বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠার খোয়াব তো বটেই, ইউক্রেনের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ রাশিয়ার কাছে আর্থিক ভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। তাই সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় ভ্লাদিমির পুতিন
Vladimir Putin

নামভূমিকায়: মার্চ ২০২২

দেশের ভিতরে প্রশ্নহীন নেতৃত্ব স্থাপনের পর পুরনো রুশ-সোভিয়েট প্রভাববৃত্তে হাত বাড়ান একচ্ছত্র প্রেসিডেন্ট।

Advertisement

আবাহন দত্ত

শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২২ ০৬:১৭
Share:

ইউক্রেন আক্রমণের তিন দিন আগে দক্ষিণ-পশ্চিমের এই প্রতিবেশীকে ‘মেকি দেশ’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁর মতে, ইউক্রেনের না আছে ইতিহাস, না আছে পরিচিতি, অথবা ‘সত্যিকারের রাষ্ট্র হওয়ার সুদীর্ঘ ঐতিহ্য’। তাঁর দৃপ্ত ঘোষণা, আধুনিক ইউক্রেনকে “সম্পূর্ণত গড়ে তুলেছে রাশিয়া, আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে বলেশেভিক, কমিউনিস্ট রাশিয়া।... ১৯১৭-র বিপ্লবের ঠিক পরেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। লেনিন ও তাঁর সহযোগীরা রাশিয়ার নিরিখে সাঙ্ঘাতিক হঠকারী ভাবে এ কাজ করেন— তার ঐতিহাসিক এলাকা থেকে তাকে ভাগ করে দেন, টুকরো করে দেন।” সহজ কথায়, ইউক্রেন সুবিপুল রুশ সভ্যতারই অংশ। আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায়— যেখানে লেনিন সোভিয়েটের প্রতিটি জাতিসত্তাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন— তা তৈরি হয়ে উঠেছিল। আবার, যখন ইউক্রেনের মাটিতে রাশিয়ার ট্যাঙ্কের চাকা গড়াল, তখন তার মাথায় সোভিয়েট পতাকা দৃশ্যমান হল। কোনও এক শহরে রুশ পুতুল প্রশাসক ক্ষমতায় বসেই হাতে তুললেন রক্তপতাকা।

Advertisement

পুতিনের মুখে কখনও লেনিন-নিন্দা, কখনও সোভিয়েট-বন্দনা কেন? আসলে, সোভিয়েট রাষ্ট্রের মূল চরিত্র ছিল দুটো: সমাজতন্ত্র এবং বিশ্বশক্তি। সমাজতন্ত্রের প্রয়োজন ফুরিয়েছে ১৯৯০-এর দশকেই, যুগোপযোগী পুতিন যথাসময়ে তা ছেঁটেও ফেলেছেন। অগস্ট অভ্যুত্থানে যখন কমিউনিস্ট পার্টির কট্টরপন্থীরা শেষ বারের মতো ক্ষমতা দখলের মরিয়া চেষ্টা করলেন, পুতিন তখন লিখলেন পদত্যাগপত্র— “অভ্যুত্থান শুরু হতে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত করে নিলাম, আমি কোন পক্ষে।” বললেন, কেজিবি-র লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদটি ছাড়ার এই সিদ্ধান্ত তাঁর পক্ষে অত্যন্ত কঠিন, কেননা জীবনের সেরা সময় তিনি কাটিয়েছেন পার্টির শাখাতেই। অতঃপর পার্টিবিরোধী রাজনীতিক তথা লেনিনগ্রাদের মেয়র আনাতোলি সবচাক-এর ছত্রছায়ায় রাজনীতিতে প্রবেশ, এবং প্রশাসনিক সিঁড়িতে আরোহণ। আবার সবচাকের দিন ফুরোতেই শহর পাল্টে পুতিনের মস্কো গমন, এবং সরাসরি প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে প্রবেশ। গুপ্তচরবৃত্তি ছাড়ার সাত বছরের মধ্যেই, ১৯৯৮ সালে কেজিবি-র উত্তরসূরি এফএসবি-র অধিকর্তা পদে অধিষ্ঠান। অতএব, ইয়েলৎসিনের উত্তরাধিকারের দাবিদারও হয়ে ওঠা। ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট পদ। তার পরেই সোভিয়েটের অন্য দিকটিকে সযত্নে লালন-পালনের সূত্রপাত। লক্ষ্য, আবারও বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠা।

সোভিয়েট ভাঙনে এক উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছিল, রুশ রাষ্ট্রব্যবস্থা সর্বতো ভাবে পশ্চিমমুখী হয়েছিল। দেশের ভিতরে বহুদলীয় গণতন্ত্রের মডেল স্থাপিত হয়, বিদেশনীতি স্থির হয় উদারবাদের নিরিখে। যে প্রতিবেশীরা এত দিন মস্কো থেকে চালিত হত, তাদের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হয়েছিল। যে যে অভিজ্ঞানে সোভিয়েট-সভ্যতার স্মরণ হয়, সবই দুর্বার গতিতে মুছে গিয়েছিল। পুতিন ক্ষমতায় এসেই এই চাকাটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেন— সোভিয়েট নস্টালজিয়া ফিরিয়ে আনেন। তাঁর যুক্তি: “ইতিহাসের সমস্যাকর অধ্যায়ের কথা ধরলে, হ্যাঁ, তা আমাদের আছে। কিন্তু কোন রাষ্ট্রেরই বা নেই? এবং, অন্যদের চেয়ে তেমন অধ্যায় আমাদের কমই।... আমরা নিজেদের অপরাধবোধে ডুবে যেতে দিতে পারি না।”

Advertisement

গণতান্ত্রিক রাশিয়ায় পশ্চিমের মতোই পর পর দু’বারের বেশি প্রেসিডেন্ট হওয়া যেত না। ২০০৮-এ তাই পুতিন পদ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী হন, প্রেসিডেন্ট হন ঘনিষ্ঠ দমিত্রি মেদভেদেভ। সংবিধান মোতাবেক ২০১২-য় প্রেসিডেন্ট পদে ফেরেন পুতিন। আর, তার পরেই খেলা শুরু। একে একে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উপর তাঁর রাজনৈতিক একাধিপত্য কায়েম হয়, সংবিধান সংশোধিত হয়ে যায়, সমস্ত নির্বাচনেই অবাধে জালিয়াতি হতে থাকে, প্রেসিডেন্ট পদের সময়সীমা তুলে দিয়ে আপাতত ২০৩৬ পর্যন্ত নিরঙ্কুশ পুতিন।

দেশের ভিতরে প্রশ্নহীন নেতৃত্ব স্থাপনের পর পুরনো রুশ-সোভিয়েট প্রভাববৃত্তে হাত বাড়ান একচ্ছত্র প্রেসিডেন্ট। গণতন্ত্রীকরণের তোড়ে যা খোয়া গিয়েছিল, বাহুবলের জোরে তা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হয়। প্রথম উদ্যোগ ক্রাইমিয়ার সংযুক্তিকরণ। তা সফল, কিন্তু সেখান থেকেই ইউক্রেনের সঙ্গে দীর্ঘ সংঘাতের সূচনা। ইউক্রেনবাসী যত নিজেদের স্বাধীন জাতিসত্তার দাবি করে গিয়েছেন, যত বেশি করে রুশ আধিপত্যকে অস্বীকার করেছেন, এমনকি পশ্চিমবন্ধুতাও প্রকাশ করেছেন, তত সেই জাতিরাষ্ট্রের অনস্তিত্ব দাবি করেছেন পুতিন। গত হাজার বছরের ইতিহাসে সপ্তদশ শতকে সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন দ্য গ্রেট আর বিংশ শতকে জোসেফ স্তালিন দীর্ঘ সময়ের জন্য ইউক্রেন দখল করেছেন। প্রত্যেক স্বাধীনতাকামী ভাঙনেই— জ়ারতন্ত্রের অবলুপ্তি বা সোভিয়েট পতন— আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার চেয়েছে ইউক্রেন। এ আসলে আধুনিক বিশ্বের ক্ষুদ্র জাতিরাষ্ট্র বনাম প্রাচীন বিশ্বের সভ্যতা-রাষ্ট্রের ধারণার টানাপড়েন। তদুপরি, খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ও জনবহুল ইউক্রেন অর্থনীতির দিক থেকে রাশিয়ার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্রেস্ত-লিতভস্ক চুক্তিতে ইউক্রেন খোয়ানোর ফলে বিপুল পরিমাণে চাষজমি, কলকারখানা ও কয়লাখনি হারিয়েছিল রাশিয়া। সোভিয়েট আমলে এই প্রজাতন্ত্র ছিল বলেই দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে ওঠা। পুতিনেরও, অতএব, ইউক্রেন বিনা গতি নেই।

দেশের ভিতরে পুতিন-বিরোধিতা করলে কী ফল হয়, আলেক্সেই নাভালনির পরিণতিতে তা হাড়ে-হাড়ে জেনে গিয়েছেন রুশবাসী। ইদানীং শত শত যুদ্ধবিরোধীকে ফি-দিন জেলে পোরা হচ্ছে। ক্ষমতার হিসাব সামলে তাই বহির্বিশ্বেও নজর। গৌরবের যে কোনও শেষ হয় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন