সুনালী খাতুন বড় পুণ্য করে জন্মেছিলেন। গরিব ঘরের মেয়ে, সামান্য রুজির খোঁজে ভিটে ছেড়ে দিল্লি পাড়ি দিলেন। তা রাজধানী বলে কথা, কত লাভ হল গিয়ে—উড়োজাহাজে বিদেশ ভ্রমণ, সংবাদের শিরোনামে অধিষ্ঠান, জজ-ম্যাজিস্ট্রেটের বিবেচনায় স্থানলাভ। দণ্ডটা কিছু বেশি ধার্য হয়েছিল এই যা, জবরদস্তি নাগরিকত্ব বিসর্জন। ক্ষমতাবানদের হিসেব কিন্তু কেঁচে গেল। সোনালি পুত্র-সহ দেশে ফিরলেন, স্বামী আর সঙ্গীদের যদিও পণ রেখে। সাধারণ বুদ্ধি তথা উচ্চ ন্যায়াধীশদের পর্যবেক্ষণে মনে হয় নাগরিকত্বেও তাঁর নিশ্চিত অধিকার। তবু স্বদেশের রাজধানীতে ফেরার প্রস্তাবে তিনি আতঙ্কিত।
কিছু দামি জিনিস পাওয়া দুঃসাধ্য, হারানো— মুহূর্তের লীলা। ভারতের নাগরিকত্ব সেই শ্রেণির সম্পদ। দেশের অসংখ্য মানুষ নিজেদের নাগরিক প্রমাণ করতে নাজেহাল, বংশপরম্পরায় ভারতে বাস করেও এক টুকরো কাগজের অভাবে। প্রমাণ করতে পারলে আজীবন নিশ্চিন্ত দেশবাস, সেই ভরসাতেই এত কষ্টভোগ। না পারলে অশেষ দুর্ভোগ, সেই ভয়ও আছে। অথচ দেখা যাচ্ছে, সাত রাজার ধন এই নাগরিকত্ব পেয়াদার অত্যাচারে বা রাজনৈতিক অভিসন্ধিতে নিমেষে ভ্যানিশ হতে পারে।
উত্তরে বলা হবে: উপায় কী, ভিনদেশির দল নকল নাগরিক সেজে দেশ ছেয়ে ফেলল, তাদের উৎখাত করতে জোরজবরদস্তি ছাড়া গতি নেই। এটা সব অর্থেই প্রবল যুক্তি, যদিও কোনও সভ্য দেশে বলপ্রয়োগটাও আইন, মানবিকতা ও মানবাধিকারের গণ্ডি মেনে চলে। কিন্তু সেই অভিযানে যদি দেশের খাঁটি নাগরিকেরাও বিপর্যস্ত হন, আর সেই অনাচার নজরে এলেও চলতে থাকে, বলতেই হয় নাগরিক স্বার্থ রক্ষিত করার নামে বিপন্ন হচ্ছে।
রাজ্য এখন এসআইআর জোয়ারে ভাসছে। আমি বাস করি শহরের এক উচ্চমধ্যবিত্ত অঞ্চলে। সেখানকার গৃহস্থদের নাগরিকত্ব প্রশ্নাতীত; হাতেগোনা ব্যতিক্রমের সম্ভাবনাও ক্ষীণ। প্রবীণদের অধিকাংশের ২০০২-এর তালিকায় নাম আছে। তবু তাঁরা প্রচুর সময় ও শ্রম ব্যয় করছেন নিজেদের এবং আপনজনের তালিকাভুক্তির তাগিদে।
এঁরা উচ্চশিক্ষিত। তাও ফর্ম পূরণে আতান্তরে পড়ছেন, কারণ তার বিন্যাস ও বয়ান নানা জায়গায় অস্পষ্ট, বিভ্রান্তিকর বা নীরব। যেমন, ২০০২-এর তালিকায় যদি বানান বা তথ্যে ভুল থাকে, বর্তমান ফর্মে সেই ভুল হুবহু বজায় রাখতে হবে। ফর্মে কোথাও এমন নির্দেশ নেই। সব নির্দেশ বিএলও-রা সবাইকে মুখে-মুখে বোঝালে বিভ্রাট অনিবার্য, কারণ রাজ্যে ৮০ হাজারের বেশি ও দেশ জুড়ে বহু লক্ষ বিএলও সকলে সব কিছু একভাবে বুঝবেন ও বোঝাবেন এমন আশা চূড়ান্ত অবাস্তব। নির্বাচন কমিশন জনসাধারণের থেকে শাসকসুলভ দূরত্ব ও মৌন বজায় রেখেছে। লোকে বাধ্য হয়ে শরণ নিচ্ছেন সংবাদমাধ্যম, আন্তর্জালের হরেক সাইট, ও সর্বোপরি রাজনৈতিক দলভুক্ত সহায়কদের। এ সব পরামর্শের অবশ্যই আনুষ্ঠানিক মান্যতা নেই। শহরেও তাই বাসিন্দারা এসআইআরের দৌলতে অল্পবিস্তর ধন্দে ভুগছেন। দুর্বল ও শিক্ষাবঞ্চিত শ্রেণির মধ্যে বিভ্রান্তি আর উদ্বেগ কী মাত্রায় পৌঁছেছে তা কেবল অনুমেয় নয়, বহুচর্চিত ও প্রকট। যে প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য সাধারণ নাগরিককে বল জোগানো, তার এই উল্টো পরিণতি কিন্তু সবচেয়ে বেশি চিন্তার কারণ।
একমাত্র দেশের নাগরিকরাই ভোট দিতে পারেন; কিন্তু ভোটার তালিকা আর নাগরিকপঞ্জি এক বস্তু নয়। এই হেঁয়ালির নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা অলভ্য, এ দিকে এসআইআরের সমর্থক ও বিরোধী সব রাজনৈতিক দলই এই ধারণা উস্কে দিচ্ছে যে দু’টির নিবিড় যোগ। ধারণাটা ঠিক হোক না হোক, জনমানসে গেঁথে গেছে।
এখানেই সুনালী খাতুনের প্রাসঙ্গিকতা। দেশের সরকার ও শাসক দল ভারত জুড়ে বিদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় আর তেড়েফুঁড়ে প্রচার চালাচ্ছে। এতে সবচেয়ে বিপন্ন দেশজোড়া বঙ্গভাষী, বিশেষত গরিব বঙ্গভাষী মুসলমান এবং সব গোষ্ঠীর পরিযায়ী বাঙালি শ্রমিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি এঁদের কাছে অস্তিত্বের চাহিদা। নাম উঠলেই যে নিরাপদ তা নয়, কিন্তু না উঠলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা। ভয়টা চাগিয়ে রাখছে কেন্দ্রীয় শাসক দলের সদস্যদের অনর্গল আলটপকা মন্তব্য, কার্যত শাসানি, এবং রাজ্যে রাজ্যে ডিটেনশন সেন্টার নির্মাণের হিড়িক।
এ-দিকে আইনি তথা শ্রেণিগত অবস্থানের কারণে যাঁদের নাগরিকত্ব খোয়াবার বাস্তব সম্ভাবনা নেই, তাঁরাও অবচেতন ভাবে এই গণ-উদ্বেগে তাড়িত হচ্ছেন। একটা হাওয়া উঠেছে যে, এ বার ভোটার তালিকায় নাম বাদ গেলে ভীষণ কিছু ঘটতে পারে। ‘আসল নাগরিকদের ভয় নেই’, এই আশ্বাসবাণী মানুষকে আশ্বস্ত করছে না। নির্বাচন প্রক্রিয়া ঘিরে সমগ্র নাগরিক মণ্ডলে এমন উদ্বেগ ও অনিশ্চয়বোধ স্বাধীন ভারতে কখনও দেখা যায়নি। এই ভরসার অভাব গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ লক্ষণ নয়।
ভীতি ও অনাস্থার খোরাক জোগাচ্ছে এসআইআরের প্রক্রিয়া। ২০০২ থেকে যাঁদের নাম তালিকায় আছে, তাঁদেরও ফর্ম জমা দিতে হচ্ছে, যার ভাষা ‘নির্বাচক তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন’ বা ‘অ্যাপ্লাই’ করা: ‘ঘোষণা’ বা ‘প্রত্যয়ন’, ‘ডিক্লেয়ার’ বা ‘কনফার্ম’ নয়, আবেদন করা। ‘আবেদন’ শব্দের দু’টি ইঙ্গিত। এক, আমি সেই জিনিসের জন্যই আবেদন করি যা বর্তমানে আমার নেই। দুই, আবেদনমাত্রেই অগ্রাহ্য হতে পারে। ২০০২-এ তালিকাভুক্ত ভোটারদের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নগুলি ওঠার কথা নয়। বলতেই পারেন ভাষার খুঁটিনাটি নিয়ে এত কচকচি করা অন্যায়। কিন্তু আদৌ যে ফর্ম জমা দিতে হচ্ছে, তাতেই পুরো ব্যাপারটায় একটা অনিশ্চয়তা