শুভ নববর্ষ। নতুন বছর আনন্দের হোক, সমৃদ্ধি আনুক।
নববর্ষকে মহাধুমধামেই স্বাগত জানাচ্ছে বাঙালি। আর আবার সেই চিরচেনা প্রশ্নগুলোও মাথা তুলছে। বাংলা ভাষা, বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি, বাঙালির পরম্পরা-ঐতিহ্য, খাঁটি বাঙালি জীবনচর্যা ইত্যাদি সম্পর্কে কি আমরা আদৌ সচেতন? গোটা বছর সংযোগই নেই বাংলা বা বাঙালিয়ানার সঙ্গে, নতুন বাংলা সন দুয়ারে হাজির হলে হঠাৎ খাঁটি বাঙালি সাজার চেষ্টা কেন? এক দিনের জন্য উত্তুঙ্গ বাঙালিয়ানা দেখিয়ে পরের দিনই আবার পূর্ববৎ যদি হতে হয়, তা হলে লাভ কী?
প্রশ্নগুলো ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কিন্তু তা বলে বাংলা নববর্ষের উদ্যাপনও ফেলে দেওয়া যাবে না। উদ্যাপনটা ফি বছর আসে বলেই তো প্রশ্নগুলো ফি বছর মাথা তোলে এবং বাঙালির জীবনচর্যা এখনও বাঙালির মতোই কি না, সে নিয়ে আবার অনেককে তারা ভাবতে বাধ্য করে, সচেতন করে।
বাংলা নববর্ষ বা এই ধরনের সামাজিক উদ্যাপনের আরও একটা তাৎপর্য রয়েছে— ভারতের বিশ্বখ্যাত বিবিধতা অনেকাংশেই নিহিত এই উৎসবগুলোর অস্তিত্বে। কারও নববর্ষ, কারও বৈশাখী, কারও ভিশু, কারও পুথুভরুশম, কারও রঙ্গালি বিহু— সকলেই একই সময়ে, সবই নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উৎসব। কিন্তু আচারে, পরম্পরায়, উদ্যাপনের রীতিনীতিতে প্রত্যেকেই অপরের চেয়ে ভিন্ন। উৎসবগুলোর মধ্যে দিয়ে ভারতীয় সভ্যতার বিভিন্ন ধারা সগর্বে নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ভাস্বর করে তোলে, একই সঙ্গে অভিন্ন শরীরে বিলীন হয়। যেন অনেকগুলো নদী ভিন্ন ভিন্ন ভূ-ভাগের মাটির গন্ধ নিয়ে এসে অভিন্ন এক ধারায় সমর্পণ করছে নিজেদের জলরাশিকে। একেই আমরা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য বলি, এই সমর্পণকেই বিবিধের মাঝে মহান মিলন নামে ডাকি।
আজকের ভারত কোনও কোনও স্তরে অসহিষ্ণুতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আজকের ভারতে ইতিউতি খাদ্যাভ্যাস বদলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। আজকের ভারতে কোথাও কোথাও সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে দেখছি। সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস সাক্ষী, এই সব চেষ্টা দীর্ঘ মেয়াদে সাফল্য পায়নি কখনও। সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠার চেষ্টায় উন্মত্ত কোনও শক্তি যখনই সভ্যতার যাবতীয় বিবিধতাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছে, যখনই কৃত্রিম ভাবে বা জোর করে কিছু আরোপ করার চেষ্টা হয়েছে কোনও মৌলিক জীবনচর্যার উপরে, তখনই সভ্যতা রুখে দাঁড়িয়েছে, সঙ্ঘাত তীব্রতর হয়েছে। সঙ্ঘাত তীব্রতর হোক, এমনটা আর কাম্য নয় কখনওই। স্বতন্ত্র অস্তিত্বের প্রদর্শনটা তাই আজ আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠা জরুরি। নতুন বছরে আরও এক বার জোর দিয়ে মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি, ভারতীয়ত্ব আসলে বিবিধতার সমন্বয়।