নরেন্দ্র মোদী ফের জিতলেও এই নৈরাজ্যই চলবে

কথা বেশি, কাজ কম

যখন কোনও নাগরিক দেখেন সবাই আইন ভাঙছেন, তখন তিনিও সেই নিয়ম-ভাঙার দলে ভিড়ে যান।

Advertisement

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

সমাজ ও দেশ বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ নিয়ম-নির্ভর হয়ে ওঠে। গণতান্ত্রিক সমাজ বোঝাপড়া তথা ঐকমত্যের পথেই নিয়ম তৈরি করে। অনেক সময়েই বহু তর্কবিতর্কের পর নিয়ম নির্ধারিত হয়, কিন্তু এক বার তা জারি হয়ে যাওয়ার পর সমাজকে সেই নিয়ম প্রয়োগের চেষ্টা করতেই হয়, তা না হলে সে নিরন্তর অন্তর্দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ হতে থাকবে।

Advertisement

অথচ ভারতে আমরা যেন নিয়ম-নির্ভর ব্যবস্থা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের ক্ষমতা ধরে রাখতে এতটাই ব্যগ্র যে তাঁরা ভোটের রাজনীতির পায়ে সমস্ত শৃঙ্খলা জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত। যেমন, এ দেশে ট্রাফিক নিয়ম রোজ রোজ অমান্য হয়েই চলেছে, কোনও শাস্তির ব্যাপারই নেই। রাস্তার ভুল দিক দিয়ে গাড়ি চালানো, লালবাতি অমান্য করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া এবং যত্রতত্র পার্কিং এখন কার্যত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধরনের বেআইনি আচরণ শহরগুলিতে, সমস্ত আর্থ-সামাজিক স্তরেই, মানুষের মজ্জাগত হয়ে গিয়েছে।

যখন কোনও নাগরিক দেখেন সবাই আইন ভাঙছেন, তখন তিনিও সেই নিয়ম-ভাঙার দলে ভিড়ে যান। এবং এই নিয়ম ভাঙার রীতি এক ধরনের নাগরিক তৈরি করেন যাঁরা বিদ্যুতের বিল দেন না, কর দেন না, ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে সময়মতো শোধ করেন না, ট্রাফিক নিয়ম ভাঙেন, আইনশৃঙ্খলাকে চ্যালেঞ্জ করেন, স্বাভাবিক সৌজন্যবোধের ধার ধারেন না, এবং নানা রকম অপকর্ম করে ও ঘুষ দিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করেন।

Advertisement

ভারতে অপরাধের হার যে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, সেটা তাই বিস্ময়ের কোনও ব্যাপার নয়। ইদানীং ভারতে জনসংখ্যার অনুপাতে খুনের পরিসংখ্যান মেক্সিকো বা ব্রাজ়িলের মতো হিংসাদীর্ণ দেশগুলির সঙ্গে তুলনীয়। এবং চিনের তুলনায় অনেক বেশি— ২০০৯ সালের হিসেব অনুযায়ী ভারতে খুনের সংখ্যা ৪০৫৭২, চিনে ১৩৪১০।

গত বছর ব্রিটেনের একটি পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ‘‘কিছু আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞের মতে ভারত মহিলাদের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ, কারণ এখানে যৌন হেনস্থা এবং জোর করে ক্রীতদাস বানানোর আশঙ্কা প্রবল।’’

একটা শৃঙ্খলাহীন সমাজে সম্পদ ও অন্যান্য বিষয়ে বিপুল বৈষম্য তৈরি হয়। যাঁদের হাতে ক্ষমতা, তাঁরা নিয়ম ভেঙে বিপুল সম্পদ আত্মসাৎ করতে পারেন। যেমন অগণিত প্রতিপত্তিশালী প্রোমোটার-বিল্ডার ক্রেতাদের ঠকিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। এই বৈষম্য এখন খুব প্রকটও বটে। যাঁরা যথেষ্ট উপার্জন করেন, তাঁরা আজকাল, রেস্তরাঁয় এক বার খাবার জন্য যে পরিমাণ টাকা খরচ করেন, সেই টাকা তাঁরা কাজের লোক বা ড্রাইভারকে এক মাসের বেতন হিসেবে দেন না। বিকট ধনী ব্যক্তিরা তাঁদের বাড়ির বিয়েতে যত টাকা ওড়ান, সেই টাকায় একটা বড় হাসপাতাল বা একটা স্কুল বানিয়ে ফেলা যায়।

আসলে, খুব অল্পসংখ্যক মানুষ যখন অভাবনীয় সম্পদ বানিয়ে ফেলতে পারেন (যার এক বিরাট অংশ ঘুষ দিতে, রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কিনে ফেলতে এবং দেখনদারির জন্য বিপুল খরচ করতে ব্যয় হয়), আর দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ অসম্ভব দারিদ্রে দিন কাটান, তখন উচ্চ হারে আয়বৃদ্ধির কোনও মানেই হয় না।

ভারত পৃথিবীর সেই কয়েকটা দেশের মধ্যে পড়ে, যেখানে আয়ের অসাম্য দ্রুত বাড়ছে। প্যারিস স্কুল অব ইকনমিক্স-এর একটি সমীক্ষা বলছে, ভারত, চিন, রাশিয়া এবং আমেরিকায় গত কিছু বছরে আয়ের অসাম্য সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এদের মধ্যে ভারত হল একমাত্র দেশ, যেখানে হতদরিদ্রের সংখ্যা বিপুল, সেই পরিসংখ্যান দেখলে মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে যায়। এখন এ দেশে দারিদ্রের হার ৬০.৪০ শতাংশ, যা চিন (১২.১) ও রাশিয়ার (০.৩) চেয়ে ঢের বেশি, এমনকি বাংলাদেশের দারিদ্রের হারও (৫৯.২) তার নীচে।

জনকল্যাণ খাতে ব্যয়, মাঝে মাঝে নানা অনুদান আর গরিবের জন্য কিছু প্রকল্প— এই দিয়ে কখনওই মৌলিক অসাম্যের কাঠামো বদলানো যায় না। যত ক্ষণ ধনী ও ক্ষমতাশালীদের তুলনায় ক্ষুদ্র গোষ্ঠী তাদের ইচ্ছেমতো আইনকে বাঁকিয়েচুরিয়ে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবে এবং অর্থনৈতিক সম্পদের উপর তাদের দখল জারি রাখবে, তত ক্ষণ এই ভয়ঙ্কর অসাম্যও কায়েম থাকবে।

২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতের যে নির্বাচকরা নরেন্দ্র মোদীকে দরাজ হাতে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই বিজেপির ঘোর সমর্থক, এমনটা ভাবার কারণ নেই। আসলে সেই সময়কার কংগ্রেস-চালিত সরকারের নিরাবরণ দুর্নীতি, দম্ভ এবং সামগ্রিক ভাবে আইনশৃঙ্খলার দুরবস্থা দেখে জনসাধারণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। সাধারণ মানুষ প্রবল দুর্নীতি ও প্রশাসনিক দুর্বলতার তাড়নায় এবং এমনকি আদালত থেকে ন্যায়বিচার পাওয়ার আশাটুকুও হারিয়ে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন। তাঁরা নরেন্দ্র মোদীকে এই আশায় ভোট দিয়েছিলেন যে তিনি ক্ষমতায় এলে দেশে আইনশৃঙ্খলা ফিরে আসবে, দুর্নীতির প্রকোপ কমবে এবং যাঁরা সৎ ভাবে পরিশ্রম করেন ও নিয়ম মেনে চলেন, সুশাসনের ফলে তাঁরা লাভবান হবেন।

নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বারাণসী কেন্দ্রে জয়ী হওয়ার পর সেখানে রাতারাতি রাস্তা পরিষ্কার আর মেরামত হয়ে গেল, যাঁরা বিদ্যুতের বিল মেটাননি, বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীরা তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করতে শুরু করলেন। দেখেশুনে সবাই ভাবল, অন্যান্য ব্যাপারেও দিনকাল বদলাবে। কিন্তু অচিরে দেখা গেল, সব তৎপরতাই সীমিত এবং ক্ষণস্থায়ী— বছর ঘুরতে না ঘুরতে বারাণসী এবং তার উদাসীন প্রশাসন সেই পুরনো অবস্থায় ফিরে গিয়েছে।

জাতীয় স্তরে দেখা গেল, নেতারা দুর্নীতির উপর নজরদারির জন্য লোকপাল নিয়োগে নারাজ। বিদেশে রেখে দেওয়া বিপুল পরিমাণ কালো টাকা উদ্ধারের প্রতিশ্রুতিও তাঁরা রাখলেন না। নোট বাতিলের সিদ্ধান্তও অসৎ লোকদের হাতে পুঞ্জীভূত কালো টাকার বিশাল সম্ভার দিবালোকে আনতে ব্যর্থ হল।

দুর্নীতির ক্ষেত্রে, নীরব মোদী আর বিজয় মাল্য, ব্যাঙ্কগুলিকে ফাঁকি দেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত এই দু’জনকেই কেবল সরকার দেশে ফেরানোর চেষ্টা করেছে। আরও যে অসংখ্য অপরাধী— যেমন ধরা যাক যে বিল্ডার-প্রোমোটাররা বাড়ি তৈরি করে দেবে বলে গ্রাহকের টাকা মেরেছে— তাদের ছোঁয়াও হয়নি। বাড়ির ক্রেতারা যদি তাঁদের কিছু টাকা ফেরত পেয়ে থাকেন, সেটা আদালতের কল্যাণে।

বেশির ভাগ শহরে তথা রাজ্যে পুরনো দুর্নীতির রমরমা চলছেই। অন্য দিকে, সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান আগের মতোই সীমিত। সম্পদ আজও উপর থেকে নীচে পৌঁছচ্ছে না, সুটকেসে জমছে, জমি বা অনুৎপাদক জিনিসপত্র কেনায় বিনিয়োগ করা হচ্ছে অথবা দেশের বাইরে পাচার হচ্ছে, আগেও যেমনটা হত।

অধিকাংশ ভারতীয়ের পক্ষে এটা এক রকম অরওয়েলীয় দুঃস্বপ্ন: পরিস্থিতি যত বদলায়, ততই তা আগের মতো থেকে যায়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ও জাতিবর্ণ-গোষ্ঠীর মধ্যে, উদারপন্থী এবং কট্টরপন্থীদের মধ্যে, শহর এবং গ্রামের মধ্যে— সমস্ত বিষয়ে সব স্তরে ঐকমত্য বা বোঝাপড়া একেবারে ভেঙে পড়ছে।

সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হল— প্রশাসন, বিচারবিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে চূড়ান্ত বিরোধ জনসমক্ষে চলে আসছে। এমনকি দুর্নীতি, অর্থনৈতিক দুরাচার এবং প্রশাসনিক অপরাধ নিবারণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেন্ট্রাল বুরো অব ইনভেস্টিগেশনও এই বিরোধের শিকার।

নরেন্দ্র মোদীকে তাই শেষ বিচারে ব্যর্থ বলেই মানতে হবে। তাঁর ব্যক্তিগত সততা নেই তা নয়, কিন্তু গোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার সামর্থ্য তিনি দেখাতে পারেননি। যে পণ্ডিত নেহরুর প্রতি মোদীর এত বিরাগ, তিনি কিন্তু স্বাধীনতার পরে ভারতের খোলনলচে বদলে দিয়েছিলেন, একটি ঔপনিবেশিক কাঠামোকে গণতান্ত্রিক রূপ দিতে পেরেছিলেন তিনি। অন্য দিকে, মোদী বলেছিলেন অনেক কিছু, কিন্তু করেছেন খুব অল্প। এ বছরের নির্বাচনেও মোদী জিততে পারেন, কিন্তু তাঁর এই ক’বছরের কাজের খতিয়ান বলছে, ভারতে বিশৃঙ্খলার পরিবেশ শুধরোবে, তাঁর কাছে এমন আশা না করাই ভাল।

মোদীর রাজত্বে দেশে যে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নৈরাজ্য চলছে তাতে সমৃদ্ধিও আসবে না, ভারতও মহান দেশ হয়ে উঠতে পারবে না। জাতীয় ঐক্য ও সংহতির জন্যও প্রয়োজন সুশৃঙ্খল প্রশাসনের। নৈরাজ্য জারি থাকলে আমরা একটা দরিদ্র, বিশৃঙ্খল দেশ হয়েই থাকব, যেখানে অর্থনৈতিক অপরাধী আর রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের প্রবল প্রতাপ। সে দেশ কোনও ‘রামরাজ্য’-এর দিকে যাবে না, আমরা ধাবিত হব প্রলয়ের পথে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন