‘মূল’ শিক্ষাধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ওদেরও

আদিবাসী ছেলেমেয়ে তার নিজের ঘর-পরিবেশে যে ভাষায় অভ্যস্ত, স্কুলে এসে তাকে প্রথমেই এই ধাক্কাটা পেতে হয় যে, তার ভাষা এখানে কেউ বোঝে না, জানে না। উপরন্তু জানা বোঝার চেষ্টাও করে না। প্রাথমিক স্তর থেকেই তাই এরা সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় খানিকটা অপাংক্তেয় হয়ে থাকে। লিখছেন মণীষা বন্দ্যোপাধ্যায়।বাস্তব এটাই, নবম  শ্রেণিতে এই ছেলেমেয়েদের আটকে দিলে অচিরেই পড়ুয়াদের একটা বড় অংশ স্কুলছুট হয়ে পড়বে। ভারত সরকারের মানবসম্পদ বিকাশ মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ক্লাস নাইনের পরে স্কুলছুটের প্রবণতা জনজাতি গোষ্ঠীতে বিপজ্জনক স্তরে, প্রায় ৭৪%।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:০১
Share:

বিদ্যালয়ে চলছে পড়াশোনা। নিজস্ব চিত্র

হাইস্কুলে বার্ষিক রেজাল্টের দিনটা অপেক্ষাকৃত কম মন খারাপের। উচ্চ প্রাথমিক স্তরে ফেল প্রথা এখনও জাঁকিয়ে বসেনি যে! তাই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নিরুদ্বেগ পড়ুয়ারা। টানাপড়েনে শুধু নবম শ্রেণি। আর সেখানে প্রতিবারই দেখা যায় বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী পাশ করতে পারেনি। শিক্ষিকা হিসাবে নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, অবস্থা এমনই যে দশম শ্রেণিতে টেনেটুনে তুলে দেওয়া গেলেও মাধ্যমিক পরীক্ষায় এরা উত্তীর্ণ হতে পারবে না। সমস্যা এই যে, বছর খানেক রেখে দিলেও তারা যে পাশের যোগ্য হবে, এমন সম্ভাবনা কম। এদের মধ্যে সহজেই চিহ্নিত করা যায় জনজাতি গোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের একটা বড় অংশকে, যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়। খাতাপত্র উল্টোলে দেখা যাবে, গোটা শিক্ষাবর্ষে এদের উপস্থিতির হারও তেমন ভাল নয়। যদি এদের মনের কথা কেউ জানতে চায়, তা হলে বোঝা যাবে, এই গোটা বিদ্যালয় ব্যবস্থার সঙ্গে তেমন কোনও সখ্য তাদের গড়ে ওঠেনি। যদিও ভর্তির সময় তাদের এবং পরিবারের উৎসাহে কোনও খামতি ছিল না।

Advertisement

বাস্তব এটাই, নবম শ্রেণিতে এই ছেলেমেয়েদের আটকে দিলে অচিরেই পড়ুয়াদের একটা বড় অংশ স্কুলছুট হয়ে পড়বে। ভারত সরকারের মানবসম্পদ বিকাশ মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ক্লাস নাইনের পরে স্কুলছুটের প্রবণতা জনজাতি গোষ্ঠীতে বিপজ্জনক স্তরে, প্রায় ৭৪%। জনজাতির মধ্যে স্কুলছুট বাড়ছে বলে রিপোর্টে জানিয়েছে রাজ্য সর্বশিক্ষা মিশনও। এর অবশ্যম্ভাবী ফল শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, কম বয়সে মা হওয়া ইত্যাদি এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের ‘নির্ণায়ক’ ভূমিকায় চূড়ান্ত অনুপস্থিতি।সকলের জন্য শিক্ষা—এই মহৎ প্রতিশ্রুতির অন্যতম প্রধান বাধা স্কুলছুটের প্রবণতা। স্কুলের পরিকাঠামো আগের চেয়ে উন্নত। কেন্দ্র ও রাজ্যের অনেক প্রকল্প রয়েছে স্কুলপড়ুয়াদের জন্য। সাইকেল থেকে কন্যাশ্রী, ব্যাগ থেকে জুতো—পড়াশোনার সঙ্গে জুড়েছে এই সব আবশ্যিক উপাদান। তবু কোথাও যেন একটা মস্ত ফাঁক। শিক্ষায় ‘মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ’ ইত্যাদি সুবচনের পরেও ভারতের মতো বহু-ভাষিক দেশে এমনকি প্রাথমিক স্তরেও সকলের জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। আদিবাসী ছেলেমেয়ে তার নিজের ঘর-পরিবেশে যে ভাষায় অভ্যস্ত, স্কুলে এসে তাকে প্রথমেই এই ধাক্কাটা পেতে হয় যে, তার ভাষা এখানে কেউ বোঝে না, জানে না। উপরন্তু জানা বোঝার চেষ্টাও করে না। প্রাথমিক স্তর থেকেই তাই এরা সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় খানিকটা অপাংক্তেয় হয়ে থাকে। উচ্চ প্রাথমিকে পৌঁছে সমস্যা জটিলতর।

সাধারণভাবে স্কুলছুটের সঙ্গে আর্থিক পশ্চাৎপদতাকেই যুক্ত করা হয়। এ কথাও সত্যি যে, আমাদের দেশে জনজাতি গোষ্ঠী আর্থিক ভাবে বহুলাংশে প্রান্তবাসী। কিন্তু স্কুলছুট হওয়ার ক্ষেত্রে এটা প্রধান কারণ নয়। এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, প্রাথমিক স্তরে এ রাজ্যে ৯৪% আদিবাসী ছাত্রছাত্রী প্রাথমিকে ভর্তি হচ্ছে। এদেরই বিরাট অংশ নবম শ্রেণিতে গিয়ে স্কুলছুট হয়ে যায়। এই সমস্যা নিয়ে এগোতে গেলে এটা ভাবা যায় যে, শিক্ষার অধিকার বিনা ব্যয়ে বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ, মধ্যাহ্নকালীন আহার (মিড-ডে মিল) প্রকল্প, সাইকেল এবং অন্যান্য অনুদানেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। এর আবশ্যিক উদ্দেশ্য, প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে একটি নির্দিষ্ট গুণগত মানে পৌঁছনো। এই গুণগত মানের কথা ভেবেই কিন্তু পাশফেল প্রথা ফিরিয়ে আনার কথা ভাবা হচ্ছে। যদিও পরিসংখ্যান ইঙ্গিত করছে, পাশফেল ফেরত এলে নবম শ্রেণির অনেক আগেই অনেক ছেলেমেয়ে স্কুলছুট হবে।

Advertisement

তা হলে উদ্যোগ এমনটি হওয়া উচিত, যাতে আদিবাসী ছাত্রছাত্রীরা ‘মূল’ শিক্ষা ধারার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে সহজেই। মনে রাখতে হবে, ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতি ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত। পাঠ্যক্রমে সেই সংস্কৃতির উপযুক্ত উপস্থিতির প্রয়োজন। তথাকথিত মূল ধারাকেও এই সাংস্কৃতিক বিনিময়ে আসতে হবে। যে সমীক্ষার কথা আগে বলেছিল, তাতে উঠে আসছে যে, এ দেশের ভাষাগত, সংস্কৃতিগত ও সামাজিক বৈচিত্র্যে আদিবাসীদের বিপুল অবদান সত্ত্বেও তাঁদের সম্পর্কে বাকিদের ধারণা স্পষ্ট নয়। পশ্চিমবঙ্গে আদিবাসী মানে ধরে নেওয়া হয় সাঁওতাল, কিন্তু নথিভুক্ত আদিবাসী গোষ্ঠীর সংখ্যা চল্লিশটি। পাঠ্যক্রমে এঁদের কথা কতটুকু আছে? ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের, এমনকি বিদেশি লেখকের লেখাও অনুবাদে পাঠ্যবইয়ে আছে, কত জন আদিবাসী লেখকের লেখা আছে? এঁদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে যা শেখার, তার প্রতিফলন কি বইয়ে পাওয়া গেল?

একদল ভাবছেন, অলচিকি লিপিতে প্রাথমিকে সাঁওতালি ভাষার পাঠ দিলে কিছু উপকার হবে। সে ক্ষেত্রে কিন্তু একটি শিশুর পরবর্তী স্তরে বাংলা ভাষা শেখার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হতে পারে। সে যদি তার ভাষার লিখিত প্রকাশে বাংলা লিপি ব্যবহার করে, তা হলে বাংলা হরফের উচ্চারণ ও লিখিত রূপের সঙ্গে তার শুরুতেই পরিচয় হয়ে যায়, যা পরবর্তীতে বাংলা ভাষা আয়ত্তের ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। পাশাপাশি প্রাথমিক স্তরে শিক্ষক বা শিক্ষিকা যদি ছাত্রছাত্রীর মাতৃভাষা সম্পর্কে আগ্রহী থাকেন, তা হলে একটা সেতু তৈরি করা যায়। এ ছাড়া কিছু বইপত্র ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ, যেগুলোর দ্বারা এই ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসরুমের পঠনপাঠনে সক্রিয় যোগ দিতে পারে, তার বিশদ চর্চা প্রয়োজন। বীরভূম জেলায় একটি সংগঠন এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করে চলেছে। আদিবাসীর সমাজের যে শিক্ষিত যুবা অংশ, তাঁদেরও এই কাজে পাওয়া যেতে পারে। জনজাতি গোষ্ঠীকে সরকারি উদ্যোগে নিষ্ক্রিয় গ্রহীতা হিসেবে না দেখে তাদের পরিকল্পনা ও প্রয়োগের প্রতিটি স্তরে সম্মানের সঙ্গে যুক্ত করা প্রয়োজন। মুশকিল একটাই, যে মস্তকগুলি শিক্ষার রূপরেখা তৈরি করেন, সেখানেই যে ফণীর দংশন! দংশনের বিষ নেমে আসে এক বহু বিভাজক শিক্ষা নীতি রূপে।

(লেখিকা স্কুল শিক্ষিকা ও সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন