Online Education

অনলাইনের গণ্ডিতে ছাত্ররা

সরকারি হোক বা বেসরকারি— এই যে ‘স্কুল’ নামক প্রতিষ্ঠানটির উপর থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আস্থা উঠে যাওয়া, তা বিপজ্জনক।

Advertisement

সীমান্ত গুহঠাকুরতা

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২২ ০৪:৪৩
Share:

কোভিডের চতুর্থ ঢেউ তার রক্তচক্ষু দেখাতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে আবার অনলাইন পঠনপাঠনে ফিরে যাওয়া উচিত কি না, সে ব্যাপারে অভিভাবকদের মতামত নেওয়ার জন্য শহরের একটি প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি স্কুলে জরুরি ভিত্তিতে অভিভাবক সভা ডাকা হয়েছিল দিনকয়েক আগে। দেখা গেল, অধিকাংশ অভিভাবকই হয় পুরোপুরি অনলাইন ব্যবস্থায়, না-হয় সপ্তাহে অন্তত তিন দিন অনলাইন আর বাকি তিন দিন অফলাইনের ‘হাইব্রিড’ পদ্ধতিতে পড়াশোনায় আগ্রহী। কেউ কারণ দেখাচ্ছেন কোভিডের বাড়বাড়ন্ত; কারও যুক্তি— এখনও শিশুদের টিকাকরণ হয়নি, কাজেই তাদের জন্য ঝুঁকি বেশি। কেউ কেউ বললেন যে, কোভিড বাড়ুক আর না বাড়ুক, বর্ষায় সর্দিকাশি-জ্বরজারি লেগেই আছে, সেগুলোও তো ছোঁয়াচে, তাই অনলাইন ব্যবস্থাই ভাল। শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, তা হলে এই যে দীর্ঘ ছুটির জন্য আমরা সরকারের এত সমালোচনা করলাম, তার জন্য সত্যিই কি সরকার দায়ী? না কি, সরকারি সিদ্ধান্তে আমাদেরই মনের গোপন ইচ্ছা প্রতিফলিত?

Advertisement

ওই অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানের সুস্থতা নিয়ে সত্যিই উদ্বিগ্ন, না কি তাঁদের মনে— জেনে অথবা না জেনেই— অনলাইন বিকল্পটির প্রতি একটা আকর্ষণ বা অনুরাগ তৈরি হয়েছে? ওই অভিভাবকদের মধ্যে অনেকেই হয়তো কোভিড বিধি মেনে চলেন না। নিজেদের অফিস-কাছারি-বাজারহাটও চলছে। শুধু সন্তানের স্কুলের প্রসঙ্গ এলেই তাঁদের এই অনীহা কেন?

হয়তো অভিভাবকরা এই দীর্ঘ দু’বছরের অতিমারি-জনিত বিকল্প অনলাইন ব্যবস্থায় অতিমাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। তাঁরা দেখছেন যে, এই ব্যবস্থায় স্কুলে যাতায়াত, টিফিন ও অন্যান্য ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। সর্বোপরি, আসল পড়াশোনাটা তো আর স্কুলে হয় না, হয় প্রাইভেট কোচিংয়ে। কাজেই স্কুলে যাতায়াতের ‘ঝামেলা’ যতটা কমিয়ে আনা যায়, ততই ভাল। নিজে যে সরকারি স্কুলে পড়াই, সেখানেও দেখেছি, কোভিড-জনিত দীর্ঘ ছুটির পর স্কুল খুলল যখন, তখন ক্লাসের প্রথম সারির তথাকথিত ‘ভাল’ ছাত্রদের (যারা অধিকাংশই তুলনায় সচ্ছল পরিবারের) মধ্যে নিয়মিত উপস্থিতির হার খুবই কম। বোঝা যাচ্ছিল, ওদের অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের জন্য ‘অন্য’ ব্যবস্থা করে নিয়েছেন।

Advertisement

সরকারি হোক বা বেসরকারি— এই যে ‘স্কুল’ নামক প্রতিষ্ঠানটির উপর থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আস্থা উঠে যাওয়া, তা বিপজ্জনক। এমনিতেই এখন ‘নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি’-র যুগ। শিশুরা একাকিত্বে ভোগে। এত দিন তবু তাদের একটু নিঃশ্বাস ফেলার, একটু সামাজিক হয়ে ওঠার জায়গা ছিল তাদের স্কুলগুলি। স্কুলে নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্পোর্টস ইত্যাদির মধ্যে দিয়েও একটি শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশ হয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, যে ভৃত্যতন্ত্রে তাঁর শৈশব কেটেছে, সেই ভৃত্যরা তাঁকে জানলার ধারে বসিয়ে চার ধারে খড়ি দিয়ে গণ্ডি টেনে দিত। নিজেদের অজ্ঞাতে আমরাও কি আমাদের সন্তানদের সেই গণ্ডিবদ্ধ জীবনে অভ্যস্ত করে তুলছি?

উল্টো দিকে, স্কুল নামক প্রতিষ্ঠানটিও অভিভাবকদের এই অনীহার সুফল পুরোদস্তুর আদায় করে নিতে চাইছে। ইদানীং অনেক সংস্থাই ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এ জোর দিচ্ছে। বেসরকারি স্কুলগুলোও যেন সেই পথেই হাঁটতে চাইছে। সরকারি বা সরকার-পোষিত স্কুলগুলোও ব্যতিক্রম নয়। এই স্কুলগুলি থেকে যদি মধ্যবিত্ত পরিবারের ‘ভাল’ ছাত্ররা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তা হলে যারা পড়ে থাকে, তাদের নিয়ে আর না ভাবলেও চলে। তারা সমাজের কণ্ঠহীন অংশ। সেই সমস্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের স্কুল বন্ধ মানে পড়াও বন্ধ। তাতে অবশ্য আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থমগ্ন মধ্যবিত্ত সমাজের কিছু এসে যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কোভিড বাড়ছে— এই অজুহাতে অভিভাবকরা কিন্তু কোনও প্রাইভেট কোচিং সেন্টার বন্ধ করার দাবি তুলবেন না। আরও লক্ষণীয়, দীর্ঘ দু’মাসের সে প্রলম্বিত গ্রীষ্মাবকাশ গেল, তাতে সমস্ত সরকারি স্কুল বন্ধ থাকলেও প্রায় সমস্ত বেসরকারি স্কুলেই কিন্তু অনলাইনে পড়াশোনা চলেছে। এ থেকেই বোঝা যায়, আমাদের সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি আসলে কী চাইছে।

এর মধ্যে মোক্ষম একটি অজুহাত বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সুকৌশলে। তা হল, একটি বাচ্চারও যদি কোভিডে কিছু হয়ে যায়, তার জন্য কে জবাবদিহি করবে? সেই জবাবদিহির দায় থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে শুধু দেশের মধ্যেই নয়, সম্ভবত সারা বিশ্বে সব থেকে বেশি দিন বন্ধ ছিল আমাদের রাজ্যের স্কুলগুলি। কোভিড আবার বাড়ছে। আবার হয়তো একই অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা ফিরে যাবে অনলাইন ব্যবস্থায়। বাকিরা আবার অনির্দিষ্ট কালের জন্য শিকেয় তুলে রাখবে তাদের পড়াশোনা। প্রশ্ন হল, এই ভাবে লক্ষ লক্ষ শিশুর শৈশবকে খুন করার দায় কে নেবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন