বয়স হইলেও অনেকেরই শৈশব কাটে না। অন্তত ছুটির প্রশ্নে। ঘেঁটু পূজাতেও ছুটি পাইলে বহু প্রাপ্তবয়স্করই শিশুসুলভ ফুর্তি হয়। তেমনই ছুটি বাতিলের কথা উঠিলেই গোঁসা। শিশুরা ঠোঁট ফুলাইয়া রাগ সারিয়া ফেলে। প্রাপ্তবয়স্করা কর্মবিরতি করেন, ধর্মীয় ভাবাঘাতের দোহাই পাড়েন। সাম্প্রতিক কালে এই ছুটির প্রসঙ্গে খাস আদালতের মধ্যে সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছে একাধিক বার। আইনজীবীরা একাধিক বার বিচারপতিদের সহিত বিরোধে জড়াইয়াছেন, প্রকাশ্যেই। সাম্প্রতিকতম সংঘর্ষের নজিরটি সুপ্রিম কোর্টের চত্বরে ঘটিল। ভারতের প্রধান বিচারপতি এইচ এল দাত্তু আগামী ৩ এপ্রিল হইতে দেশের সব উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিদের তিন দিনের সম্মেলন ডাকিয়াছেন। ৩ তারিখ গুড ফ্রাইডে। তাঁহার যুক্তি, এই সম্মেলনের জন্য আলাদা করিয়া আদালতের সময় নষ্ট করিবার প্রয়োজন নাই। গুড ফ্রাইডে ও সপ্তাহান্তের দুই দিনের ছুটিতে সম্মেলন সারিয়া প্রধান বিচারপতিরা সোমবার স্ব স্ব আদালতে ফিরিয়া যাইতে পারিবেন। এক আইনজীবীর প্রস্তাবটি পছন্দ হয় নাই। তিনি প্রধান বিচারপতিকে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবের দিন কাজ রাখার সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করিবার দাবি জানাইয়াছেন। প্রধান বিচারপতি অবশ্য তাঁহার দাবিতে কর্ণপাত করেন নাই। বরং, অতীতের উদাহরণ টানিয়া বলিয়াছেন, পূর্বেও এমন নজির আছে। ধর্মীয় বিভিন্নতার দেশে ধর্মীয় ছুটির অজুহাতে কাজ না করিতে চাইলে বাৎসরিক ছুটির সংখ্যা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলিয়া যাইবে।
প্রশ্নটি শুধু আদালত চত্বরের নহে। প্রশ্নটি ছুটির অধিকারেরও নহে। প্রশ্ন ছুটিকেন্দ্রিক মানসিকতা লইয়া। কলিকাতা হাইকোর্টে দোল ও হোলির যুগপৎ ছুটি লইয়া প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের আপত্তিটিও এই প্রেক্ষিতেই দেখা বিধেয়। বস্তুত, একটি ছুটির দিন কাজ করিয়া পড়িয়া পাওয়া ছুটির ঘাটতি পুষাইয়া দেওয়ার যে প্রস্তাব তিনি করিয়াছেন, এবং কলিকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা যে ভাবে সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করিতেছেন, তাহাতেই এই ছুটিকেন্দ্রিক মানসিকতার ছবিটি স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ে। সমস্যা ছুটি থাকা বা না থাকার নহে। সমস্যা ছুটিকেই প্রধান জ্ঞান করায়। আইনজীবীরা বিলক্ষণ জানেন, দেশ জুড়িয়া আদালতে বকেয়া মামলার পাহাড় জমিয়া আছে। তবুও যখন তাঁহারা ছুটি ছাড়িতে নারাজ, বোঝা যায়, সমস্যাটি গভীরতর। সমস্যাটি মানসিকতার।
এই মানসিকতা সমগ্র দেশের সমস্ত স্তরে পরিব্যাপ্ত। সরকারি কর্মীদের জামাইষষ্ঠীতে অর্ধদিবস ছুটি চাই, দুর্গোৎসবেও চাই, ঈদ বা বড়দিনেও। বস্তুত সম্ভবত শুধু এই কারণেই ভারতীয়রা তাঁহাদের দেশের নানা ধর্ম নানা সংস্কৃতির গুণগ্রাহী, এই বিভিন্নতা ছুটির জোগান জমজমাট রাখিতে সাহা়য্য করে, বিবিধের মাঝে ছুটির মহান মিলন জিয়াইয়া রাখে। সরকারও এই বেগবান আনন্দের জোগান অব্যাহত রাখিতে প্রস্তুত, ভোটের মরসুমে কিঞ্চিৎ বাড়াইতেও পিছপা নয়। ছুটি-দাতা ও ছুটি-গ্রহীতার এই মিলিত সন্নিবেশে একটিই বস্তু জলাঞ্জলি যায়: কর্মসংস্কৃতি। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন চাইলে একটিই পথ। সরকারকে ভাবিতে হইবে, দেশের যে অকাতর উন্নয়নের স্বপ্ন বিলানো তাহাদের প্রাত্যহিক কাজ, সেই উন্নয়নের কর্মসংস্কৃতি তৈরি করিতে কোন পথটি বাঞ্ছনীয়: বিচারপতিদের নির্দেশিত পথ, না কি চিরাচরিত ছুটি-পার্বণের পথ।