সম্পাদকীয় ২

অসাম্যের শিক্ষা

রাজ্য সরকার দরিদ্র শিশুকে স্কুলের পোশাক, জুতা, ব্যাগ, সাইকেল প্রভৃতি জোগাইতে কার্পণ্য করে নাই। অথচ যথেষ্ট অনুদান নাই মিড ডে মিলে। খেলাধুলা, আঁকা, নাচগানের জন্য সরকারি স্কুলে পৃথক অনুদান নাই। শিক্ষা আনন্দময় না হইলে শিশুরা স্কুলে আসিবে কেন? আজও এ রাজ্যে প্রায় অর্ধেক ছেলেমেয়ে স্কুলশিক্ষা সম্পূর্ণ করিতে পারে না। তাহাদের জাতি-ধর্ম-ভাষা যাহাই হউক, তাহারা দরিদ্র। শিক্ষায় অসাম্যের এই মানচিত্র নানা রিপোর্টে প্রকাশ পাইতেছে। সরকারকে সুপারিশও কম করা হয় নাই। শুনিবে কে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৮ ০১:২৪
Share:

সামাজিক ন্যায় নিশ্চিত করিবার উপায় শিক্ষা। অথচ এই রাজ্যে শিক্ষার অভ্যন্তরে বসিয়া আছে অসাম্য। প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে প্রতীচী ট্রাস্টের রিপোর্ট আরও এক বার দেখাইল, স্কুলের সংখ্যা, ক্লাসঘর ও শিক্ষকের সংখ্যা বাড়াইবার পরেও কত বিচিত্র উপায়ে শিক্ষায় দরিদ্রের বঞ্চনা চলিয়াছে। ইহার জন্য দায়ী প্রধানত রাজ্য সরকারের শিক্ষা দফতর। সরকার প্রয়োজনের অধিক শিক্ষক নিয়োগ করিয়াছে, কিন্তু দরিদ্র জেলার দরিদ্র গ্রামের স্কুলে শিক্ষক দেয় নাই। প্রতীচী রিপোর্টে প্রকাশ: মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় শিক্ষকের বড় ঘাটতি আছে। এই চারটি জেলাই মানব উন্নয়নের নানা সূচকে পিছাইয়া আছে। সাম্যের বিচারে আর্থিক অনুদান এবং মানবসম্পদ এই জেলাগুলিতেই অধিক নিয়োগের কথা। হইতেছে বিপরীত। রাজ্যে প্রাথমিক স্কুলগুলিতে গড়ে তেইশ জন ছাত্র পিছু এক জন শিক্ষক, এই জেলাগুলিতে সেই সংখ্যা চল্লিশ বা তাহারও অধিক। শিক্ষার মানে কি ইহার প্রতিফলন পড়ে নাই? উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে প্রাথমিকের পড়ুয়াদের একই শ্রেণিতে ছাত্রছাত্রীদের পুনরাবৃত্তির হার অত্যধিক। প্রতীচীর এই রিপোর্টখানির সীমা ছাড়াইয়া জেলার অভ্যন্তরের বিশ্লেষণ করিলে দেখা যাইবে, বহরমপুর কিংবা রায়গঞ্জে শিক্ষক যদি বা কিছু থাকেন, সুতি কিংবা হরিহরপাড়া, ইসলামপুর কিংবা গোয়ালপোখরে তাঁহাদের উপস্থিতি সামান্য। প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষক পাঠাইতে সরকার ব্যর্থ।

Advertisement

এই অসাম্য নানা ভাবে কার্যত সরকারি নীতিতে পরিণত হইতেছে। এক, দরিদ্র অঞ্চলে স্কুলের ঘাটতি মিটাইতে সর্বশিক্ষা অভিযানের সূচনায় তড়িঘড়ি শিশুশিক্ষা কেন্দ্র শুরু হইয়াছিল। তাহাদের অধিকাংশ পড়ুয়া দলিত, আদিবাসী ও মুসলিম। পঞ্চায়েত দফতরের অধীনস্থ কেন্দ্রগুলিকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণির বিদ্যালয়’ বলিলে ভুল হয় না। বিদ্যালয়ের পরিকাঠামো হইতে শিক্ষকের প্রশিক্ষণ ও বেতন, সকল বিষয়েই শিশুশিক্ষা কেন্দ্র পশ্চাৎপদ। কিন্তু সেগুলিকে শিক্ষা দফতরের অন্তর্গত করিয়া পুরাদস্তুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিণত করিতে সরকারের অনীহা। কলিকাতা, হাওড়া বা হুগলির অধিকাংশ শিশু প্রাথমিক স্কুলে পড়িবে, সুন্দরবন বা জঙ্গলমহলের শিশুরা যাইবে শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে— ইহাতে অন্যায় খুঁজিয়া পায় না সরকার। দুই, প্যারাটিচার, বা চুক্তিতে নিযুক্ত শিক্ষকদের জন্য ‘সংরক্ষণ’ আনিতে চাহে সরকার। ইহাও একটি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট কিংবা হিন্দু স্কুলে প্যারাটিচার নিয়োগের সাহস শিক্ষা দফতরের নাই। কিন্তু সুতি কিংবা হাসনাবাদের শিশুদের প্যারাটিচার-নির্ভর করিয়া রাখিতে বিবেকদংশন হয় না।

রাজ্য সরকার দরিদ্র শিশুকে স্কুলের পোশাক, জুতা, ব্যাগ, সাইকেল প্রভৃতি জোগাইতে কার্পণ্য করে নাই। অথচ যথেষ্ট অনুদান নাই মিড ডে মিলে। খেলাধুলা, আঁকা, নাচগানের জন্য সরকারি স্কুলে পৃথক অনুদান নাই। শিক্ষা আনন্দময় না হইলে শিশুরা স্কুলে আসিবে কেন? আজও এ রাজ্যে প্রায় অর্ধেক ছেলেমেয়ে স্কুলশিক্ষা সম্পূর্ণ করিতে পারে না। তাহাদের জাতি-ধর্ম-ভাষা যাহাই হউক, তাহারা দরিদ্র। শিক্ষায় অসাম্যের এই মানচিত্র নানা রিপোর্টে প্রকাশ পাইতেছে। সরকারকে সুপারিশও কম করা হয় নাই। শুনিবে কে?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন