—ফাইল চিত্র।
সে এক সময় ছিল। গাঁ-গঞ্জে যাঁর
দু’-দশ বিঘে জমি থাকত, তাঁকে লোকজন সমীহ করত। আর সেই পরিবারের কেউ চাকরি করতে যাবে শুনলে বাড়ির কর্তা গোসা করতেন। যিনি চাকরি করতে চাইতেন তাঁরও সাহস হত না বাড়ির কর্তার সামনে গিয়ে কথাটা বলার। তাই সে ভার নিতে হত বাড়ির কর্ত্রীকেই। দুপুরের খাওয়ার পরে কর্তা তামাক ধরাতেন। তাঁর হাতে একটা পান ধরিয়ে কথাটা তুলতেন কর্ত্রী, ‘‘খোকা তো চাকরি করতে চাইছে। কী বলব?’’ রাগে ফেটে পড়েতেন কর্তা, ‘‘এত বড় সাহস তার হয় কী করে! এ সব জমি-জিরেত কে দেখবে? চাকরি করে ক’টা টাকা পাবে শুনি। জমিতে সোনা ফলে। দেখেশুনে নিতে পারলে ওর চোদ্দো পুরুষ বসে খাবে।’’ খোকার আর চাকরি করা হত না। শেষতক হাল ধরে চাষির ব্যাটা খেতেই যেত সোনা ফলাতে। কর্তার কথায় কোনও ভুল ছিল না। জমিতে তখন সত্যিই সোনা ফলত! এত দূষণ, এত রাসায়নিক সার, এত কীটনাশকের ব্যবহার তখন হত না। ফলনও হত ভালই। পাড়ার মাচায় হুঁকো হাতে বাড়ির কর্তা বলতেন, ‘‘বাপ-ঠাকুর্দার আশীর্বাদে জমি থেকে যা পাই, তাতে অন্তত ভাত-কাপড়ের অভাব হয় না।’’
কিন্তু সময় বদলে গেল। আবাদি জমি থাকলেও সেখানে চাষি আর সে ভাবে সোনা ফলাতে পারছেন না। যেটুকু ফলন হচ্ছে তার দাম নেই। সে দিনের সম্পন্ন চাষির ছেলে এখন চাকরি খুঁজে বেড়ান। না পেলে অন্য পেশা বেছে নেন। কেউ কেউ ভিন্রাজ্যে কাজে যান। তাঁকে বা তাঁদের যেতে বাধ্য করে পরিবার। সে দিনের খোকা এখন বাড়ির কর্তা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনিই বলেন, ‘‘জমি থেকে কিস্যু হওয়ার নেই রে বাপ! বাইরে গেলে তা-ও দু’পয়সা রোজগার করতে পারবি।’’ কৃষ্ণনগর, বহরমপুর, শিয়ালদহ বা হাওড়া স্টেশনে ব্যাগ কাঁধে করে বাইরে কাজে যাওয়া ছেলেদের এক বার জিজ্ঞাসা করুন, ‘‘আপনাদের বাপ-ঠাকুর্দা কী করতেন?’’ অনেকেই বিরক্ত হয়ে উত্তর দেবেন, ‘‘কী আবার, আবাদ করত!’’
সেই আবাদের হরেক গেরো। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গিয়েছে। ভাগ হয়ে গিয়েছে জমি। সেই সামান্য জমিতেই চক্রাকারে ফলে ধান, পাট, সর্ষে। একটার লোকসানের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে ফের চাষ হয়। ফের ঋণ হয়। এবং ফের মেলে না ফসলের ন্যায্য দাম। মহাজনের ধারের বহরে এক দিন জমির পাট জমিতেই বিক্রি করে দিতে হয় অত্যন্ত কম দামে। কখনও বন্ধক রাখতে হয় গিন্নির গয়না। ফের ঋণ বাড়ে। গয়না আর ঘরে ফেরে না। বছরের পর বছর ধরে এটাই বহু চাষির বারোমাস্যা।
ক্ষুদ্র কিংবা প্রান্তিক চাষির অবস্থা আরও করুণ। এই ঋণ, কম ফলন, ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া, খরা, বন্যা, ফড়ের দাপটে শুধু জেলা বা রাজ্যই নয়, তামাম দেশেই চাষির অবস্থা কহতব্য নয়।
অথচ, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কৃষিজীবী। সারা দেশের অন্নের সংস্থান ও গ্রামীণ অর্থনৈতিক বিকাশেও কৃষিই অন্যতম ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু রুখু বাস্তব এটাই যে, কৃষি ও কৃষক সব চেয়ে বেশি অবহেলিত। দীর্ঘ দিন ধরে সরকারি নীতি ও তার প্রয়োগ নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। ক্রমান্বয়ে অর্থ বরাদ্দ কমিয়েও যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তা-ও সময় মতো, সুষ্ঠু ভাবে খরচ করা হয় না। তার সরাসরি প্রভাব এসে পড়ছে কৃষিক্ষেত্র ও কৃষকের পরিবারের উপরে। পরবর্তী প্রজন্ম কৃষিকাজে উৎসাহ হারাচ্ছে। ক্ষুব্ধ হচ্ছেন চাষি। সেই ক্ষোভ আর চাপাও থাকছে না।
গত বছর মার্চে ৪০ ডিগ্রি গরমে নাশিক থেকে মুম্বই— মহারাষ্ট্রের ‘কিষাণ লং মার্চ’-এ ১৮০ কিলোমিটার হেঁটেছিলেন শেখুবাই ওয়াগলে। টানা ছ’দিন হাঁটার পরে চটি ছিঁড়ে গিয়েছিল। ফোসকা পড়ে দু’পায়ের তলার পুরো চামড়াটাই প্রায় উঠে এসেছিল।
শেকুবাইয়ের ক্ষতবিক্ষত পা হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের প্রতীকী ছবি। সেই ঘটনার এক বছর পূর্ণ হতে চলল। কিন্তু এখনও তাঁর পাট্টা মেলেনি। গত ডিসেম্বরের শেষে শেখুবাই সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘কবে যে ঘা শুকোবে? পায়ের ছাল গেল। নথ গেল। তবু পাট্টা মিলল না।’’ ফের সেই লং মার্চ-এর প্রস্তুতি নিচ্ছে মহারাষ্ট্র।
টিভির সামনে বসে লং মার্চ দেখেছিল এই বঙ্গের চাষিরাও। মনে মনে অনেকেই হেঁটেছিল সেই মিছিলে। আসলে, মহারাষ্ট্র হোক বা পশ্চিমবঙ্গ— চাষির যন্ত্রণাটা কিন্তু এক। দাবিও। একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবলেই দেখা যাবে, কৃষি-সঙ্কট শুধু কৃষকের নয়, এ গোটা দেশের সঙ্কট। অর্থনীতিবিদদের মতে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে গ্রামে কৃষিজীবী মানুষের আয় অনেকটাই কমেছে। পরের তিন বছরেও সেই অবস্থার বিশেষ কোনও উন্নতি হয়নি। কৃষি দফতর কর্তৃক প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, কৃষিজাত ফসলের উৎপাদনের পরিমাণ, খাদ্য নিরাপত্তা সূচকের স্তর, কৃষিতে কর্ম সংস্থান ও জাতীয় আয়ে ধাক্কা খেতে শুরু করেছে। এ বিষয়ে সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি রিপোর্টে দেখা যায়, দেশে দারিদ্র কমলেও বেড়েছে আর্থ-সামাজিক অসাম্য।
কৃষকের আত্মহত্যা সংক্রান্ত বিষয়ে রাজ্যসভায় মাননীয় কৃষি প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য ও ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরো রিপোর্টের ভিত্তিতে জানা যায়, ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কুড়ি বছরে প্রায় তিন লক্ষেরও বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। যদিও পরবর্তী বছরগুলিতে ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরো কৃষকদের আত্মহত্যা নিয়ে আর কোনও তথ্যই প্রকাশ করেনি। স্বাভাবিক কারণেই কৃষকদের পরিস্থিতি যে ভয়াবহ ও জটিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। স্বাভাবিক ভাবেই সামগ্রিক কৃষি সমস্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কৃষক অসন্তোষও।
এই মুহূর্তে জরুরি, কৃষি বাজেটে অর্থের বরাদ্দ বাড়ানো, কৃষকদের ঋণের আওতায় এনে ফসল ও কৃষকদের বিমা করানো। নদী ও ক্যানেল সেচের সম্প্রসারণের মাধ্যমে অসেচভুক্ত জমিকে সেচের আওতায় আনতে হবে। জৈব বা জীবাণু সারের ব্যবহার ও তার উপকরণের সরবরাহ বৃদ্ধি, জলের সুষ্ঠু ব্যবহার, উচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার, শস্যের বৈচিত্রকরণ, ফসলের ন্যায্য দাম, শস্য সুরক্ষায় ব্যবস্থা নিতে হবে। মিশ্র চাষআবাদের দিশা দেখানো, উন্নত মানের চাষ পদ্ধতির এবং প্রযুক্তির সুষ্ঠু ব্যবহার, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, উৎপাদিত ফসলের সুষ্ঠু বিপণন ও প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিজ শিল্প স্থাপন, কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহার্য উপকরণের সুষ্ঠু বণ্টন এবং তার পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শনের ব্যবস্থা করাটা সরকারের আশু কর্তব্য।
তবে, তারও আগে সরকারকে চাষিদের কথা ধৈর্য ধরে শুনতে হবে।
করিমপুর ফার্মার্স ক্লাবের সম্পাদক