এসে যাচ্ছে, যা এ-যাবৎ এই প্রবীণ নাগরিকদের হিসেবে ছিল না, থাকার কারণ নেই। যদি কেউ ফর্ম জমা না দিতে পারেন বা পূরণে কোনও অসঙ্গতির জন্য বাতিল হয়, তিনি কি ভোটাধিকার হারাবেন? না কি অধিকার ফিরে পেতে ফের নতুন ফর্মে ‘আবেদন’ করতে হবে? যাঁরা নতুন ভোটার বা কোনও কারণে ২০০২-এ বাদ পড়েছেন, তাঁদের নিশ্চয় ফর্ম পূরণ করা আবশ্যক; তবে পদ্ধতিটা অনাবশ্যক জটিল বা অস্পষ্ট কি না তা বিচার্য, কারণ তাঁদের উৎকণ্ঠা স্বভাবতই আরও বেশি।
এমন অবস্থায় ‘অধিকার’ শব্দের তাৎপর্য ফিকে হয়ে আসে। কিছু দিন যাবৎ আমাদের জনজীবনে একটা চিন্তাকর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যে সুযোগ বা প্রত্যাশাগুলি নাগরিক অস্তিত্বের স্থায়ী ও মৌলিক শর্ত, ভারতে জন্ম নিলে সেখানকার মাটি-জল-হাওয়ার মতো আজীবন সহজপ্রাপ্য হওয়া উচিত, সেগুলি কার্যত হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাষ্ট্রের শর্তসাপেক্ষ দান। স্বাভাবিক ও অবিতর্কিত ভাবে সেগুলি দাবি করা চলবে না, রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। আধার প্যান এনওসি কেওয়াইসি থেকে শুরু করে তুচ্ছ প্রয়োজনেও আবেদন আর প্রত্যয়ন— জনজীবনের সর্ব স্তরে সর্ব ক্ষেত্রে এই অবস্টাকল রেসে আমরা দৌড়চ্ছি। সরকারের সঙ্গে নাগরিকের প্রধান সম্পর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে সন্দেহের। যে সরকার নাগরিকদের এতই অবিশ্বাস করে, নাগরিকও তার উপর ভরসা রাখতে পারে না।
আবার উঠবে সেই আপত্তি: ঠগ জোচ্চোর জালিয়াতে দেশ ভরে গেছে, কড়া দাওয়াই তো প্রয়োগ করতেই হবে। অপরাধের এই প্রাদুর্ভাব আগেই ঠেকানো যায়নি কেন, সে প্রশ্ন থাক। এখন সেটা দমনের উদ্দেশ্য অবশ্যই সৎ নাগরিকদের স্বার্থরক্ষা করা। তাঁরাও যদি পাইকারি হারে বিভ্রান্ত এমনকি বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন, বলতেই হয় প্রশাসনিক দাওয়াই এক রোগ সারানোর নামে আর এক রোগ কায়েম করছে, প্রথমটিও দূর হওয়ার সম্ভবনা কম। আমলাতন্ত্রের এটা চিরাচরিত ধারা।
নির্বাচন কমিশন রাষ্ট্রের অপরিহার্য অঙ্গ কিন্তু সরকারি বিভাগ নয়। বরং সরকারের বাইরে থেকে নাগরিকের অধিকাররক্ষা তার উদ্দেশ্য, সে জন্যই তা অপরিহার্য। অনেক বাধা অতিক্রম করে কমিশনের দুয়ারেও যদি দেশবাসীকে দাঁড়াতে হয় প্রার্থী বা উপযাচকের মতো, যেন পরীক্ষা পাশের আশায়, গণতন্ত্রের সঙ্গীত বেসুরো বাজে।
রাষ্ট্র দেশবাসীর, দেশবাসীরা রাষ্ট্রের নয়। গণতন্ত্রের ভিত্তি এই বেয়াড়া নীতির পরিসর সঙ্কুচিত হতে হতে নির্বাচনের পঞ্চবার্ষিক উৎসবপালনে পর্যবসিত হয়েছে। সেই জমিটুকুও যদি পায়ের নীচ থেকে সরতে থাকে, নাগরিক পরিচয় হারিয়ে আমরা পুরোপুরি হয়ে পড়ব রাষ্ট্রের প্রজা।
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে