মড়ার খুলি নিয়ে যে চাষিরা ধরনায় বসেছিলেন দিল্লিতে, তাঁরা ফিরে গিয়েছেন তামিলনাড়ুর গ্রামে। আদিবাসী গ্রাম থেকে দু’শো কিলোমিটার মিছিলে হেঁটে যাঁদের পায়ে ফোসকা পড়েছিল, তাঁরাও মুম্বইয়ে বসে নেই। মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, রাজস্থানে চাষি আজ খামারে।
চাষও সরে গিয়েছে রাজনীতির কেন্দ্র থেকে। ফসল ফলিয়ে চাষির লাভ হচ্ছে না। কৃষক-বিক্ষোভ সেই সঙ্কটকে রাজনীতির মধ্যস্থলে বসিয়েছিল। হাড়ে কাঁপুনি ধরেছিল নেতাদের। কেন্দ্রীয় সরকার তড়িঘড়ি দুটো ঘোষণা করেছিল। এক, সরকারের নির্ধারিত দর (ন্যূনতম সহায়ক মূল্য) বাড়বে, এবং সব ফসলে তা দেওয়া হবে। দুই, ফসলের ই-বাজার হবে। সেরা দরে নিজের ফসল বেচবেন চাষি।
চাষির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই বোঝা যায়, কত অর্থহীন এই প্রতিশ্রুতি। কাজগুলো হয়নি, কবে হবে তা-ও বলা সম্ভব নয়। এ রাজ্য থেকে একটিই দৃষ্টান্ত ধরা যাক, সরষে। কেন্দ্র বলছে, কুইন্টালে চার হাজার টাকা হল সরষের ন্যায্য দাম। মানে, ওই দাম না পেলে চাষির সার-বিষের খরচ, মজুরি ওঠে না।
রাজ্যের কোন বাজারে ফসলের কত দাম যাচ্ছে, সরকারি দরের চেয়ে তা কত কম, সে তথ্য নিয়মিত প্রকাশ করছে যোগেন্দ্র যাদবের অনুগামী ‘জয় কিসান আন্দোলন’। তাদের বুলেটিন বলছে, পশ্চিমবঙ্গে সরষের সর্বনিম্ন দাম মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায়। কুইন্টাল বত্রিশশো টাকা। মানে, কুইন্টালে আটশো টাকা ‘লুট’ হচ্ছে চাষির, বলছেন তাঁরা। বেলডাঙায় গিয়ে দেখা গেল, এ বছর সরষে হয়েছে প্রচুর, মানও উত্তম। একটি অয়েল মিলের মালিক সদানন্দ সাহা বললেন, ‘‘পঞ্চাশ বছরের ব্যবসা। এ বার লোকাল সরষের যা কোয়ালিটি, আগে দেখিনি।’’ কারণ হাইব্রিড বীজ। এ বার নদিয়া-মুর্শিদাবাদে গম চাষ নিষিদ্ধ, তাই বিনা পয়সায় সরষে, ডাল, ভুট্টার বীজ দিয়েছে সরকার। বেলডাঙা, রানিগঞ্জ, ডোমকলের চাষিরা জানালেন, সাবেকি বীজের চেয়ে হাইব্রিডে উৎপাদন বিঘে-প্রতি অন্তত পঞ্চাশ কিলোগ্রাম বেশি। লম্বা শীতও এ বার ভাল ফলনে সহায়ক হয়েছে।
কিন্তু পড়েছে দাম। সরষে ওঠার পরে-পরেই চাষিরা পেয়েছেন কুইন্টালে ২৮০০-৩০০০ টাকা। এ বছর মুর্শিদাবাদে এক লক্ষ ত্রিশ হাজার হেক্টর জমিতে সরষের চাষ হয়েছে। একর প্রতি ছয় কুইন্টাল উৎপাদন ধরলে কেবল মুর্শিদাবাদে চাষির লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় দেড়শো কোটি টাকারও বেশি।
আর রাজ্যে? মার্চের গোড়া থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি, যখন অধিকাংশ চাষি সরষে বিক্রি করেছেন, দর গিয়েছে ৩৩৪৮-৩৩৮৯ টাকা। এ বছর রাজ্যে সরষের প্রত্যাশিত উৎপাদন সাড়ে ছয় লক্ষ টন। খুব আলগা হিসেবও (কুইন্টালে তিনশো টাকা ক্ষতি ধরে) দেখায়, অন্তত চারশো কোটি টাকা লোকসান হয়েছে চাষির।
বাংলার চাষি এত হিসেব কষেননি। কিন্তু সরষের দর যে গত বছরের চেয়েও কম, তা টের পাচ্ছে। তিক্ততার সঙ্গে ক্ষোভের ঝাঁজও যোগ হয়েছে। গাছে তুলে মই কেড়েছে সরকার। গম চাষ বন্ধ করায় সরষে যে এ বার বেশি হবে, সরকার কি জানত না? তবে কিছু করেনি কেন?
রাজ্যের আধিকারিকরা জানালেন, ঠিক ছিল, সহায়ক মূল্যে দশ হাজার টন সরষে কিনবে কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রকের অধীনস্থ ‘নাফেড’। সামান্যই, তবু ঠিক সময়ে, ঠিক জায়গায় কিনলে দামের পতন রোখা যেত। এই প্রথম ধান-পাটের বাইরে সরকার ন্যায্য মূল্যে ফসল কিনছে, এমনও নয়। গত বছর তিল আর কলাই কিনেছিল। কিন্তু সরষে-চাষির মন্দ কপাল। নাফেড-এর রাজ্য কর্তা জানালেন, কেন্দ্র থেকে এখনও ছাড়পত্র মেলেনি। হয়তো এ বার মিলবে। হায়, এত দিনে চাষির ঘর থেকে অধিকাংশ সরষে ঢুকে গিয়েছে আড়তে।
কিন্তু যে রাজ্যের সরকার ‘খাদ্যসাথী’ প্রকল্পের জন্য কয়েক লক্ষ টন ধান নিজেই কেনে, সে কেন সামান্য সরষে বা ডাল কিনবে না? একটা উত্তর প্রশাসনিক। সহায়ক মূল্যের টাকা জোগায় কেন্দ্র। বাড়তি উৎপাদনের জন্য দাম পড়বে, জানা থাকলেও ক্রয়ের আগাম অনুমোদন মেলে না কেন্দ্র থেকে। বাজার কতটা পড়ল, দেখিয়ে তবে ক্রয়ের আবেদন পাঠায় রাজ্য। এতে কী করে গরিবতম চাষির অভাবী বিক্রি রোখা যায়, কর্তারাই জানেন।
রাজনৈতিক উত্তর, চাট্টি সরষে বা তিল কিনতে সরকারি ব্যবস্থাকে মাঠে নামানোর হ্যাপা পোষায় না। সরষে নানা জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চাষ হয়। কিনতে যথেষ্ট তোড়জোড় চাই। সরষে চাষি অনশন-অবরোধ করেননি, পুলিশের গাড়িও জ্বালাননি। কে তাঁর জন্য মাথা ঘামাবে? নেতারা মাথা ঘামান তখনই, যখন বাধ্য হন। হরিয়ানার রেওয়ারিতে গত বছর সরষের সতেরো শতাংশ কিনেছিল রাজ্য। জয় কিসান আন্দোলনের দাবি, চাষিদের চাপে এ বছর কিনেছে অর্ধেকেরও বেশি। কেবল একটি মান্ডিতেই চার কোটি টাকা বাড়তি মিলেছে।
এক সময় বাংলার চাষিও আন্দোলনে নেমেছিলেন, ফসলের ন্যায্য ভাগ চেয়ে। ‘তেভাগা’ রুখতে জোতদারের পাশে ছিল পুলিশ। আজ চাষির দাবি ন্যায্য দাম, আ়ড়তদারের পাশে সরকারি আধিকারিক। একটা ফাইল দিন পনেরো-কুড়ি চেপে রাখলেই হল। জলের দরে ফসল মিলবে। তার পর চাষি গলায়-দড়ি গায়ে-আগুন পায়ে-ফোসকা নিয়ে ক্যামেরার জন্য একটা ‘স্পেকট্যাকল’ খাড়া করুন। আত্ম-অবমাননার বিষ্ঠা মাখুন সারা গায়ে। কার কী এসে গেল।