দানবীয়

অসম্মান পশ্চিমবঙ্গের। অসম্মান ভারতেরও। একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশ কতখানি অপশাসিত হইলে এতটা কুনাট্য দেখা যায়, তাহার হাতে-গরম দৃষ্টান্ত হইয়া উঠিবার মধ্যে, আর যাহাই হউক, গৌরব নাই। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কেন্দ্রের অধিকার কতখানি, আর প্রাদেশিক স্বাধিকার কতখানি, স্বাধীনতার প্রথম লগ্ন হইতেই তাহার কোনও নির্দিষ্ট সীমারেখা ছিল না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

—ছবি এপি।

গত দুই দিন ধরিয়া পশ্চিমবঙ্গ জাতীয় সংবাদমাধ্যমের মূল বিষয়বস্তু। তাহার সংবাদতরঙ্গ আন্তর্জাতিক দুনিয়াতেও প্রসারিত। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের মধ্যে এমন যুদ্ধবৎ পরিস্থিতি বিশেষ গুরুতর সংবাদের আকার লইয়া দিকে দিকে প্রচারিত হইতেছে। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই কলিকাতার পুলিশ কমিশনারকে ধরিয়া আনিতে গিয়া উল্টা বিপাকগ্রস্ত হইয়াছে, সিবিআইয়ের কলিকাতাস্থ ডেরাগুলি পুলিশ ঘিরিয়া ফেলিয়াছে, সিবিআই কর্তাদের ধরিয়া টানাহেঁচড়া করিতেছে, মুখ্যমন্ত্রী অন্যান্য মন্ত্রী-নেতা-কর্তা পরিবৃত হইয়া ধর্নায় বসিয়াছেন, ‘গণতন্ত্র’ না বাঁচাইয়া ঘরে ফিরিবেন না ঘোষণা করিয়াছেন, সরকার পক্ষের বিক্ষোভকারীরা দলে দলে রাস্তায় নামিতেছেন— নাট্যোচিত কোনও উপাদানই বাদ যায় নাই। এমন একটি ঘটনায় কোন পক্ষের লাভ হইল, রাজনীতির সাপলুডোয় কে আগাইলেন কে পিছাইলেন ইত্যাদি চর্চার বহু সুযোগ পাওয়া যাইবে। কিন্তু ঘটনাটির মধ্যে ভারতীয় রাজনীতির যে বিকার অত্যুচ্চ মাত্রায় প্রকাশিত, তাহা এখনই খেয়াল না করিয়া থাকা মুশকিল। দুঃখের কথা, পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যে বাহিরের দুনিয়ার মনোযোগ জুটিল বটে, কিন্তু জুটিল এমন এক কারণে যাহাতে এক বিন্দু গৌরব নাই, আছে শুধু চূড়ান্ত অসম্মান।

Advertisement

অসম্মান পশ্চিমবঙ্গের। অসম্মান ভারতেরও। একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশ কতখানি অপশাসিত হইলে এতটা কুনাট্য দেখা যায়, তাহার হাতে-গরম দৃষ্টান্ত হইয়া উঠিবার মধ্যে, আর যাহাই হউক, গৌরব নাই। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কেন্দ্রের অধিকার কতখানি, আর প্রাদেশিক স্বাধিকার কতখানি, স্বাধীনতার প্রথম লগ্ন হইতেই তাহার কোনও নির্দিষ্ট সীমারেখা ছিল না। কিন্তু নির্দিষ্ট সীমারেখা না থাকিবার একটি সদর্থক তাৎপর্যও থাকিতে পারিত। পারস্পরিকতার ক্ষেত্র খোলা থাকিতে পারিত। দুই পক্ষের পরিসর বজায় রাখিয়া কাজ করিবার সম্ভাবনা থাকিতে পারিত। প্রত্যাশা করা যাইতে পারিত যে দুই পক্ষই অস্পষ্ট সীমারেখাটি মাথায় রাখিয়া তাহার ভিতরে থাকিয়া কাজ করিবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ঘটিতেছে পুরা বিপরীত। কেন্দ্র ও রাজ্য তাহাদের এক্তিয়ারের প্রতিষ্ঠানগুলিকে ক্রমে রাজনৈতিক যন্ত্রে পরিণত করিয়াছে— এবং ইহাদের কাজ দাঁড়াইয়াছে পরস্পরকে হেনস্থা করিবার কার্যক্রম রচনা। সিবিআই যে কেন্দ্রীয় রাজনীতির অস্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়, অনেক দিন ধরিয়াই তাহা সর্বজ্ঞাত। কিন্তু বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসনে তাহা যে অবাধ অসংযমের সহিত বিজেপিবিরোধী রাজ্যগুলিকে নাকাল করিতে নামিয়াছে, তাহাও অভূতপূর্ব। পশ্চিমবঙ্গ বিরোধী রাজ্যগুলির মধ্যে অগ্রগণ্য, তাই তাহার প্রশাসন কড়ায় গণ্ডায় প্রতিশোধ লইতেছে বলিয়া অন্য বিরোধীরা করতালিরত। তাই, সিবিআই রাজ্যের পুলিশ কমিশনারকে ধরিয়া আনিতে ছুটিয়াছে, রাজ্যের পুলিশবাহিনীও সিবিআই কর্তাদের ঘাড়ধাক্কা দিতেছে। অর্থাৎ গণতন্ত্রের বিবিধ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এখন কেন্দ্র-রাজ্য দ্বৈরথ ভাগাভাগি। সেই দ্বৈরথ-নাটকের নির্দেশনায় পরমোৎসাহে ব্যাপৃত রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা।

গণতন্ত্রের বিবিধ প্রতিষ্ঠানের এই পরিবর্তিত ভূমিকায় ভারতীয় নাগরিক আজ সম্ভবত ভুলিয়াছেন যে, একদা এই প্রতিষ্ঠানগুলির কাজ ছিল দুর্নীতি দমন ও দুষ্টের শাসনের লক্ষ্যে পরস্পরের সহিত হাতে হাত মিলাইয়া চলা। যে অতি-রাজনীতির দানব তাহাদের এই কর্তব্যকর্ম ভুলাইয়াছে, দেশের শাসনব্যবস্থার অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করিয়াছে, বর্তমানের কেন্দ্র বা রাজ্য কোনও সরকারই সেই দানব তৈরির দায়িত্ব এড়াইতে পারে না। সকল প্রকার বৃহত্তর স্বার্থকে সলিলসমাধি দিয়া তাহারা দেশের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পদগুলিকে নিয়োজিত করিয়াছে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ পরিপুষ্ট করিতে। এই দানবতন্ত্রের দায় তাহাদের সকলের। তাহারা সেই দায় স্বীকার না করিলে গণতন্ত্র বিপন্ন হইতে বাধ্য।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement