প্রার্থনা: যা কোনও দিনই রাজনীতি বা কূটনীতি, কোনওটাই বদলাতে পারে না। ম্যাঞ্চেস্টার, ২৫ মে ২০১৭। এএফপি
সোমবার, ২২ মে, ম্যাঞ্চেস্টার সহ গোটা ব্রিটেন শিহরিত হয়ে উঠেছিল এমন এক জঙ্গি হানায়, যা এ দেশে গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। আর ম্যাঞ্চেস্টারে তো দু’দশক পর এত বড় কোনও হামলা। ১৯৯৬ সালে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি বোমা ফেলেছিল এ শহরের প্রাণকেন্দ্রে। একটি প্রাণও খোয়া যায়নি! কিন্তু এ বারের সন্ত্রাসে ২২ জন প্রাণ হারিয়েছেন— অনেক শিশু, বহু অভিভাবক আর তরুণ। ৫৯ জন আহত। আঘাত অনেকেরই গুরুতর, যা বদলে দেবে তাঁদের জীবনের খাত।
এখনও পর্যন্ত যা জানা গিয়েছে, আক্রমণকারী সন্ত্রাসীর নাম সলমন আবেদি, ম্যাঞ্চেস্টারেরই মানুষ, লিবীয় বংশোদ্ভূত, তার মা-বাবা লিবিয়া থেকে ব্রিটেনে এসেছিলেন। কেন সে এই আক্রমণ করল বা কারা তাকে দিয়ে করাল, সে বিষয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু সে সবই জল্পনা।
ম্যাঞ্চেস্টারের বাসিন্দা হিসেবে দেখেছি, ঘটনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হয় মানবতা ও সহানুভূতির বহু নজির— স্বাস্থ্যকর্মীরা হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন আক্রান্তদের পরিষেবা দেওয়ার জন্য, যাঁরা বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরতে পারেননি তাঁদের মানুষজন নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিচ্ছেন, ট্যাক্সিচালকরা বিনা ভাড়ায় বিপন্নদের পৌঁছে দিচ্ছেন, যে যেখানে যেতে চান। এবং এমন সহযোগিতার হাত যাঁরা বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই মুসলমান।
পরের দিন ম্যাঞ্চেস্টার টাউন হল-এ ২০,০০০ সাধারণ মানুষ প্রার্থনার জন্য জড়ো হন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা অনেকেই। লেবার পার্টির জেরেমি করবিন ছিলেন, লিবারাল ডেমোক্র্যাটদের তরফে এসেছিলেন টিম ফ্যারন। হাউস অব কমন্স-এর স্পিকার জন বারকোও ছিলেন এই সভায়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন না সেখানে। যাঁরা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আসন্ন নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্বের দিকে নজর রাখছেন, তাঁরা অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর এই অনুপস্থিতিতে বিস্মিত হননি। তাঁরা জানেন, ভোটের আগে টেরেসা মে পারতপক্ষে জনসাধারণের মুখোমুখি হচ্ছেন না, লেবার পার্টির নেতার সঙ্গে টেলিভিশনের বিতর্কও এড়িয়ে চলছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের দেশ এবং আমাদের জীবনযাপনের ধারাই সতত জারি থাকবে।’ সন্ত্রাসের যে কোনও ঘটনার পরে পশ্চিমী নায়কদের মুখে ‘আমাদের জীবনযাপনের ধারা’র কথা সচরাচর শোনা যায়।
তবে এ বারের আক্রমণের সময়টা খুব তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ দু’সপ্তাহের মধ্যে খুব জরুরি নির্বাচনটি ঘটতে চলেছে। কয়েক সপ্তাহ আগে শাসক কনজার্ভেটিভ দল যখন নির্বাচন ঘোষণা করে, তখন জনমত সমীক্ষায় তারা অন্য দলগুলির চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল, কিন্তু ব্যবধান কমছে। ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, সরকার একাধিক নীতিতে ডিগবাজি খেয়েছে। এ-ও দেখেছি, টেলিভিশন বিতর্কে কোনও অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হলেই টেরেসা মে চোয়াল শক্ত করে নিজেকে ‘শক্তিমান এবং সুদৃঢ়’ বলে প্রমাণ করতে ব্যগ্র হয়েছেন।
সোমবারের ঘটনার পরে ম্যাঞ্চেস্টারে স্মরণ-সমাবেশে দেখা গিয়েছে এক গভীর ঐক্যের ছবি, যে ছবিতে প্রতিফলিত হয়েছে এ শহরের ইতিহাস, সৃষ্টিশীলতা এবং কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ, দক্ষিণ এশীয়, আরব, খ্রিস্টান, হিন্দু, মুসলিম, শিখ, শ্রমজীবী ও এমন আরও বহু বিচিত্র জনগোষ্ঠীর সহাবস্থানের অভিজ্ঞতা। এর পাশাপাশি সমাবেশের মানুষদের কাছে ইসলাম-আতঙ্ক (ইসলামোফোবিয়া) প্রচার করতেও এসেছিল অতি-দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ট দল ইংলিশ ডিফেন্স লিগ-এর প্রতিনিধিরা, তবে তাঁদের সংখ্যা ছিল সাকুল্যে ছয়। এবং প্রবল বিদ্রুপের সম্মুখীন হয়ে তারা দ্রুত চম্পট দেয়। দৃশ্যত, এই সন্ত্রাসী হানাকে কাজে লাগিয়ে জাতিবিদ্বেষে ইন্ধন দেওয়ার চেষ্টাকে প্রতিহত করতে শহরের মানুষ তৎপর। সংকটের মুহূর্তে হিংসা ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে মানুষ যে ভাবে সমবেত হয়েছেন, তা ভরসা জাগায়।
সরকার ইতিমধ্যেই ব্রিটেনে সন্ত্রাসের সম্ভাবনাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চড়িয়ে দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে তিনি রাজপথে সেনাবাহিনী নামাবেন— সত্তর এবং আশির দশকে আইআরএ-র আক্রমণের দিনগুলিতেও যা দেখা যায়নি। ব্রিটেনে এমন যুদ্ধপ্রস্তুতি আমরা শেষ দেখেছি ২০০৫ সালের জুলাই মাসে, তথাকথিত ৭/৭-এর বোমা বিস্ফোরণের পরে। সমস্ত নির্বাচনী প্রচার সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে, ফলে এই সন্ত্রাসী হানার কারণ এবং সরকারের প্রতিক্রিয়া নিয়ে জনপরিসরে বিতর্কের সুযোগ এখনও মেলেনি।
আইএস দাবি করেছে, ম্যাঞ্চেস্টারের আততায়ী তাদের সৈনিক, কিন্তু কোথাও কোনও মুসলমান সন্ত্রাসী আক্রমণ ঘটালে আইএস প্রায়শই তাকে নিজেদের লোক বলে দাবি করে, সে সত্যিই তাদের লোক হোক বা না হোক। তবে মনে রাখতে হবে, যে দেশগুলির সামরিক অভিযান সন্ত্রাসী সলমন আবেদির আদি দেশ লিবিয়ায় বিপর্যয় ডেকে এনেছে, ব্রিটেন তাদের অন্যতম। এবং পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন ইত্যাদি যে সব দেশে ব্রিটেন সামরিক অভিযানে শরিক হয়েছে বা অভিযানকে সমর্থন করেছে, সেখানে প্রতি দিন যত মানুষ হতাহত হচ্ছেন, তার সংখ্যা ম্যাঞ্চেস্টারের তুলনায় অনেক বেশি। বোঝা যায়, ধারাবাহিক ভাবে এই সব দেশের মানুষের প্রাণের মূল্য দেওয়া হয়নি, এবং এ ব্যাপারে দ্বিচারিতাটাও ফের পরিষ্কার হয়ে যায়— পশ্চিমী নাগরিকের তুলনায় এশিয়া আফ্রিকার মানুষের প্রাণের মূল্য অনেক কম।
এই যে দীর্ঘ দিন ধরে দুনিয়ার নানা জায়গায় যত মানুষ সন্ত্রাসী হানায় হতাহত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি সুবিচার করতে চাইলে আমাদের বিচার করতে হবে এই ঘটনাগুলি কেন ঘটে। এবং সে জন্য অনেক বিষয়ে সৎ হতে হবে: যেমন, মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সামরিক অভিযানে ব্রিটেন শরিক হয়েছে; দুনিয়ার অস্ত্রবিক্রেতা দেশগুলির তালিকায় ব্রিটেনের স্থান দ্বিতীয়, এবং সেই অস্ত্রের ক্রেতাদের মধ্যে সৌদি আরবের মতো দেশও আছে; লিবিয়ার মতো দেশগুলিতে চূড়ান্ত অস্থিরতা চলছে; ব্রিটিশ সরকার এবং এ দেশের কর্পোরেট সংস্থাগুলির সাম্রাজ্যবাদী এবং পুঁজিবাদী আকাঙ্ক্ষা আছে; মানুষ-চালানের দালালদের সাহায্যে যে শরণার্থীরা ইউরোপে আসছেন তাঁদের কোনও নিরাপত্তা নেই এবং ধরা পড়লে তাঁদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর আশঙ্কা প্রবল, যে স্বদেশ আক্ষরিক অর্থেই মৃত্যুপুরী। নিহতদের প্রতি যথার্থ সুবিচার করতে চাইলে এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা বিধান করতে হলে এই প্রশ্নগুলি করতে হবে এবং তার পরে নিজেদের জিজ্ঞাসা করতে হবে: প্রকৃত বিপদের কারণ কে এবং কী।