সরকারি প্রকল্পের মূল্যায়নের কাজটি প্রায়ই হইয়া দাঁড়ায় ব্যর্থতার অনুসন্ধান। ইহা বিপজ্জনক। প্রশাসনের উপর নাগরিক আস্থা হারাইলে উভয়ের দূরত্ব বাড়িবে। তাই নরেন্দ্র মোদী সরকারের চার বৎসর পূর্তি উপলক্ষে কেন্দ্রের সাফল্যের বিচারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। ‘প্রধানমন্ত্রী জনধন যোজনা’ প্রকল্পে দেশের সকল নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলিবার লক্ষ্য ঘোষণা করিয়াছিলেন মোদী। তাহাতে দরিদ্র ও প্রান্তবাসী মানুষদের অর্থনীতির মূলস্রোতে আনা সম্ভব হইবে। এই প্রকল্পের সাফল্য কম নহে। ২০১১ সালে মাত্র ৩৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল। আজ দশ জন ভারতীয়ের আট জনেরই অ্যাকাউন্ট রহিয়াছে। গ্রামীণ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দ্বিগুণ হইয়াছে, মহিলাদের ব্যাঙ্ক-সংযোগ ৩০ শতাংশ বাড়িয়াছে। ৮০ শতাংশ ব্যাঙ্ক-সংযুক্তি ভারতকে চিনের সহিত সমান আসন দিয়াছে। মানব উন্নয়নের নানা সূচকে প্রতিবেশীদের চাইতে ভারত পশ্চাতে পড়িয়াছে, কিন্তু ব্যাঙ্ক সংযুক্তিতে এ দেশ অগ্রণী। বাংলাদেশে ব্যাঙ্ক-সংযুক্তি ৫০ শতাংশ, পাকিস্তানে ২১ শতাংশ।
প্রশ্ন একটাই। ব্যাঙ্ক-সংযুক্তি নাগরিকের জীবনে কতটা পরিবর্তন আনিয়াছে? উত্তরটি জটিল। সরকারি প্রকল্পের অনুদান সরাসরি দরিদ্র পরিবারের অ্যাকাউন্টে আসিবার ফলে দুর্নীতি কমিয়াছে, নরেন্দ্র মোদীর দাবি। তেমনটাই প্রত্যাশিত। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সমীক্ষার ফল, জনধন অ্যাকাউন্ট খুলিবার পরে গ্রামীণ পরিবারগুলির সঞ্চয়ের অভ্যাস বাড়িয়াছে, নেশাদ্রব্যে খরচ কমিয়াছে। স্বাভাবিক। সঞ্চয় সহজ ও আকর্ষক হইলে দরিদ্রও তাহার সুযোগ লইবে। প্রধান সমস্যা অন্যত্র। বিশ্বব্যাঙ্কের একটি সমীক্ষায় প্রকাশ, জনধন অ্যাকাউন্টগুলির অর্ধেকই অব্যবহৃত হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। এক বৎসরের মধ্যে সেগুলিতে লেনদেন হয় নাই। আক্ষেপ, অকেজো অ্যাকাউন্টের অনুপাত (৪৮ শতাংশ) বিশ্বে সর্বাধিক। উন্নয়নশীল দেশগুলিতেও গড়ে ২৪ শতাংশ অ্যাকাউন্ট অব্যবহৃত পড়িয়া থাকে। ভারতে নিষ্ক্রিয় অ্যাকাউন্ট তাহার দ্বিগুণ। অতএব মোদী সরকার তিন বৎসরে ৩০ শতাংশ নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলিবার দাবি করিলেও তাহাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির দাবি করিতে পারে না।
এই পরিস্থিতি কেন? কেননা যাহাদের রোজগার নাই, তাহাদের লেনদেনের ক্ষমতাও নাই। অব্যবহৃত অ্যাকাউন্ট মহিলাদেরই বেশি। এ দেশে তাহাই প্রত্যাশিত। ভারতে মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের হার মাত্র ২৫ শতাংশ। অর্থনীতির মূলধারা হইতে যাঁহারা বিচ্ছিন্ন, কেবল ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলিয়া তাঁহাদের অন্তর্ভুক্তি সম্ভব নহে। দ্বিতীয় কারণ, ভারতে শ্রমিকদের বিরাট অংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত। তাঁহাদের রোজগার ও খরচ অধিকাংশই নগদে, সঞ্চয় সামান্য, প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ লইবার শর্ত পূরণে তাঁহারা অক্ষম। মূলধারার সহিত তাঁহাদের যুক্ত করিতে হইলে প্রাপ্য বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষার অধীনে তাঁহাদের আনিতে হইবে। আধার কার্ড বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লেনদেনের ‘ডিজিটাল সমাধান’ কাজে লাগিবে না, যদি শ্রমের ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যকর না হয়। রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগাইয়া লক্ষ্যে পৌঁছাইবার ক্ষমতা জনধন প্রকল্প দেখাইয়াছে। কিন্তু ‘কাজ’টি কী, তাহা ফের বিবেচনা দরকার।