গত কাল আলোচনা করেছিলাম বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের সূচনার কথা (‘ভিক্ষা নয়, স্বাস্থ্য হল অধিকার’, ১৮-১২)। সেই প্রসঙ্গ টেনেই বলি ছত্তীসগঢ়ে সে সময়ে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। শঙ্কর গুহনিয়োগী নামে শ্রমিক আন্দোলনের এক নেতা নজর দিলেন শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে, গড়ে তুললেন তাঁদের জন্য হাসপাতাল, যেখানে কম খরচে বা বিনা খরচে চিকিৎসা করা সম্ভব। সেই উদ্যোগে শামিল হলেন এ রাজ্যের বেশ কিছু নবীন দায়বদ্ধ চিকিৎসক। তাঁদের মধ্যে ছিলেন পুণ্যব্রত গুণের মতো মানুষ। পরবর্তী কালে শঙ্কর গুহনিয়োগী খুন হয়ে গেলেও তাঁর ভাবনা কিন্তু বেঁচে থাকে। শঙ্কর গুহনিয়োগীর আদর্শকে রূপায়িত করতে সবার জন্য স্বাস্থ্যের নতুন উদ্যোগ করা হয় এ রাজ্যে। জন্ম হয় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের (১৯৯৯), গড়ে ওঠে সবার জন্য স্বাস্থ্য আন্দোলন। আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন পুণ্যব্রত গুণ-সহ বেশ কিছু ব্যক্তিত্ব। অবশ্য এর আগেই নিয়োগীর শহিদ হাসপাতালের অনুপ্রেরণায় গড়ে উঠেছিল বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতাল (১৯৮৩), শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র (১৯৯৫)।
তবে স্বাস্থ্য মানে তো আর শুধু রোগের অনুপস্থিতি নয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞায়, স্বাস্থ্য মানে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ভাবে ভাল থাকা। তাই আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারকেও এর থেকে বাদ দিতে পারি না। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সচেতনতা গড়ে তোলার ইতিহাসটা একটু পুরনো হলেও মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারের জন্য লড়াইয়ের ইতিহাসটা কিন্তু পুরনো নয়। এই লড়াইয়ে শামিল বেশ কিছু ব্যক্তি এবং সংগঠন। পশ্চিমবঙ্গে স্বাস্থ্যের অধিকারের লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী এই ধরনের ৩৩টি সংগঠনকে নিয়ে ২০১৫ সালে গড়ে ওঠে ‘সারা বাংলা সবার জন্য স্বাস্থ্য প্রচার কমিটি’। তাদের সেই প্রয়াস দীর্ঘমেয়াদি ও ধারাবাহিক।
কিন্তু মূল বিষয় হল: রাষ্ট্রের কাছে সবার জন্য স্বাস্থ্যের যে অধিকার দাবি করা হচ্ছে, রাষ্ট্রের পক্ষে তা কি পূরণ করা সম্ভব? নাগরিকের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নেওয়া রাষ্ট্রের পক্ষে অবশ্যই সম্ভব, যেমনটা নিয়েছে নরওয়ে (১৯১২), পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯৩৭, তবে গ্রামাঞ্চলে ১৯৬৯), নিউজ়িল্যান্ড (১৯৩৮), জার্মানি (১৯৪১), ব্রিটেন (১৯৪৮), চিন (১৯৫০), কিউবা (১৯৬০), শ্রীলঙ্কা (২০০০), পেরু (২০০৯)-সহ বিভিন্ন দেশ। বিরাট জনসংখ্যার দেশ ভারতবর্ষেও এই কাজটা সম্ভব। কী ভাবে সম্ভব, সেটা শ্রীনাথ রেড্ডির নেতৃত্বে ২০১০ সালে গঠিত ভারত সরকারের উচ্চ স্তরীয় বিশেষজ্ঞ দল দেখিয়ে দিয়েছে। এই রাজ্যে স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মীরা ২০১১ সালে প্রকাশিত এই কমিটির রিপোর্টকেই হাতিয়ার করেছেন।
এখন প্রশ্ন হল, স্বাস্থ্যের কোনও উন্নতি কি গত চল্লিশ বছরে হয়নি? আমরা চোখের সামনে দেখছি রাজ্যে প্রচুর সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। বিরোধীরা যতই নীল-সাদা ভবন বলে ব্যঙ্গ করুন না কেন, স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল ফেরানোর উদ্যোগ যে করা হয়েছে তা মানতেই হবে। কিন্তু প্রশ্নটা অন্যত্র। স্বাস্থ্য পরিষেবা সরকারের আবশ্যক দায়, এটা আমরা মানছি তো? না কি ওপর ওপর কিছু সংস্কার করে মন ভোলানোর চেষ্টা করছি?
আসলে বিগত দু’দশকে শহর পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যের চেহারাটা পাল্টে গিয়েছে। মধ্যবিত্ত জনসমাজ এখন আর সরকারি হাসপাতালে যান না। গড়ে উঠেছে ছোট বড় নার্সিং হোম বা প্রাসাদোপম হেলথ হাব, এমনকী সরকারি হাসপাতালে শুরু হয়ে গিয়েছে পিপিপি মডেল অর্থাৎ পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ। স্বাস্থ্যবিমাকেন্দ্রিক বড়লোকি চিকিৎসা এ রাজ্যে কেন, সারা দেশ জুড়েই শুরু হয়েছে। তার পাশাপাশি সরাকারি হাসপাতালেও বেসরকারিকরণের নানা উদ্যোগ হাজির। একই হাসপাতালে বিকেলবেলা দেখালে ফি দিতে হয়, হাসপাতালের মধ্যেই এক্স-রে করালে বেশি টাকা দিতে হয়। এই সব প্রক্রিয়া এই আমলের আগেই হয়তো শুরু হয়েছে। আসলে ব্যাপারটা কোনও রাজনৈতিক আমলের নয়। গোটা দেশ জুড়ে এই প্রবণতাটা বাড়ছে, যার মূল কথা, স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য মূল্য দিতে হবে বা টাকা গুনতে হবে। স্বাস্থ্য আন্দোলন কিন্তু ঠিক এর উল্টো কথাটাই বলে; স্বাস্থ্য মানুষের অধিকার। শুধু প্রাসাদোপম হাসপাতাল তৈরি বা চিকিৎসকদের হয়রানি করা অথবা প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকার মতো বিষয়ের বাইরে আরও বড় করে বিষয়টা ভাবা দরকার। সেই ভাবনার ইতিহাসটা জানা দরকার। আর সেই জন্যই দরকার আমাদের স্বাস্থ্য আন্দোলনের ইতিহাস অনুসন্ধান, যে আন্দোলন শিখিয়েছে স্বাস্থ্য পরিষেবা কোনও ভিক্ষা নয়, বরং মানুষের অধিকার। (শেষ)
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক ও গবেষক
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।