দাবিদাওয়া: সুশাসনের সঙ্গে সঙ্গে মৌলিক প্রয়োজন পূরণের দাবি যখন প্রশাসনিকতার পরিসরে সমবেত হয়।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রের কল্পনায় ‘নেশন’ আর ‘পিপল-নেশন’— এই দুটো আপনি আলাদা করে দেখতে বলেন। আমাদের জাতি-কল্পনায় বহুত্ববাদী এবং হিন্দুত্ববাদী এই দুই মতের সংঘাত আবার প্রবল হয়ে উঠেছে। আপনি সম্প্রতি বলছেন, এই দুটো মতই নেশনকে একক বা সিঙ্গুলার হিসেবে দেখে, কিন্তু বাস্তবিক দেখা উচিত আপেক্ষিক বা রিলেটিভিস্ট দৃষ্টিতে। জাতীয়তাবাদ বিষয়ে আপনার গবেষণায় একটা নতুন মাত্রা যোগ করছেন।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়: ইংরেজিতে যাকে স্টেট আর নেশন বলি, ইউরোপের ইতিহাসে সেই দুটো জিনিসের মধ্যে পার্থক্য বহু দিন স্বীকৃত। ভারতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা গুলিয়ে যায়। কারণ, আমাদের আধুনিক ভাষাগুলোতে রাষ্ট্র, জাতি, জনগণ, এই সব শব্দের ব্যবহারে এদের নির্দিষ্ট ভিন্ন অর্থ সহজে নজরে আসে না। বাংলায় আমরা স্টেট বলতে রাষ্ট্র বুঝি, আর নেশন বলতে, জাতি। হিন্দিতে নেশনকে রাষ্ট্র বলা হয়, স্টেট বলা হয় রাজ্যকে। হিন্দিতে যাকে রাষ্ট্র বলা হয়, তাতে আবার স্টেট আর পিপল জুড়ে গিয়েছে। ওই ভাবে বললে, বৈদিক ভারতেও রাষ্ট্র, জনগণ ও জাতির অস্তিত্ব কল্পনা করে নেওয়া যায়।
কিন্তু বাস্তবে আধুনিক রাষ্ট্র বলতে যা বোঝায়, যেখানে জনগণ সার্বভৌম, সেটা ভারতের ইতিহাসে খুবই নতুন। ভারতের এক এক প্রদেশে এক এক ভাষায় আধুনিক রাষ্ট্র কল্পনা করা হয়েছে এক এক ভাবে। আমি এ কথা বলতে চাইছি না যে ভারত বলে কোনও রাষ্ট্র বা জাতি নেই। কথাটা হল, মরাঠি, তামিল বা বাঙালিরা ভারতীয় রাষ্ট্রকে, অর্থাৎ একটাই বস্তুকে, আলাদা ভাবে কল্পনা করেছে। এই আপেক্ষিকতার বাইরে এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে দাঁড়িয়ে তুমি বলতে পারবে, এটাই ‘আসল’ রাষ্ট্র, অন্য সব এরই বহু রূপ। ওই রকম কোনও অবস্থান হতে পারে না। সুতরাং বহুত্ববাদী ধারণাটাও আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ইংরেজি ভাষাতে, অর্থাৎ অ্যাকাডেমিক ভাষাতে, রাষ্ট্র বা জাতির স্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে। কিন্তু সেটাও অন্য সব ভাষাগত ধারণার মতো আর একটা ‘ধারণা’-ই, অর্থাৎ আপেক্ষিক। এই সব কথা ভাবা জরুরি, কারণ, যত ক্ষণ বলা হবে যে ভারতীয় জাতি বা রাষ্ট্র নামক একটিই জিনিস আছে, একটাই সত্য, তখনই প্রবণতা হবে, এই সত্যটা সকলের উপর চাপিয়ে দেওয়ার। আপেক্ষিকতাকে মেনে নেওয়া খুব কঠিন।
আমরা লক্ষ করি না যে এক একটা প্রদেশে তার নিজস্ব আধুনিক ভাষার ও গণসংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক কল্পনাই যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারত-কল্পনার আধার। এটা শুধু সংবিধানের ব্যাপার নয়, সংস্কৃতির দিক থেকেও আমাদের জাতি-রাষ্ট্রের গঠনটা ‘ফেডেরাল’। এ হেন ফেডেরাল গঠন তখনই মজবুত হবে, যখন এর প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতি সমান গুরুত্ব পাবে। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেছে তা হল, দেশের অধিকাংশ জুড়ে রাজনৈতিক তর্কের ও ভাষ্যের পাবলিক রূপটা একটি ভাষা, অর্থাৎ হিন্দি ভাষা-নির্ভর হয়ে উঠেছে। পশ্চিম থেকে পূর্ব ভারত জুড়ে এই রূপটির গুরুত্ব ও প্রভাব এত বেশি যে অন্য নানা জাতি-কল্পনা বা রাষ্ট্র-কল্পনাকে ছাপিয়ে সেটা জাঁকিয়ে বসেছে। হিন্দি-ভাষা ভিত্তিক রাষ্ট্র-কল্পনার মধ্যে আমরা হিন্দুত্ববাদ বলতে যা বুঝি, তার বহু মূল উপাদান রয়ে গিয়েছে। ভারতের একমাত্র সভ্যতা বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষা নির্ভর, এই রকম নানা ধারণা ওর মধ্যে গেঁথে আছে। একটা জিনিস এই নির্বাচনের পটভূমিতেও লক্ষ করছি যে, এই হিন্দুত্বের রাজনীতির প্রতিরোধ তখনই হয়, যখন আঞ্চলিক দলগুলো বিজেপি-আরএসএস-এর বিরুদ্ধে জোট বাঁধে। কিন্তু একটা দুটো নির্বাচনে এই জোটের যদি সাফল্য আসেও তাতে হিন্দুত্বের রাজনীতির বৃহত্তর প্রতিরোধ করা যাবে না। একাধিক ‘পিপল’ একত্র হয়ে একটা রাষ্ট্র গঠন করেছে— এই ভাবে ভাবতে না পারলে এই একটি-ভাষা-ভিত্তিক জাতি বা রাষ্ট্র-আদর্শের প্রাধান্যের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। বিপদটা হল, ওই প্রাধান্যের ফলে বহু জনগোষ্ঠী, যারা নিজেদের এই রাষ্ট্র-কাঠামোর বাইরের মানুষ বলে ভাবতে বাধ্য হয়, তারা ক্রমশ এও ভাবতে শুরু করতে পারে যে, এই গণতন্ত্রেরই কোনও প্রয়োজন নেই, কারণ সেটা তাদের স্বার্থ দেখে না। এই বিপদের কথা মাথায় রেখে আপেক্ষিকতার কথা ভাবছি।
প্র: আপনার লেখায় একটা বিষয় উঠে আসে, তা হল, ক্যাপিটাল আর কমিউনিটির সম্পর্ক। এক সময়ে লিখেছিলেন, এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব অস্বীকার করা যায় জাতীয়তাবাদের মতাদর্শ দিয়ে, আর জাতীয়তাবাদের ভিতরকার অসঙ্গতি ঢাকা দিতে কাজে আসে উন্নয়নের আইডিয়া। আরও বলেছেন যে পুঁজির আদর্শ রাজত্ব থেকে কমিউনিটি নির্বাসিত হওয়ার কথা, কিন্তু সে তলায় তলায় গোপন অস্তিত্ব জারি রাখে। এগুলো আপনার জাতীয়তাবাদের উপর প্রথম বই দু’টির বক্তব্য। এখন কমিউনিটির গোপন জীবনের কথা কি আর এই ভাবে বলবেন?
উ: আসলে ভারতে উন্নয়নের যে ধরন, তাকে মোটা দাগে দুটো ভাগ করে নিলে সুবিধে হয়। উনিশশো পঞ্চাশ থেকে মোটামুটি সত্তরের দশক অবধি জাতীয় উন্নয়নের ধারণায় এক দিকে ছিল পাবলিক সেক্টর, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ভারী শিল্প, পরিকাঠামো ইত্যাদি তৈরি, অন্য দিকে ছিল বেসরকারি পুঁজির নির্দিষ্ট ক্ষেত্র, যেমন দৈনন্দিন ব্যবহারের পণ্য উৎপাদন, ইত্যাদি। এদের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার জন্য ছিল যোজনা কমিশনের মতো সংস্থা। এতে সামগ্রিক ভাবে সবার স্বার্থ রক্ষা করার কথা বলা হত, সেই অর্থে আলাদা আলাদা কমিউনিটির কথা চাপা দিয়ে একটা জাতীয় কমিউনিটির কথা বলা হত, সবাই যার অংশীদার। ইমার্জেন্সির পর থেকে একটা নতুন পর্ব শুরু হল। উনিশশো একানব্বইয়ের অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর থেকে তা স্পষ্ট ভাবে দেখা গেল। পাবলিক সেক্টর সংগঠিত ক্ষেত্র থেকে দূরে সরে গেল; বেসরকারি পুঁজির হাতে চলে গেল বহু উদ্যোগ। এর ফলে মধ্যবিত্ত সমাজের চরিত্রে অনেক রকম বদল এল। কিন্তু তার পাশাপাশি যাকে অসংগঠিত ক্ষেত্র বলি, তার একটা ব্যাপক বিস্তার ঘটল।
এর সঙ্গে সংগঠিত ক্ষেত্রের যে ব্যবধান তৈরি হয়েছে তার ফলে সাম্প্রতিক রাজনীতিতে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রের দাবিদাওয়া, ক্ষোভ-বিক্ষোভ জানানোর একটা প্রক্রিয়া আছে। গণতন্ত্রের প্রসার ঘটেছে; রাজনীতির লোকেরা এই অসংগঠিত ক্ষেত্রের মানুষের ভোটের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। যে আদানপ্রদান এখানে চলে তাতে কমিউনিটির ধারণাটা পাল্টে গিয়েছে। প্রথমত, চিরাচরিত ঐতিহ্যবাহী কমিউনিটি— স্থানীয়, বা জনজাতি কমিউনিটি। বহু ক্ষেত্রেই স্থানীয় দাবিদাওয়ার আন্দোলন এই কমিউনিটির ধারণার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে। কিন্তু এটা এখনও কতটা ঐতিহ্যানুগ বা ‘ট্র্যাডিশনাল’— সেই প্রশ্ন তুলতেই হয়। আন্দোলনের ভাষায় হয়তো ঐতিহ্যের কথা আসছে, কিন্তু কমিউনিটিটা আর পুরনো ঐতিহ্যের উপর সংগঠিত নয়, তার রূপটা আসলে আধুনিক।
যাঁরা এথনোগ্রাফির কাজ করেন তাঁরা দেখাচ্ছেন, যারা নিজেদের এক জাতির লোক ভাবত না, তারা নানা জাতি-ভিত্তিক আন্দোলন হওয়ার পরে অনেক সময় নিজেদের এক বলে ভাবছে (মথুরা আর বিহারের যাদবদের মধ্যে যেমন ইদানীং বৈবাহিক সম্পর্ক চালু হয়েছে, যা আগে কল্পনাই করা যেত না)। কাজেই কমিউনিটিও বদলাচ্ছে। আর একটা জিনিস হয়েছে। এক জায়গায় জড়ো হয়ে কিছু মানুষ তাদের ক্ষোভ জানাচ্ছে, দাবি জানাচ্ছে। সেখানে সমাবেশের উপর দাঁড়িয়ে কমিউনিটি-উপলব্ধির জন্ম হচ্ছে। এটা কতটা দীর্ঘস্থায়ী তা আমরা সব সময় জানি না, কিন্তু এই ‘জনতা’র কমিউনিটির মধ্যে বিভিন্ন জাতির মানুষ চলে আসতে পারে। সংগঠিত ক্ষেত্রের অর্থনীতি এবং তার আনুষঙ্গিক আচার-আচরণ ইত্যাদি আমরা এত কাল নাগরিক সমাজের অনুষঙ্গে চিনে এসেছি। এই সমাজের বাইরে যে বিরাট অংশটা পড়ে আছে, তাকে আগে ট্র্যাডিশনাল কমিউনিটি বলে চিহ্নিত করা হত। প্রথমত, এখন আর এটা সম্পূর্ণ ট্র্যাডিশনাল নয়। দ্বিতীয়ত, নতুন মিশ্রণের ফলে, জন-সমাবেশের মধ্যে দিয়ে, এক রকমের কমিউনিটির জন্ম হচ্ছে। এক একটা কমিউনিটির দাবিদাওয়া মেটাতে এক এক রকম ব্যবস্থা করা হয়, প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়— নির্বাচনের আগে যেমন দেখি। এই পপুলিস্ট রাজনীতি না করে আজ আর কোনও রাজনৈতিক দলের উপায় নেই। কাজেই কমিউনিটির গোপন অস্তিত্বের কথা আর বলা যাবে না। একটা বিশাল অংশের মানুষ পুরনো কৃষি অর্থনীতির মধ্যেও পড়ে না, আবার আধুনিক সংগঠিত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও পড়ে না। এদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে, এমন একটা দাবি গণতান্ত্রিক রাজনীতির একেবারে ভিতরে ঢুকে গিয়েছে। ফলে পুঁজির সঙ্গে কমিউনিটির নতুন সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে।
প্র: নাগরিক সমাজ বা সিভিল সোসাইটির বাইরে পড়ে থাকা এই বিরাট জনসমাজকে আপনি ‘পলিটিকাল সোসাইটি’ আখ্যা দিয়েছেন। সম্প্রতি বলেছেন, জরুরি অবস্থার সময়ে আপনাদের অনেকের মনে হয়েছিল, ভারতের লিবারাল ডেমোক্র্যাসি ভেঙে পড়তে চলেছে। কিন্তু দেখা গেল, জরুরি অবস্থা থেকেই রাষ্ট্র শিক্ষা নিয়েছে। দমনপীড়নের উপর একান্ত নির্ভর না করে, পুঁজিবাদী বিকাশের প্রকল্পগুলো মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার পন্থা খুঁজেছে। নতুন যে ক্ষমতার প্রকরণ চালু হল তাকে আপনি মিশেল ফুকোর ‘গভর্নমেন্টালিটি’র আদলে বলছেন ‘প্রশাসনিকতা’। পলিটিকাল সোসাইটির মোকাবিলায় প্রশাসনিকতার ‘টেকনিক’ প্রকট হয়ে ওঠে। আপনার বক্তব্য, আপনারা যাদের নিম্নবর্গ বা সাবঅলটার্ন বলেছিলেন, তাদের সঙ্গে রাষ্ট্রের যে সম্পর্ক ছিল তা আমূল বদলে গিয়েছে। রাষ্ট্র আর বিজাতীয়, বহিরাগত বস্তু নয়; তার সঙ্গে নিম্নবর্গের দৈনন্দিন লেনদেনের, বোঝাপড়ার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এই প্রক্রিয়া কি একই ভাবে চলছে, না এর কোনও পরিবর্তন এখন লক্ষ করা যায়?
উ: যদি গণতন্ত্রীকরণের দিক থেকে দেখো, তা হলে বলতে হয়, ইমার্জেন্সির পরবর্তী সময়ে ভারতের গণতান্ত্রিক রাজনীতি গভীরতা পেয়েছে, প্রসারিত হয়েছে। প্রসারের একটা লক্ষণ হচ্ছে জনসমাবেশ, পলিটিকাল সোসাইটির মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাছে দাবিদাওয়া জানানো। আবার উল্টো দিকে ক্ষমতাসীন যারা, তারা এই অভাব-অসন্তোষ সামাল দিতে গিয়ে গভর্নমেন্টালিটির কৌশলগুলো ব্যাপক ভাবে আয়ত্ত করেছে। রাজনীতির লোকেরা বলবে, প্রশাসনকে ‘জনমুখী’ করা হচ্ছে। আসলে প্রশাসনকে অনেক বেশি তৎপর হতে হচ্ছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে কোন দিক থেকে দাবিদাওয়া উঠবে তার আগাম খবর রাখতে হচ্ছে। এবং সেই সব দাবি মেটানোর ক্ষেত্রে প্রশাসনিকতার রাজনৈতিক মূল মন্ত্র হল, নির্দিষ্ট সমস্যা ও তার সমাধানের ভিত্তিতে বড় সমাবেশকে ছোট ছোট টুকরোয় ভেঙে দেওয়া।
পুরনো জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের কাজ ছিল সর্বজনীন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এমনকি উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করা। আজ তার অবসান হচ্ছে। ওই রকম সর্বজনীন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনও বিক্ষোভ থাকলে তা সমস্ত মানুষকে জুড়ে ফেলতে পারে। কিন্তু নতুন প্রশাসনিকতায় থাকল এই ব্যাপকতার সম্ভাবনাকে ভেঙে দেওয়ার প্রকৌশল। সর্বজনের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার জায়গায়, ধরো, মহিলাদের, বৃদ্ধদের, শিশুদের জন্যে আলাদা সংস্থা, আলাদা প্রকল্প নেওয়া হল। এর ফলে অভিযোগ উঠলেও খুব বেশি লোক তার সঙ্গে জুড়ে যেতে পারবে না। এই মাইক্রো-ম্যানেজমেন্ট করতে গিয়ে সরকারি ব্যবস্থাটা ঢেলে সাজতে হল।
আমাদের কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে দেখি, কৃষকের সঙ্গে রাষ্ট্রের যোগাযোগ ছিল একটা থানা বা এক জন ম্যাজিস্ট্রেট-নির্ভর, যারা বাইরের জগতের বস্তু। এখন কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের কাছেও সরকারি কাগজপত্র ছাড়া, সরকারের সঙ্গে আদানপ্রদান ছাড়া বেঁচে থাকারই কোনও উপায় নেই। রাষ্ট্র এখন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অংশ। আপাতত রাজনীতির লোকেদের একটা প্রধান কাজ, নিজেদের সমর্থক বা সম্ভাব্য ভোটারদের সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি এজেন্সির যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া। ফলে গণতন্ত্র প্রশাসনিকতার সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে গিয়েছে। এমনকি সশস্ত্র মাওবাদীরাও তাদের অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর হয়ে সরকারি সুবিধা আদায় করে নেওয়ার জন্যে মধ্যস্থতা করে থাকে। এর দীর্ঘস্থায়ী ফল কী? আমার মনে হয়, প্রশাসনিকতার মধ্য দিয়ে দুটো অংশ ক্রমশ আরও বেশি করে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। কারণ, অন্য দিকে সংগঠিত নাগরিক সমাজের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উপর দৈনন্দিন নির্ভরতা অনেক কমে গিয়েছে। সরকারি হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ, যানবাহন, পোস্ট অফিসের সঙ্গে আমাদের মধ্যবিত্তের আজ আর কতটুকু সম্পর্ক?
প্র: এই ফারাককে আপনি পুঁজির ক্ষেত্রে ‘কর্পোরেট’ আর ‘নন-কর্পোরেট’-এ ভাগ করে দেখেছেন।
উ: সে ভাবেও ভাবা যায়। প্রশাসনিকতা চেষ্টা করে, ফারাকটা যাতে খুব বেশি প্রকট না-হয়। কিন্তু ব্যবধান আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। নাগরিক সমাজকে বলা হচ্ছে, উচ্চশিক্ষা ইত্যাদির ভার আর সরকারকে বহন করতে বোলো না। এ দিকে অসংগঠিত ক্ষেত্রের চাপ বাড়ছে। রাজনীতির লোকরা জানে, সেই চাপও সরকারকেই সামাল দিতে হবে। এর সম্ভাব্য পরিণতি, সরকার বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিতে চাইবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা। তাদের ভোটও নগণ্য। সুতরাং সরকারে আর কী দরকার? বেঙ্গালুরুতে এক সময়ে হাউজ়িং সোসাইটিগুলো বলল, তাদের আর পুরসভার জল দরকার নেই, তারা নিজেরাই ব্যবস্থা করে নেবে। এই প্রবণতা নাগরিক সমাজে গেড়ে বসলে বৃহত্তর গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী ফল হবে।
(চলবে)
ইতিহাসবিদ, সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা-র প্রাক্তন অধিকর্তা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক
সাক্ষাৎকার: মৈনাক বিশ্বাস