ভবিষ্যতের মিডিয়া
সাংবাদিকতার ছাত্রছাত্রীরা এখনও মুদ্রণ যন্ত্রের ইতিহাস পড়ে থাকে। সিলেবাসে এখনও এটি অবশ্যপাঠ্য। এক অধ্যাপক সে দিন বলছিলেন, ডিজিটাল মিডিয়া এখন ভবিষ্যৎ। তাই এই ডিজিটাল জগতটিকেও ছাত্রদের জানতে হবে। কিন্তু তা বলে ইতিহাস বিস্মৃত হলেও চলবে না।
কিন্তু যে গতিতে মিডিয়ার পরিবর্তন গোটা বিশ্বে, এমনকী, ভারতেও পরিলক্ষিত হচ্ছে তা অনুধাবন করাও বিশেষ জরুরি হয়ে পড়েছে। বলা হচ্ছে, ডিজিটাল প্রযুক্তি অদূর ভবিষ্যতে প্রচারমাধ্যমে এক বিপ্লব আনবে। এত অগুন্তি চ্যানেল, টিভি চ্যানেল শুধু নয়, এ বার আসবে ওয়েব-চ্যানেল। তাতে উপভোক্তাদের পছন্দের বৈচিত্র্য আরও বাড়বে। বাড়তেই থাকবে। বিবিসি-র পাবলিক পলিসি রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ‘টুয়ার্ডস আ ব্রডকাস্টিং ইন্ডাস্ট্রি দ্যাট ইজ নট কম্পিটিটিভ, বাট হোয়্যার অডিয়েন্সেস আর ফ্র্যাগমেন্টেড অ্যান্ড ইয়েট ওনারশিপ ইজ কনসেন্ট্রেটেড’।
এর কারণ?
উচ্চমানের মাল্টিমিডিয়া বিষয়বস্তু উৎপাদন করার খরচ অনেক বেশি, কিন্তু সম্পাদনা করার কাজ সস্তা। সুতরাং ‘হাই ফিক্সড কস্টস’ আর ‘লো মার্জিনাল কস্টস’— এটাই একচেটিয়া পুঁজি-ব্যবসার স্বাভাবিক জন্মদাতা। কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন সেন্টারের ফেলো সোহেল ইনায়াতুল্লা বলছেন, ছাপা খবরের কাগজ কিছু দিনের মধ্যেই বাজার থেকে হাওয়া হয়ে যাবে। সকালে টিভির পর্দায় অথবা মোবাইল বা ল্যাপটপের পর্দায় খবর পড়বে গোটা দুনিয়া। চলচ্চিত্রের অভিনেতারা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত হবে। আর চলচ্চিত্র আমরা নেটে দেখব এবং এগুলি উপভোক্তা নিজেরাই প্রয়োজনে পরিবর্তন করতে পারে। আবার সম্পাদনার কাজও করতে পারা যাবে। কাজেই প্রাকৃতিক নয়, ভার্চুয়াল মিডিয়াই হয়ে উঠবে বাস্তব। মানুষের অন্তর ও বাহ্যসত্তার সম্পর্কও এই ভার্চুয়াল মিডিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। সব কিছুই আমরা চটজলদি পাব, হয়তো এ হেন দ্রুতগামিতা ক্ষিপ্রতায় আমরা তখন ‘বোর’ হয়ে যাব। সোহেল ইনায়াতুল্লার কথা শুনলে আমরা যারা পুরনো ‘প্রিন্টের লোক’, আমাদের ভয় করে, মন খারাপ হয়, কিন্তু সত্য সে কঠিন কিন্তু সে কখনও করে না বঞ্চনা। ডাকঘর তো একদা ছিল এক মস্ত বড় যোগাযোগ ব্যবস্থা। ডাকব্যবস্থা কিন্তু আজ কার্যত ইতিহাস।
ইতিহাসের গুরুত্ব থাকবে না? থাকবে নিশ্চয়। কিন্তু সোহেল ইনায়াতুল্লা বলছেন, সব তথ্য খুব তাড়াতাড়ি পাব, স্মৃতি বা মেমরি বলে তখন কিছু থাকবে না, সব স্মৃতিই তো বর্তমান তথ্য। সোহালের ভাষায়: ‘দ্য ফিউচার উইল বিকাম ডিলিঙ্কড ফ্রম হিস্ট্রি, সিন্স অল হিস্ট্রি উইল বি আ কমোডিটি ইজিলি অ্যাভেইলেবল।’
ভবিষ্যৎকে ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া সম্ভব হবে। সব ইতিহাসই তো গুগল আর ইন্টারনেটের দৌলতে আপনার সামনে। ইউটিউবে যান, মহেঞ্জদড়ো দেখার পাক অনুমতি না পেলেও সেখানে বিশদ তথ্য ও ছবি-সহ আপনি দেখতে পাচ্ছেন।
তার মানে কি আমরা পড়া এবং লেখাই বন্ধ করে দেব? তা নয়। তবে ‘স্পিড ভিউ’ শিখতে হবে আমাদের, জটিল জটিল ভাবনা ছবি-গ্রাফিক্স এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে শিখতে হবে। যেমন, দ্রুততার সঙ্গে কী করে পড়তে হয় এই ‘স্পিড রিড’ আমরা আজকাল অনেকটাই শিখেছি। হনলুলুর মানোয়ায় হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফিউচার স্টাডিজ’-এর অধ্যাপক জিম ডাটোর বলছেন, আসলে একবিংশ শতাব্দীর সংযোগ প্রযুক্তির প্রধান শক্তি ইলেকট্রনিক নয়, সেই শক্তি হল বায়োলজিক্যাল বা ‘জৈব’, ডিএনএ হল আসল তথ্যের উৎস। ডিএনএ-তে পরিবর্তন এনে আমরা ইলেকট্রনিকের চেয়েও অনেক কর্মক্ষম শক্তিশালী সংযোগ ক্ষমতা অর্জন করব। প্রজাতির ডিএনএ-তে বদল এনে জৈবশক্তির পরিবর্তন ঘটাবে মানুষ।
ভবিষ্যতের মিডিয়া মানবসমাজে এক জন আর এক জনের মধ্যে গভীর সংবেদনশীল সম্পর্ক গড়ে তুলবে। বিচ্ছিন্নতাকে বাড়াবে না। অন্যদের জানার পদ্ধতিও আমরা জানব, নানা ধরনের সংস্কৃতি বুঝব, তার গভীরে গিয়ে যাকে বলা হয় ‘মাল্টিকালচারালিজম’।
আমাদের তাই ভবিষ্যতের মিডিয়া সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। শেষের কবিতায় অমিত রায় বলেছিলেন যে সম্ভবপরের জন্য প্রস্তুত থাকাই সভ্যতা। না থাকা বর্বরতা।