় ওঁদের নাম সহায়িকা। নামখানি গালভরা, আবার মাসে মাসে কিছু টাকা ধরে দিলেই দায় মিটে যায়। পশ্চিমবঙ্গে সেই টাকার অঙ্ক অনেক রাজ্যের তুলনায় অনেক কম, মাসে দেড় হাজার থেকে খুব বেশি হলে তিন হাজার। তা-ও বছরে দশ মাস— ছুটির দু’মাস মাইনে নেই, সহায়িকা তো! এবং, অনেক ক্ষেত্রেই টাকাটা এক জন পান না, কয়েক জন কাজ করেন বলে ভাগ করে নিতে হয়। এই টাকাতেই রান্নার জোগাড়যন্ত্র, অনেক সময়েই জ্বালানি জোগাড় করা, রান্না করা এবং শিশুদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা, প্রায়শই তাদের খাইয়ে দেওয়া পর্যন্ত, সবই করতে হয় স্কুল-জননীদের।

Advertisement

জননী শব্দটি কেবল কাজে সত্য নয়, নামেও যথাযথ। ওঁদের সংগঠনের নাম অ্যাসোসিয়েশন অব মিড-ডে মিল অ্যাসিস্ট্যান্টস, সংক্ষেপে ‘আম্মা’। ২০২১ সালের শেষ দিকে সংগঠনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল, ২০২২-এর গোড়ায় কাজে নামেন তাঁরা, অনেক সমস্যা এবং বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও সেই কাজ থামেনি, বরং উত্তরোত্তর জোরদার হয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহে রাজ্যের নানা এলাকায় সহায়িকারা সমাবেশ করেছেন, সরকারি আধিকারিকদের কাছে গিয়ে নিজেদের দাবিদাওয়া জানিয়েছেন, তাঁদের বাধ্য করেছেন আলোচনায় বসতে, কিছু কিছু প্রতিশ্রুতিও আদায় করেছেন কর্তাদের কাছ থেকে। সংগঠন গড়তে সহায় হয়েছেন কিছু মানুষ, যাঁরা বিভিন্ন সামাজিক অধিকার আন্দোলনে নিবিড় ভাবে সংযুক্ত এবং কেউ কেউ রাজনৈতিক সংগঠনের তন্নিষ্ঠ কর্মী। তাঁদের চেষ্টাতেইআম্মা-র বিভিন্ন উদ্যোগের নিয়মিত সংবাদ এবং নানা বিবরণ বৃহত্তর সমাজের নজরে এসেছে। নজরে এসেছে প্রায় সম্পূর্ণত সমাজমাধ্যমের পরিসরে। বস্তুত, সমাজমাধ্যম— অসার চর্বিতচর্বণ, বিরামহীন আত্মবিপণন এবং গরলাক্ত বিদ্বেষের মহাপ্লাবন সত্ত্বেও— কেন গুরুত্বপূর্ণ, এই বিবরণগুলি তারবড় প্রমাণ।

কী চাহিদা শ্রমজীবী মেয়েদের? বছরে, দশ মাস নয়, বারো মাস একটা ন্যূনতম ন্যায্য পারিশ্রমিক, মাতৃত্বকালীন ছুটি, সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি, কাজের নিশ্চয়তা, এই ধরনের কয়েকটি দাবি আছে তাঁদের তালিকায়, যা আসলে সামান্যতম নিরাপত্তা এবং সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার কয়েকটি প্রাথমিক শর্ত। কিন্তু এ-সবেরও আগে আম্মার প্রথম চাহিদা: শিশুদের মিড-ডে মিলের বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীকে মিড-ডে মিল দিতে হবে। শিশুদের দাবিকে তাঁরা নিজেদের দাবির আগে স্থান দিয়েছেন, এটা জেনে গোড়ায় অবাক হয়েছিলাম। পরে বুঝেছি, সেই বিস্ময়বোধ নিতান্তই নিজের চার পাশে ঘুরে চলা সমাজবিচ্ছিন্ন মধ্যবিত্ত মনের অভ্যাস থেকে সঞ্জাত। নতুন করে বুঝেছি এই বহুশ্রুত কথাটিকেও যে, জীবনধারার ছাপ চেতনাকে গড়ে। ওঁরা যে কাজ করেন, সেই কাজই ওঁদের মনগুলোকে গড়ে দেয়, যে মনের কাছে স্কুলের শিশুদের স্বার্থ নিজেদের স্বার্থ থেকে আলাদা থাকে না।

Advertisement

এই বোধ আরও একটু পোক্ত হল একটি পঞ্চবর্ষীয় ডিজিটাল সংবাদ-মাধ্যমের সৌজন্যে। তাদের ব্যবস্থাপনায় সম্প্রতি দক্ষিণ কলকাতার এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রেক্ষাগৃহে সমবেত হয়েছিলেন খেতমজুর, আশাকর্মী, মিড-ডে মিল সহায়িকা, অঙ্গনওয়াড়ির কর্মী, এনআরইজিএ শ্রমিকদের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রের শ্রমিক-কর্মীদের কয়েকটি সংগঠনের প্রতিনিধিরা। সভাগৃহে বসে তাঁদের কথা তাঁদের মুখ থেকে শোনার মূল্যবান সুযোগ মিলেছিল সে-দিন। আম্মার প্রতিনিধি হিসাবে কথা বললেন সংগঠনের উত্তর চব্বিশ পরগনার পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য রিনা নায়েক। দৈনন্দিন আলাপের সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তিনি জানালেন নিজেদের অভিজ্ঞতার কাহিনি। বক্তৃতায় অনভ্যস্ত, মাঝে মাঝে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে থমকে যাওয়া তাঁর মৃদু কণ্ঠে এক স্বচ্ছন্দ প্রত্যয়ের সুর। ক্ষমতার দাপট নয়, সেই প্রত্যয়ের মূলে আছে এক দিকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবার জোর, অন্য দিকে শিশুদের প্রতি দায়িত্বশীল ভালবাসা। যে ভালবাসা নিতান্ত স্বাভাবিক স্বরেই বলে, “আমরা এই কম বেতনেই কাজ করি। অনেক সময়ই মনে হয় ছেড়ে দিই, কিন্তু ভেবে দেখি আমাদের গ্রামেরই বাচ্চা সব, তাদের ছেড়ে চলে যাব! কাজ করতে করতে মায়া পড়ে গেছে। বেতন দেয় না বলে ছেড়ে চলে যাই না আমরা।” এই মায়াই অতঃপর প্রশ্ন তোলে, “বাচ্চাদের খাবার দেওয়া হয় আলুর ঝোল আর গলা ভাত। আমরা খাওয়াতে পারি না। কোন বাচ্চা বলুন তো রোজ এই খাবার খাবে? আমরা চাই বাচ্চারা যাতে পুষ্টিকর খাবার পায়।”

শুনতে শুনতে মনে হল, দৈনন্দিন জীবন এবং কাজের মধ্যে দিয়ে এই সংযোগ আছে বলেই ওঁরা শিশুদের প্রয়োজনের সঙ্গে নিজেদের প্রয়োজনকে এমন ভাবে মিলিয়ে নিতে পারছেন। এবং, জোর করে মেলানো নয় বলেই তার জোরটা গলা ফুলিয়ে জানাতে হয় না। সে-দিন যাঁরা নিজের নিজের সংগঠনের তরফে কথা বললেন, তাঁদের অধিকাংশের কথাতেই শুনেছি এই স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর। লড়াইটা যখন বেঁচে থাকার জন্য, তখন আলাদা করে সংগ্রামী বক্তৃতার প্রয়োজন হয় না, জীবনের কথাই সংগ্রামের কথা হয়ে যায়।

লড়াইটা সহজ নয়, সহজ হওয়ার কথাও নয়। সরকারি ক্ষমতা যাঁদের হাতে, তাঁদের চার পাশে রকমারি প্রাচীর এবং পরিখার আয়োজন, রাজা-মহারাজাদের দুর্গ-প্রাসাদের চার পাশে যেমনটি থাকত। রাজারানি দূরস্থান, জেলায় জেলায় ছোট কর্তাদের কানে নিজেদের লিখিত দাবিদাওয়া পৌঁছে দিতে গিয়েও আম্মার প্রতিনিধিদের শুনতে হয়েছে: তোমরা কে? “আমরা তোমাদের কথা শুনব না। আমরা কোনও চিঠি নেব না, বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমরা অন্য উপায় দেখে নেব।” কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের কথা শুনেছেন বা শুনতে বাধ্য হয়েছেন আধিকারিকরা, কোথাও কোথাও তাঁরা নিজেরাও নাকি অবাক হয়ে গিয়েছেন বঞ্চনা আর হয়রানির খুঁটিনাটি তথ্যগুলি জেনে। সেই বিস্ময়ের সবটাই দায় এড়ানোর কৌশল বলে মনে করব না, কারণ সংগ্রামী মানুষগুলোও তা মনে করেননি। তাঁরা কেবল বলেছেন, তাঁরা দেখবেন সরকার কথা রাখে কি না। ইতিমধ্যে, “আমরা আমাদের সর্বশক্তি দিয়েই লড়াই চালিয়ে যাব।” সর্বশক্তি কথাটা রূপকার্থে নয়, নিজেদের সংসার এবং স্কুলের রান্না সামলে বার বার সমবেত হওয়া, অটো কিংবা টোটোয় করে নানা জায়গায় প্রচার করা, ‘কেউ দশ টাকা কেউ কুড়ি টাকা চাঁদা দিয়ে’ আন্দোলন চালানোর অর্থ সংস্থান করা— আক্ষরিক অর্থেই অসাধ্যসাধনের শামিল।

ঘনতমসাবৃত পশ্চিমবঙ্গে ভরসা এইটুকুই যে, অসাধ্য সাধনের এমন নানা নজির তৈরি হচ্ছে আমাদের চার পাশে, নানা ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষ নিজেদের সংগঠিত করছেন, ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে কথা বলছেন। সংগঠনগুলি স্বতন্ত্র, তারা যে যার নিজের লড়াই লড়ছে। সেটা স্বাভাবিক, প্রয়োজনীয়ও বটে। উপরতলায় বসে থাকা অতিকায় এবং সর্বশক্তিমান সদর দফতরের নেতারা যখন যেমনটি বলে দেবেন তখন তেমন ভাবে মিছিল সমাবেশ স্লোগান উৎপন্ন হবে— এই ছক কেবল অচল নয়, আত্মঘাতী বলে প্রমাণিত। কিন্তু একই সঙ্গে প্রয়োজন এই বিভিন্ন সংগঠন এবং আন্দোলনের মধ্যে যোগসূত্র রচনার, একটির শক্তি থেকে অন্যের শক্তি সংগ্রহের, একের আন্দোলনের পাশে অন্যের দাঁড়ানোর। বামপন্থী রাজনীতির ধ্বজা যাঁদের হাতে, তাঁরা এই যোগসূত্র রচনার কাজটি করতে পারতেন, বস্তুত এ-কাজ তাঁদেরই করার কথা ছিল। কিন্তু তাঁদের চিন্তাভাবনা এবং কর্মকাণ্ড আজও— সাড়ে তিন দশকের রাজ্যপাট চলে যাওয়ার এক যুগ পরেও— সর্বশক্তিমান পার্টির ছকটিতেই বাঁধা। সব আন্দোলনকে গ্রাস করে ‘আমাদের আন্দোলন’ বানিয়ে নেওয়ার সেই ছক যোগসূত্রের মর্ম বোঝেই না। এই ছক ভেঙে এবং সামাজিক আন্দোলনকে তার পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে নতুন বামপন্থী রাজনীতি নির্মাণের কাজটি কী ভাবে হবে, সে অতি কঠিন প্রশ্ন। তবে আম্মা-র মতো উদ্যোগগুলিকে বাদ দিয়ে যে তা হবে না, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন