ঠিক একশো বছর আগে বিদায় নিয়েছিলেন অগুস্ত রদ্যাঁ

কিন্তু শেখে কে

সারগর্ভবান বালজাককে গড়তে রদ্যাঁ প্রথমে এক পুরুষ মডেলকে নিয়ে বেশ কিছু ন্যুড স্টাডি করেন। তার পর, সিনেমায় যেমন দেখানো হয়, আস্ত এক বাথরোব প্লাস্টার অব প্যারিসে ডুবিয়ে দেন। তৈরি হয় ছাঁচ। তাঁর ছাত্র বোর্দেল হাত দুটো বাদ দিতে বলেন, রদ্যাঁ মেনে নেন সেই পরামর্শ। তিনি ধরতে চান মানুষের ভিতরটাকে, তার বাইরের অবয়বটিকে নয়।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৭ ০৬:১০
Share:

সেকাল: রদ্যাঁ-র ভাস্কর্য প্রদর্শনীর উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। বিড়লা অ্যাকাডেমি অব আর্ট অ্যান্ড কালচার, ৫ মে ১৯৮৩। ছবি: দেবীপ্রসাদ সিংহ

বলশেভিক বিপ্লবের পাশাপাশি, একশো বছর আগের নভেম্বর মাসে ইউরোপে আর একটা ঘটনা ঘটেছিল। আজকের দিনে, ১৭ নভেম্বর প্যারিসে মারা গিয়েছিলেন অগুস্ত রদ্যাঁ। ভাস্কর্যকে যিনি ছাঁচে ঢালাই ব্রোঞ্জ, সেরামিক থেকে মুক্তি দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন মেধা ও মননের দীপ্তি, সেই শিল্পীর কাজ বিপ্লব নয়? আজও দার্শনিক চিন্তার প্রতিভূ বলতেই চিবুকে হাত দিয়ে তাঁর সেই নগ্ন ব্রোঞ্জপুরুষ ‘দ্য থিঙ্কার’। লেখক কী রকম? রদ্যাঁ গড়লেন— গর্ভবতী মেয়ের রূপে বালজাক, পরে লোকের চিৎকারে-প্রতিবাদে সে মূর্তিকে পরিয়ে দিলেন বাথরোব। কিন্তু স্ফীত উদর রয়ে গেল। বালজাকের গর্ভেই তো জন্ম নেয় আধুনিক ফরাসি উপন্যাস! বিপ্লব বইকি! চার দশক ধরে রদ্যাঁর বালজাক প্যারিসেও, এমনকী প্যারিসেও, খুঁজে পায়নি নিজস্ব ঠিকানা। ভাস্কর্যটি বন্দি ছিল শিল্পীর স্টুডিয়োতে, মুক্তি পায় তাঁর মৃত্যুর পরে ১৯৩৯ সালে।

Advertisement

সারগর্ভবান বালজাককে গড়তে রদ্যাঁ প্রথমে এক পুরুষ মডেলকে নিয়ে বেশ কিছু ন্যুড স্টাডি করেন। তার পর, সিনেমায় যেমন দেখানো হয়, আস্ত এক বাথরোব প্লাস্টার অব প্যারিসে ডুবিয়ে দেন। তৈরি হয় ছাঁচ। তাঁর ছাত্র বোর্দেল হাত দুটো বাদ দিতে বলেন, রদ্যাঁ মেনে নেন সেই পরামর্শ। তিনি ধরতে চান মানুষের ভিতরটাকে, তার বাইরের অবয়বটিকে নয়। এক বার বলেছিলেন, তাঁর দর্শন প্রকৃতিকে হুবহু অনুসরণ করা, ওপর থেকে কিছু চাপানো নয়। এক সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, ‘কিন্তু প্রকৃতিকে পুরো অনুসরণ আপনি করেন না।!’ রঁদ্যার উত্তর: আপনি বুঝতে পারছেন না, আমি সত্যকে সব দিক থেকে দেখি, শুধু বাইরে থেকে নয়।

তাঁর এই সত্যদর্শন পরে এই বঙ্গেও প্রভাব ফেলবে। অনেক প্রমাণ তার। দেবীপ্রসাদ, প্রদোষ দাশগুপ্ত, চিন্তামণি কর, মীরা মুখোপাধ্যায়দের কথা ছেড়ে দেওয়া যাক, তাঁরা স্বধর্মে স্থিত ভাস্কর। সমরেশ বসুর ‘দেখি নাই ফিরে’ উপন্যাসে বিকাশ ভট্টাচার্যের এক ড্রয়িং। রামকিঙ্কর বেজ বসে আছেন, সামনে মদের খুরি। রামকিঙ্করের হাত নেই। সমাজ তাঁকে ভিতরে ভিতরে অকর্মক বানিয়েছে। বারংবার প্রভাব-ফেলা এই সত্যদর্শনও কি বিপ্লব নয়?

Advertisement

চলচ্চিত্র উৎসবকে ধন্যবাদ। মৃত্যুশতবার্ষিকীতে ভিড়ে ঠাসা নন্দনে দেখা গেল কান চলচ্চিত্র উৎসবে অভিনন্দিত নতুন ফরাসি ছবি ‘রদ্যাঁ’। মনে পড়ল, ১৯৮৩ সালে এই শহরের বিড়লা মিউজিয়মে রদ্যাঁর ভাস্কর্যের প্রদর্শনী হয়েছিল। কলকাতায় সেই প্রথম রদ্যাঁ-প্রদর্শনী, জনতার দাবিতে নির্ধারিত সময়ের পরেও টিকিট বিক্রি হত। প্রায় এক মাস ধরে শহর, মফস্সল থেকে এসে লাখের বেশি দর্শক সেই ভাস্কর্যসম্ভার দেখেছিলেন। ৩১ মে প্রদর্শনীর শেষ দিনেও মাইকে ঘোষণা হচ্ছিল: ‘আপনারা তাড়াতাড়ি করুন। লাইনে আরও অনেকে দাঁড়িয়ে আছেন।’ তিন দশক পর সিনেমা হলের ভিড় বুঝিয়ে দিল, রদ্যাঁ আকর্ষণ অটুট। এত পালাবদল, হইচইয়ের মাঝেও শহর স্বধর্মে স্থিত।

সেকাল: রদ্যাঁ-র ভাস্কর্য প্রদর্শনীর উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। বিড়লা অ্যাকাডেমি অব আর্ট অ্যান্ড কালচার, ৫ মে ১৯৮৩। ছবি: দেবীপ্রসাদ সিংহ

হবে না-ই বা কেন? অগুস্ত রঁদ্যা সেই শিল্পী, প্যারিসে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দও যাঁর স্টুডিয়োতে কাজ দেখতে যান। স্টুডিয়োটি প্রায় আন্তর্জাতিক মজলিশ। বদলেয়ারের পাশাপাশি আড্ডা দিতে আসেন রিলকে, ছাঁচ তৈরি হয় জর্জ বার্নার্ড শ-এর মুখের। প্যারিসে তখন বালজাকের মূর্তি নেই, ফরাসি ঔপন্যাসিক এমিল জোলা লেখক-শিল্পী সংঘের থেকে রদ্যাঁকে প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পরে ১৮৯৮ সালে প্যারিস সেই মূর্তি দেখে ছিছিক্কারে ফেটে পড়ে। রিলকে অবশ্য লেখেন অন্য কথা। ‘এই বালজাক-শরীর থেকে ঠিকঠাক ফুটে বেরোচ্ছে সৃষ্টির ঔদ্ধত্য, মদমত্ততা।’

এই সত্যদৃষ্টির মধ্যেই কি ছিল না প্যাশনাতুর চুম্বন? সিনেমাটা শুরু হয়েছিল চল্লিশ বছর বয়সে রদ্যাঁ যখন প্রথম ভাস্কর্যের বরাত পেলেন, সেই সময় থেকে। দান্তের ‘দিভাইনা কম্মেদিয়া’র আদলে তৈরি করছেন নরকের গেট, সেখানেই তো ওই চুম্বন-ভাস্কর্য। তাঁর কবিতায় নরকের দ্বিতীয় স্তরে পাওলো আর ফ্রান্সেসকা… দুই প্রেমিকপ্রেমিকার দুই ছায়াশরীর দেখেছিলেন দান্তে। ফ্রান্সেসকা বিয়ে করেছিল পাওলোর খঞ্জ দাদাকে, কিন্তু শেষ অবধি দেওরের সঙ্গে প্রেম। বড়সড় নরকের গেট তৈরি হবে, সেই প্যানেলে থাকবে এই দুই প্রেমিকপ্রেমিকা। রদ্যাঁ সেখান থেকেই খুঁজে পাবেন নিজস্ব স্টাইল। বড় প্যানেলের মাঝখানের একটা ভাস্কর্য নিয়ে ক্রমে তাকেই বাড়িয়ে, স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। এই নরকের গেটে তো থাকবেন দান্তের মতো কবিও। তিনিই নগ্ন অবস্থায়, হাতে চিবুক রেখে দেখবেন সবাইকে। নরকদর্শনের ওই কবিকেই পরে আলাদা ছাঁচে ঢেলে রদ্যাঁ তৈরি করবেন ‘থিঙ্কার’।

সিনেমাতে রদ্যাঁ বলেন, ‘মিকেলাঞ্জেলো আর দান্তে, এই দু’জন বারংবার টানেন আমাকে।’ মিকেলাঞ্জেলোর ভাস্কর্যে যদি অতিকায়, দৃঢ়, নিটোল শরীর, রদ্যাঁ নিয়ে আসেন অন্তরের শরীরকে। এক বন্ধু তাঁকে বলেছেন, ভিক্টর হুগো-র একটি আবক্ষমূর্তি তৈরি করতে। হুগো পোজ দেবেন না, কিন্তু রদ্যাঁকে তিনি বাড়িতে ডেকে নিলেন। হুগো যখন ঘুমিয়ে, হাতে এবং সিগারেটের কাগজে তাঁর মাথার স্কেচ এঁকে নেন রদ্যাঁ। তার পর সেই স্মৃতি সম্বল করে ছেনি, বাটালি নিয়ে বসেন টার্নটেবল-এ। স্মৃতি থেকে এঁকে পরে ভাস্কর্য— রঁদ্যাই পথিকৃৎ!

১৯৮৩ সালের ওই প্রদর্শনীর সময় এই কাগজে সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, ‘পুতুল এবং ভাস্কর্যের মধ্যে আকাশপাতাল তফাত। কোনও দুর্জ্ঞেয় কারণে এই শহরের প্রায় সব মূর্তির দায়িত্ব অর্পিত হইতেছে কৃষ্ণনগর-কুমারটুলি ঘরানার অনুসারী ভাস্করদের উপর।’ তখন পরমা আইল্যান্ড ছিল না, শানু লাহিড়ির টেরাকোটা হটিয়ে দিয়ে সারা বাইপাস ভরে যায়নি বিশাল এক ‘ব’-এ। কোন মূর্তি কোথায়, কোন পেডেস্টালে বসাবেন, সেটাও তো শিখিয়ে গিয়েছেন রদ্যাঁ। থিঙ্কার-এর পাদমঞ্চটি বেশ উঁচু, ‘বার্জারস অব ক্যালে’-রটি দর্শকের চোখের লেভেলে। দেশ বাঁচাতে এগিয়ে যাচ্ছে যারা, তারা অতিমানব নয়, সাধারণ মানুষের সমান উচ্চতায় থাকবে, শিখিয়ে গিয়েছেন রদ্যাঁ।

শিখিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু শেখে কে? ফেস্টিভাল উপলক্ষে নন্দনচত্বর বেশ সুসজ্জিত, কিন্তু কয়েক পা এগিয়ে বিড়লা তারামণ্ডলের উল্টো দিকে সেই কৃষ্ণনগর! ২১ ফেব্রুয়ারির মূর্তি। এক মা তাঁর কোলে পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়া ছেলেকে নিয়ে। মৃত ছেলেকে কোলে নিয়েও যে কোনও মা এত শান্ত দৃষ্টিতে তাকাতে পারেন! তথ্যকেন্দ্র থেকে শিশির মঞ্চ, নন্দন, রবীন্দ্রসদন— এতটুকু জায়গায় আটটা কালো মার্বেল ফলক সাদা অক্ষরে একই কথা বলে যায়, ‘মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায়…’ বারংবার এক কথা বলার থেকে একটা ভাস্কর্য বা ইনস্টলেশন আর্ট বসিয়ে রাখলে বিষয়টা সুদৃশ্য হত।

এত ভিড়, এত রদ্যাঁ আর এত আর্ট শো নিয়েও কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন