সন্তোষী কুমারীর নামটি এখনও গণস্মৃতি হইতে সম্পূর্ণ মুছিয়া যায় নাই। গত বৎসরের শেষ ভাগে ঝাড়খণ্ডের একাদশবর্ষীয়া মেয়েটি খবরের শিরোনামে আসিয়াছিল। তাহার মৃত্যুর পর অভিযোগ উঠিয়াছিল, অনাহারে প্রাণ গিয়াছে তাহার। রেশন কার্ডকে আধারের সহিত লিংক করাইয়া উঠিতে পারে নাই তাহার পরিবার, ফলে রেশন পাওয়াও বন্ধ হইয়াছিল। সন্তোষী একা নহে, অন্তত ছয়টি মৃত্যুর ক্ষেত্রে একই অভিযোগ উঠিয়াছিল। প্রতিটি ঘটনাই ঝাড়খণ্ডের। যেমন হইয়া থাকে— মানবাধিকার কর্মীরা ‘অনাহারে মৃত্যু’-র অভিযোগ তোলেন, আর সরকার প্রাণপণ তাহা অস্বীকার করে— এই মৃত্যুগুলির ক্ষেত্রেও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় নাই। ‘অনাহারে মৃত্যু’ কাহাকে বলে, তাহার কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নাই। ফলে, অভিযোগটি করা যতখানি সহজ, তাহা অস্বীকার করা সহজতর। সরকার এবং প্রশাসন সেই সহজতর পথে হাঁটিতেই অভ্যস্ত। আশার কথা, যে ঝাড়খণ্ডে ক্রমাগত অনাহারে মৃত্যুর অভিযোগ উঠিতেছে, সেখানেই এই ধারাটি ভাঙিবার প্রাথমিক চেষ্টা আরম্ভ হইল। ‘অনাহারে মৃত্যু’ কাহাকে বলে, তাহার জন্য কোন কোন মাপকাঠি ব্যবহার করা বিধেয়, তাহা নির্দিষ্ট করিবার জন্য রাজ্য সরকার কমিটি গঠন করিয়াছে। সেই কমিটিতে শুধু সরকারি কর্তারাই নাই, মানবাধিকার কর্মীরাও আছেন। ভারতে এই প্রথম সরকারি স্তরে এই গোত্রের কোনও প্রয়াস হইতেছে।
অনাহার-মৃত্যুর ‘প্রোটোকল’ তৈরি হইলেই যে সরকারের দায় এড়াইবার আর কোনও উপায় থাকিবে না, এমন দাবি করিবার প্রশ্নই নাই। বস্তুত, এই গোত্রের প্রচেষ্টার আড়ালে বহু ক্ষেত্রেই দায় ঝাড়িয়া ফেলিবার অপচেষ্টা থাকে। ঝাড়খণ্ডেও যে তাহা হইবে না, সেই নিশ্চয়তা নাই। কিন্তু, একই সঙ্গে বলা প্রয়োজন, প্রোটোকল তৈরির সিদ্ধান্তটি একটি সম্ভাবনার দরজা খুলিয়া দিল। অনাহারের দায় অস্বীকার করিবার যে নিশ্চিন্ত পরিসর প্রশাসনের ছিল, তাহাকে ভাঙিবার সম্ভাবনা। নাগরিক সমাজ সেই দরজা ঠেলিয়া কত দূর ঢুকিতে পারিবে, সরকারকে অনাহারের দায় স্বীকার করিতে, এবং অনাহার প্রতিরোধে ‘জিরো টলারেন্স’ বা বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি সহ্য না করিবার নীতি গ্রহণ করিতে কতখানি বাধ্য করিতে পারিবে, তাহা খোলা প্রশ্ন।
প্রথম কাজ হইল, প্রোটোকল তৈরির কমিটিতে শুধু সরকারের বাছিয়া লওয়া মানবাধিকার কর্মীরা থাকিলেই চলিবে না। তাহা বৃহত্তর নাগরিক সমাজের অংশীদারির জন্য খুলিয়া দিতে হইবে। দ্বিতীয় কথা, এক শত দিনের কাজ বা রেশন কার্ডের ন্যায় অধিকার মানুষের হাতে শুধু কাগজেকলমেই আছে, না কি সত্যই তাহার সুফল মানুষের নিকট পৌঁছাইতেছে, প্রোটোকলের সমীকরণে সেই কথাটির স্পষ্ট উত্তর থাকা চাই। অঙ্গনওয়াড়ি বা মিড-ডে মিলের ন্যায় প্রকল্পের কথা অবশ্যই হিসাবে থাকিবে, কিন্তু শুধু সেখানেই থামিয়া গেলে চলিবে না। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রসঙ্গটিকেও সমান গুরুত্ব দিতে হইবে। এবং, কোথাও অনাহারে মৃত্যু ঘটিলে তাহা কাহার দোষে ঘটিয়াছে, তাহা যেন নির্ভুল ভাবে জানিবার উপায় থাকে। স্পষ্টতই, দোষীকে চিহ্নিত করিতে হইলে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক, বহুবিধ স্তরের প্রভাবশালীদের চটাইবার ঝুঁকি থাকিয়া যায়। এই প্রোটোকল যেন সেই সাহস দেখাইতে বাধ্য থাকে, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে।