সবরমতী আখ্যান অতীত, সীমান্তে ড্রাগনের উত্তপ্ত শ্বাস

তা বলে চিন ও ভারতের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, শান্তি আলোচনা, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক— সব শিকেয় তুলে রাখতে হবে? প্রশ্ন তুললেন জয়ন্ত ঘোষালতা বলে চিন ও ভারতের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, শান্তি আলোচনা, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক— সব শিকেয় তুলে রাখতে হবে? প্রশ্ন তুললেন জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share:

সবরমতী আশ্রমে নরেন্দ্র মোদী এবং শি জিনপিং। এই ছবি এখন অতীত। ছবি: ইউটিউব।

কূটনীতির সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয় অনেক সময়েই যুক্ত হয়ে থাকে। গোটা পৃথিবী জুড়েই এই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু শুধুই নির্বাচনী রাজনীতির কথা মাথায় রেখে কূটনীতি নির্ধারণ করা, সে এক মস্ত বড় মুর্খামি। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথমে চিনের রাষ্ট্রপ্রধানকে নিজের রাজ্যে ডেকে নিয়ে গিয়ে সবরমতী নদীর তীরে ঝুলনে একসঙ্গে বসে দোল খাওয়ার দৃশ্যরচনা, এ যেমন এক সখ্য রচনার জন্য চরম প্রচেষ্টা, আবার তার পরই এমন সংঘাত দু’দেশের মধ্যে তৈরি হয়েছে, তা-ও অভূতপূর্ব। এখন তো ডোকলাম উপত্যকার সঠিক অবস্থানের অনিশ্চয়তা নিয়ে দু’দেশের মধ্যে এক চূড়ান্ত সংঘাতের আবহ তৈরি হয়েছে। বিজেপির এক শীর্ষনেতাকে যখন বললাম, চিন নিয়ে মোদীর বিদেশনীতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা লক্ষ্য করছি, তখন তিনি বললেন, আসলে কোনও অনিশ্চয়তা নেই। কোনও ধূসর এলাকাই নেই মোদীর বিদেশনীতিতে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শত্রু জেনেও তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিলেন মোদী। তাই সবরমতী উপাখ্যান। কিন্তু দেখা গেল, ‘অঙ্গার শতধৌতেন মলিনত্বক ন মুঞ্চতে’। কয়লা কালোই থাকবে। চিন এক দিকে বন্ধুত্বের কথা বললেও অন্য দিকে সীমান্তে ড্রাগনের উত্তপ্ত নিশ্বাস ফেলেই যাচ্ছে। তাই এ বার ভারতও সংঘাতের পথে।

Advertisement

কিন্তু চিনের মতো রাষ্ট্রের অর্থনীতির সঙ্গে এখনও ভারতের তুলনা হয় না। অনেকে আর্থিক গতির ক্ষেত্রে চিনকে খরগোশ আর ভারতকে কচ্ছপ বলেছেন, তার পরও এ হেন পেশী প্রদর্শন বা বলা যায় ৫২ ইঞ্চি ছাতি প্রদর্শন কি উচিত কূটনীতি? জবাবে মোদীর বিদেশনীতি বোঝাতে ওই বিজেপি নেতা বোঝালেন, আসলে আপনারা সত্তরের দশকের মানসিকতায় আটকে রয়েছেন। ’৬২ সালের চিনের আগ্রাসনে নেহরু ভেঙে একেবারে খান খান হয়ে যান। ’৬৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। আমরা এক ধরনের নিরাপত্তার অভাব বোধে ভুগতে শুরু করি চিনকে নিয়ে। সেই ভয় এখনও মন থেকে যায়নি। আর তার সুবিধা পায় চিন। এ বার যদি আমরা রুখে দাঁড়াই, আস্তিন গোটাই, তা হলে দেখবেন চিনও ভয় পাবে। সেই সঞ্জীব কুমার আর বিদ্যা সিনহার ডায়লগ মনে নেই? নতুন বিয়ের পর প্রতি দিন স্বামী গর্জন করত, কারণ কোনও বন্ধু তাকে পরামর্শ দিয়েছিল, বিল্লি প্রথম রাতেই মেরে ফেলতে হয়। তাই প্রতি দিনই ‘এটা চাই, ওটা চাই, তা না হলে ভাল হবে না’, এ ধরনের হুমকি স্বামী দিতেই থাকে। এক দিন গরম জল চেয়ে এমনই হুমকি দিয়েছিলেন সঞ্জীব কুমার, ‘গরম পানি আভি দেও, বরনা...।’ এই হুমকি শুনতে শুনতে ক্লান্ত, বিরক্ত বিদ্যা সিনহা রুখে দাঁড়িয়ে বলে ওঠেন, ‘বরনা! বরনা কেয়া? কেয়া করোগে?’ স্ত্রী জাতির হুঙ্কার প্রথম বার শুনে কেঁচো হয়ে গিয়ে সঞ্জীব কুমার বললেন, ‘কুছ নেহি। ঠান্ডা পানি সে নাহা লুঙ্গা!’

তাই আমরাও যদি এ যাত্রা রুখে দাঁড়াই, অটল থাকি মানসিকতায়, তা হলে চিন ভয় পাবে। চিনকে ভয় পাওয়ার মানসিকতা, ’৭০-এর মানসিকতার ভয় থেকে ভারতবাসীকে মুক্ত করতে চাইছেন মোদী, এ তো খুব ভাল কথা। ’৬২ সালের চিনও যেমন নেই, ভারতও বদলে গেছে অনেক। বদলে যাচ্ছে। ভারত আজ অনেক বড় শক্তিশালী দেশ। ভারত আজ এক বিশাল বাজার। ভারতকে তাই অবজ্ঞা করে চলতে পারবে না চিনও।

Advertisement

ডোকলামে বিশাল সৈন্য সমাবেশ করেই নিশ্চিন্তে বসে থাকছে না ভারত। গোটা সিকিম সীমান্তেই সতর্কতা বাড়ানো হয়েছে। —ফাইল চিত্র।

বেশ, মানলাম সে কথা। কিন্তু, তা বলে কূটনীতিতে একটা দ্বিমুখী রণকৌশলই থাকবে না, এ কেমনতর কথা? সংঘাতের আবহের মধ্যেও বিদেশসচিব পর্যায়ে, এমনকী, রাষ্ট্রপ্রধানের পর্যায়েও ট্র্যাক-ওয়ান কূটনীতি চলেছে। ট্র্যাক-ওয়ানের পাশাপাশি ট্র্যাক-টু কূটনীতিও চিরকাল হয়। এখন তো ভোটের রাজনীতির সঙ্গে ট্র্যাক-টু কূটনীতিও যেন মহা দুর্বলতা, মহাপাপ।

পাকিস্তানের সঙ্গে এ হেন ‘তু তু ম্যায় ম্যায়’ কূটনীতি বহু বছর ধরে আমরা দেখছি। পাকিস্তানকেও আমরা বার বার বলেছি, চিনা মডেল অনুসরণযোগ্য। অর্থাৎ, সীমান্ত নিয়ে বিবাদ যা-ই থাকুক, সে সব নিয়ে দু’পক্ষের আলোচনা চলতেই থাকুক, কিন্তু তা বলে দু’দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, শান্তি আলোচনা, দু’দেশের মানুষের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক— সব শিকেয় তুলে রাখব? এ কোনও কাজের কথা নয়। এখন সেটাই হচ্ছে। আরএসএস এবং সঙ্ঘ পরিবার সেই নেহরুর সময় থেকে চিন নিয়ে তীব্র বিরোধিতাকেই মতাদর্শগত লাইনে পরিণত করে। কমিউনিস্ট বিরোধিতা এক দিকে, অন্য দিকে এই চিন-বিরোধিতাকে অস্ত্র করে উগ্র এক জাতীয়তাবাদী শক্তি গড়ে তোলা। হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তিকে মূলধন করে শক্তিশালী ভারতীয় রাষ্ট্র গঠন, এটাই তো সঙ্ঘ পরিবারের লক্ষ্য।

সবই তো বুঝলাম। কিন্তু তা হলে কূটনীতির কী হবে? নেহরুর সঙ্গে বিবাদের ঐতিহ্যের অবসান ঘটিয়ে ১৯৮৮ সালে তাঁর নাতি রাজীব যে চিনে গেলেন, তা-ও ৩৪ বছর পর। সেটা কি তবে ভারতীয় বিদেশনীতির ভুল? দেং শিয়াও পিং তখন এসে সীমান্ত বিবাদ ঘোচানোর কথা বললেন। চিনেও সে এক নতুন হাওয়া। তার পূর্ণ সুযোগ রাজীব নিতে চেয়েছিলেন। সে ছিল সদর্থক কূটনীতি। আসলে ইতিহাসে সাময়িক ভাবে ব্যক্তি বড় ভূমিকা নেয়। কিন্তু আসলে শেষ পর্যন্ত বৃহৎ প্রেক্ষাপটই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় ঘটনা। দেং শিয়াও পিং ব্যক্তি বলে নন, সে সময়ে চিনের রূপান্তর পর্বটিই ইতিহাস। সেই রূপান্তরে ভারতের সঙ্গে বরফ গলানোর প্রাসঙ্গিকতা ছিল চিনে। ’৬২ সালের পর ১৯৯৩ সালে প্রথম সীমান্ত চুক্তি হয়। প্রকৃত সীমান্ত নিয়ন্ত্রণরেখায় শান্তিরক্ষার চুক্তি। ২০০৩ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী চিন গেলেন। শুধু গেলেন না, তিনি সীমান্ত সমস্যাকে স্থায়ী সমাধানের স্বার্থে নতুন করে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করলেন বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগের মাধ্যমে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে ব্রজেশ মিশ্র এ কাজে দীর্ঘ দিন সক্রিয় ছিলেন। ২০১৩ সালে মনমোহন সিংহ তখন প্রধানমন্ত্রী। এ সময়ে ফের সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ে। আকসাই চিনের কাছে ডেপসাং-এ তিন সপ্তাহের ‘স্ট্যান্ড অফ’ হয়। অক্টোবর মাসে মনমোহন যান চিনে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেট্রলিং-এর যে প্রটোকল সে ব্যাপারে প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে শক্তপোক্ত করতে নতুন বর্ডার প্যাক্ট হয়। এর পর ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যাত্রা শুরু। শি জিনপিং যখন প্রথম ভারত সফরে এলেন তখন লাদাখের কালো মেঘের আসা-যাওয়ায় দু’সপ্তাহের ‘ফেস অফ’ হয়। মোদী চান চিনের সঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা নিয়ে যে অস্পষ্টতা আছে তা দূর করতে। যদিও চিন চায় একটা সীমান্ত আচরণবিধি। তারপর এখন ভুটান। ১৯৮৮ সালের পর এই প্রথম তাদের চলতি অবস্থান থেকে সরে এসে ভারত সীমান্ত নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলল চিন। কেন এমন হল? শুধু দোষারোপ করলেই বোধহয় সমস্যার সমাধান হবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন