সৌদিতে নাকি আসছে উদার অর্থনীতি আর নতুন মেগাসিটি

বদল: না চাইলেও হবে

বিন সলমন বিলক্ষণ বুঝেছেন যে, দেশটাকে কেবলমাত্র তেল আর কট্টর নিয়ম-নির্ভর করে রাখলে চলবে না। ফাঁকফোকর দিয়ে অন্য বিশ্বের হাওয়া বইতে দিতে হবে।

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share:

ভবিষ্যৎস্রষ্টা?: ‘ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ’ সম্মেলন। বিশ্ব অর্থনীতির কর্ণধারদের সঙ্গে মহম্মদ বিন সলমন। রিয়াধ, অক্টোবর ’১৭। ছবি: রয়টার্স

সম্প্রতি সৌদি আরবে মেয়েরা গাড়ি চালানোর অনুমতি পেয়েছে।— ছোঃ!!! এ নিয়ে এত নাচানাচি করার কী হয়েছে? কিন্তু সৌদির মেয়েরা বলছে: মা ভৈঃ! এই ছোঃ আর মা ভৈঃ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে বেশ কিছু দিন। কিন্তু এ তর্কে ঢোকার আগে বুঝতে হবে, দেশটার নাম সৌদি আরব, যেখানে বোরখা তো আছেই, আছে নীতি-পুলিশ— যারা কিনা গোটা সমাজকে রক্তচক্ষু নিয়ে ঘুরে ঘুরে জরিপ করে, খবরদারি করে, ক্ষমতা দেখায় কারণে ও অকারণে। যে দেশে বাড়ির বৃদ্ধ দাদামশায়ের কথাই নিয়তি, মেয়েদের পুরুষ ছাড়া রাস্তায় বেরোনোর নিয়ম নেই। যে দেশে নিজের ইচ্ছেকে কড়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে নোনতা জল নিয়মিত চেটে নিতে হয়, সেখানে একটি গাড়িকে নিজের ইচ্ছে মতো স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে চালনা করা একটা ঐতিহাসিক ব্যাপার তো বটেই। গাড়ির স্টিয়ারিং থেকে জীবনের স্টিয়ারিং অবধি পৌঁছনো যেতে পারে কোনও এক দিন। পথ লম্বা, বাধা বিস্তর, চেতাবনি পদে পদে, মরুভূমির তাপের মতোই সমাজের তাত পৌঁছবে বোরখার ভেতরের আত্মা অবধি। তবু চেষ্টা।

Advertisement

আর এ চেষ্টা সম্ভব করেছেন যিনি, তিনি এখন দেশের যুবরাজ— মহম্মদ বিন সলমন। তাঁর ইচ্ছে দেশটা নতুন একটা দিশা মেনে এগিয়ে যাক। তাঁর পরিকল্পনা ‘ভিশন ২০৩০’— সৌদি আরবকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে এক নতুন দেশে পরিণত করবে বা অন্তত শুরুয়াত করবে নতুন পথে চলার। সেই নতুন যাত্রাপথের নীল-নকশা তৈরি হয়ে গিয়েছে। এ বার নাকি সেই নকশা রূপায়ণের পালা।

বিন সলমন বিলক্ষণ বুঝেছেন যে, দেশটাকে কেবলমাত্র তেল আর কট্টর নিয়ম-নির্ভর করে রাখলে চলবে না। ফাঁকফোকর দিয়ে অন্য বিশ্বের হাওয়া বইতে দিতে হবে। তবেই সৌদি আরব নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে আরও বহু শতাব্দী। আসলে, খনিজ তেল, যা তাদের একমাত্র ফিক্সড ডিপোজিট, যা দিয়ে তারা এত দিন আমেরিকার মতো দেশকেও বাগে রেখেছিল, সেই তেল এক দিন ফুরিয়ে যাবে। তখন কী হবে? তাই এখন থেকে শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। আর সেই হাল চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে মজবুত অর্থনীতি।

Advertisement

অর্থনীতি উন্নত করতে হলে কী চাই? বিদেশি বিনিয়োগ। বিদেশি বিনিয়োগ আনতে গেলে চাই— খোলামেলা পরিবেশ, বাকি বিশ্বের সঙ্গে তালমেল রাখতে পারবে এমন একটা সমাজ। আর সেই সমাজ তৈরির প্রথম ধাপ— একটি মেগাসিটি তৈরি হতে চলেছে সৌদি আরবে। ২৬,৫০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে, মিশর আর জর্ডন অবধি বিস্তৃত। সেখানে থাকবে না শরিয়া আইন, কর্তৃত্ব থাকবে সৌদি আরবের এক্তিয়ারে। থাকবে আধুনিক পরিকাঠামো, খোলামেলা পরিবেশ, বিনোদনের সম্ভার, প্রকাশ্যে পুরুষ-নারীর মেশামেশার অধিকার, এমনকী এক সঙ্গে সমুদ্রস্নানও হয়তো সারা যাবে। এক কথায় পৃথিবীর উন্নত দেশের যে কোনও একটি ঝাঁ-চকচকে শহরের মতোই একটা শহর, যেখানে বিনিয়োগ আসতে পারে অবাধে।

যুবরাজ সলমন বলেছেন, তিনি চান দেশকে বছর চল্লিশ আগের সৌদি আরবের মতো ফের গড়ে নিতে। যেখানে ইসলামের মধ্যপন্থা অবলম্বন করে একটি দেশ বেশ সুন্দর চলত। পুরনোর সঙ্গে নতুনের একটা মিলমিশ ছিল, কেবল চোখরাঙানি নয়। ১৯৭৯ সালে ইরানের অভ্যুত্থানের পরে পশ্চিম এশিয়ায় অনেক দেশই কট্টর নিয়ম চালু করেছিল। যুবরাজ বুঝেছেন এতটা কট্টরপন্থার বিপদ। তাই বলেছেন, ‘ইরানের পথটা আমরা গ্রহণ করেছিলাম, কিন্তু সেই পন্থাটাকে কী ভাবে সামলাব বুঝতে পারিনি।’ তাই কট্টর পন্থাটা থেকে গিয়েছে, দেশটা তত এগোয়নি। এই ভুল তিনি শুধরে নিতে চান।

তাঁর ওপর চাপ আছে। তারুণ্যের চাপ। দেশের প্রায় অর্ধেক নাগরিকের বয়স ত্রিশের আশেপাশে। তারা বাকি বিশ্বের খবর রাখে। তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করেছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে দেশের দৃষ্টিভঙ্গির বিরাট তফাত হয়ে যাচ্ছে। তরুণদের সঙ্গে সরকার সংযোগ করতে না পারলে, তাদের চাহিদা বুঝতে না পারলে, দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে না, টের পেয়েছেন যুবরাজ সলমন। তাই তিনি বদলে আগ্রহী।

অবশ্য ভবিষ্যৎস্রষ্টার এই তড়িঘড়ি দিনবদলের প্রতিশ্রুতির একটি সম্ভাব্য কারণ এ-ও হতে পারে যে, আমেরিকা নিজের ‘শেল-ওয়েল’-এর সম্ভার আবিষ্কার করে ফেলেছে। তাই ট্রাম্প তাঁর মঙ্গলহস্তটি সৌদি আরবের ওপর থেকে সরিয়ে নিয়েছেন হয়তো, আর তাই সৌদি আরব এখন ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ঝুলছে। কিংবা যে কথা প্রচলিত— বিশ্ব জুড়ে জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার পিছনে মূল হাত সৌদি আরবের। এ দেশের টাকায় চলে জঙ্গিবাদের অফিস। হয়তো জঙ্গিবাদ পুষে আর তেমন লাভ হচ্ছে না, উলটে ক্ষতিই হচ্ছে সৌদি আরবের— এমন সত্য উপলব্ধি করেছেন যুবরাজ। বিশেষ করে কাতার আর ইয়েমেন-এর যুদ্ধের শোচনীয় পরিণতির পরে।

নিন্দুকেরা অবশ্য অন্য কথা বলছেন। যুবরাজ সলমনের পরিকল্পনা বিরাট, বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞরা এসে না হয় ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করে দিয়েছেন, কিন্তু তা সফল ভাবে প্রয়োগ করতে পারবেন কি যুবরাজ? দেশের এক বিরাট অংশের কট্টরপন্থীদের চটিয়ে নতুন হাওয়া বইয়ে দেওয়া তো সহজ কথা নয়। সেই কারণেই হয়তো তিনি দেশের একটি নির্দিষ্ট স্থানকে দ্বীপের মতো আলাদা করে নিয়ে সেখানে উন্নয়নের পরিকাঠামো গড়ে দেবেন, সামাজিক ভোলবদল কিংবা রাজনৈতিক উদারতা দেখাবেন। কিন্তু বাকি দেশ? সেখানেও কি একই হাওয়া চলবে— না কি হাওয়ার মুখ বাকিদের ক্ষেত্রে ঘুরিয়ে দেওয়া হবে? হতেই পারে। চিনই তার বড় উদাহরণ। চিনের কিছু এলাকা যত উন্নত এবং আধুনিক, বাকি দেশটা তার ধারেকাছেও নয়। কমিউনিস্ট পার্টির ঘোর কব্জায় টুঁ শব্দটি করার উপায় নেই। তাই অর্থনীতি বদল করতে হলে যে বাকি দেশের সমাজ-রাজনীতিকে বদল করতে হবে, এমনটা না-ই হতে পারে।

কেউ কেউ তো এ কথাও বলছেন, নতুন শহরের নকশা, বড় বড় পরিকল্পনা— পুরোটাই লোক-দেখানো। ইয়েমেন আর কাতারের সঙ্গে যুদ্ধে নিজের ভাবমূর্তি খুইয়ে এখন তা মেরামতির চেষ্টা যুবরাজের। আসল সৌদি থাকবে সৌদিতেই। কিন্তু পুরোটাই থাকবে কি? যদি এই ‘ভিশন ২০৩০’ আংশিক সাফল্যও পায়, তা হলে তার টানেই সমাজে একটা খোলা হাওয়া ঢুকতে বাধ্য। তখন হয়তো ‘ভিশন ২০৩০’-এর পূর্ণ সাফল্যের যেটুকু বাকি থাকবে, সেটা হাসিল করে দেবে যুবসমাজ। তাদের তরুণ রক্ত গ্রহণ করবে বহির্বিশ্বের নতুনত্ব। সেই নতুনত্ব সংক্রামক, রোখা মুশকিল। তার ওপর তাতে যদি থাকে সমাজ বদলের হাতছানি !

যেমনটা হয়েছে ইরানে। কট্টরবাদীদের সমস্ত প্রতিরোধ জয় করে হাসান রুহানিকে প্রেসিডেন্টের পদে ফিরিয়ে আনলেন ইরানের উদারপন্থীরা। কিন্তু রুহানি ফিরে এলেও, তাঁর মন্ত্রিসভায় মহিলা মন্ত্রীর সংখ্যা ছিল তিন। তা-ও তেমন বড় পদে নয়। ইরানের মেয়েরা এমন আন্দোলন করলেন, সেই আন্দোলনের চাপে প্রধানমন্ত্রী রুহানিকে তাঁর মন্ত্রিসভায় মহিলা মন্ত্রীর সংখ্যা বাড়াতে হল। এবং উল্লেখযোগ্য পদে।

সৌদি আরবে মেয়েদের গাড়ি চালানোর অনুমতি পাওয়া তাই কম কিছু নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন